প্রকাশ : ০৭ জানুয়ারি ২০২৫, ০৯:৪৭
পাড়ায় পাড়ায় হোক বারো ঘর এক উঠান
পৃথিবীর জীবনে অবক্ষয় অনিবার্য। অবক্ষয়ে মরুর এককালের শক্ত শিলা হয়ে গেছে চূর্ণ বালুকারাশি। অবক্ষয়ে সমতল বিলীন হয়েছে নদী ও সমুদ্রতটে। প্রকৃতির অবক্ষয় মানুষ ছুঁয়ে যাবে, তা স্বাভাবিক এবং অনিবার্য। তবে সে অবক্ষয়ের উচ্চহার রোধের চেষ্টাও আজকাল মনুষ্যজগতে বিরল। এর মূল কারণ একদিকে মানুষের উচ্চাভিলাষ আর অন্যদিকে উচ্চ জনজন্মহার। ফলে সংখ্যাবৃদ্ধির সাথে সাথে অবক্ষয়ের হার যেমন বেড়ে চলেছে, তেমনি বেড়ে চলেছে ব্যবহারযোগ্য ভূমি ঘাটতির পরিমাণও। মানুষের ভবিষ্যৎ বিনিয়োগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হলো প্রজন্ম বিনির্মাণ। কিন্তু আমাদের দেশে প্রজন্ম বিনির্মাণের চেয়ে প্রজন্ম ধ্বংস করার প্রবণতাই আজ বেশি দৃশ্যমান। কিশোরদের পেশিভিত্তিক রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নে ব্যবহার, তাদের হাতে মাদক সহজলভ্য করে তোলা, ডিভাইসনির্ভর আধুনিক জীবনযাপন প্রজন্ম বিনির্মাণের তপস্যাকে পরিণত করেছে ভূমিধস দুর্যোগের সমতুল্য।
প্রজন্মকে বিনির্মাণের যোগ্য ক্ষেত্র হিসেবে কেবল প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক শিক্ষা যথেষ্ট নয়। প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক শিক্ষা তাদের সনদমুখী ও বেতনমুখী করে তোলে। জীবনমুখী করে তুলতে পারে না। বরং অনেক ক্ষেত্রেই অতিরিক্ত উচ্চাভিলাষ তৈরি করে দিয়ে তাদের জীবনবিমুখ করে দেয়। তাদের সাথে যন্ত্রের আর কোনো পার্থক্য থাকে না। শিক্ষাকে মূল অক্ষ ধরে প্রজন্মকে বিনির্মাণের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি উপাঙ্গ আমরা চিন্তা করতে পারি। এর মধ্যে সাংস্কৃতিক চর্চা, পাঠাগারকেন্দ্রিক পাঠচক্র এবং সৃজনশীল ও মননশীল বই পাঠের অভ্যাস গড়ে তোলা, ক্রীড়া চর্চা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
আজকের রচনার শিরোনামে যা উদ্ধৃত আছে তাতে বোঝা যায়, ক্রীড়া চর্চাকে আলোচনায় আনাটাই এ প্রবন্ধের মুখ্য উদ্দেশ্য। ক্রীড়া কেবল শরীর গঠন ও মনের বিকাশ সাধন করে তা-ই নয়, ক্রীড়া তৈরি করে নেতৃত্বের গুণাবলি এবং দলীয় সংহতি। ক্রীড়া প্রজন্মের অন্তরে উপ্ত করে দেয় দেশপ্রেমের বীজ। ক্রীড়া প্রজন্মকে মাদকাসক্তি, ইভ টিজিং ও কিশোর গ্যাংয়ের কুপ্রভাব থেকেও রক্ষা করতে পারে। কিন্তু সমস্যা যা আজকে প্রধান, তা হলো ক্রীড়া অনুশীলনের উপযুক্ত মাঠের অভাব। আজ যেখানে আবাসন সমস্যা প্রকট হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেখানে খেলার মাঠের ব্যবস্থা করতে পারা বিশ্বজয় করার সামিল।
মুক্তভূমির এ দুর্দিনে আজকাল বড়ো বড়ো নগরে বিকল্প এক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। এ ব্যবস্থা হলো টার্ফ বা কৃত্রিম ঘাসের একখণ্ড মুক্তমঞ্চ। নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে এখানে আগ্রহীরা খেলতে পারে। তবে তা সর্ব সাধারণের জন্যে নয়। সামর্থ্যবান ও উঁচুতলার মানুষ ও তাদের সন্তানেরাই এ ব্যবস্থায় সুফল পেতে পারে। এ ধরনের ব্যবস্থা যেমন বাণিজ্যিক ও ব্যয়বহুল, তেমনি এগুলো সব জায়গায় নেই। সাধারণত উচ্চবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্তের বসবাসের এলাকায় এ ধরনের সুবিধাগুলো চালু হয়েছে। কিন্তু যারা আর্থিক সামর্থ্যে দুর্বল তাদের জন্যে মাঠের কী ব্যবস্থা হতে পারে? সেই সংকট কাটিয়ে উঠতে হলে আজ বারো ঘর এক উঠানের তত্ত্ব হাজির করা জরুরি হয়ে পড়েছে। 'বারো ঘর এক উঠান' শিরোনামটি ঔপন্যাসিক জ্যোতির্ময় নন্দীর একটি উপন্যাসকে তুলে ধরে, যেখানে বস্তির বারোটি পরিবার একটা উঠানকে ব্যবহার করে। ঠিক এই বিষয়টিকেই আজ পাড়ায় পাড়ায় খেলার মাঠ সৃজনের তত্ত্ব হিসেবে সামনে আনা যায়। আর্থিক ক্ষেত্রে বা কৃষিক্ষেত্রে সমবায়ের মতো আজ ক্রীড়াতেও সমবায়ের জোয়ার আনতে হবে। কোনো পরিবারের একার পক্ষে বড়ো একটি উঠানের মালিক হওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু প্রতিটি পরিবারের বাড়ির সামনে কিছু না কিছু খালি জায়গা থাকে। এরকম দশ-বারোটা পরিবার মাঝখানে গণউঠোন রেখে যদি চারপাশে বাড়ি তোলে, তাহলে মাঝখানের উঠোনটাই একটা ব্যবহারযোগ্য খেলার মাঠ হয়ে উঠতে পারে। এতে কেবল মাঠের সংকট ঘুচবে তা নয়, বরং এর ফলে খেলার সাথিও ঐসব পরিবারের শিশু-কিশোররা হয়ে উঠতে পারবে। নিজেদের একটা উঠোনে ক্রীড়া চর্চার সুযোগে প্রজন্মকে বিপথে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষার পাশাপাশি বাড়ির বহিরাঙ্গনের সৌন্দর্যও সুরক্ষিত থাকবে।
শহর-নগর বা শহরতলীগুলো আজকাল আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্নে বিভোর। এটা দায়ে পড়ে যেমন করতে হয়, তেমনি বাণিজ্যেরও সায় আছে প্রকট। এসব আকাশচুম্বী অট্টালিকাতে বাধ্যতামূলক একটা ইনডোর গেমস সেন্টার রাখা উচিত। বেসমেন্টে যেমন পার্কিংয়ের ব্যবস্থা থাকে, তেমনি গ্রাউন্ডেও ইনডোর গেমসের ব্যবস্থা রাখা যায়। এতে ব্যাডমিন্টন, টেবিল টেনিস, ভলিবল, বাস্কেটবলের মতো ইনডোর গেমসের সুবিধা রাখলে প্রজন্মের মধ্যে ডিভাইসপ্রীতির চেয়ে ক্রীড়াপ্রীতি তৈরি হতে পারে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায়। এমনকি প্রতিটি অ্যাপার্টমেন্টে আবাসিক পরিবারগুলোর মধ্যে বার্ষিক ইনডোর গেমসের প্রতিযোগিতাও হতে পারে। অর্থাৎ এ ব্যবস্থায় কেবল শিশু-কিশোররাই নয়, পরিবারও ক্রীড়ায় সংযুক্ত হতে পারে। ফলে বাঙালির যে চিরায়ত অভ্যাস পরচর্চা ও পরনিন্দা, তা থেকে পরিত্রাণের একটা ভালো উপায় তৈরি হবে।
এই শীতে বেশ ঘটা করেই শুরু হয়েছে বিপিএল ক্রিকেটের জমজমাট আসর। আসর জমাতে প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা ব্যয়ে আনা হলো নুসরাত ফতেহ আলি খানের ছেলে রাহাত ফতেহ আলি খানকে। তারুণ্যকে আকর্ষণ করতেই মূলত এ আয়োজন। কিন্তু আয়োজনটি দিনশেষে পরিণত হলো মিষ্টিতে ভরে ম্যালেরিয়ার ঔষধ খাওয়ানোর মতো। তারুণ্য রাহাত ফতেহ আলি খানে যত মজে গেল ততটা বিপিএলে মজে না। এর কারণ নিহিত আছে সেই এক গোড়াতেই। তারুণ্যের ক্রীড়া চর্চায় মাঠের ব্যবস্থা না করে মিউজিক কনসার্টের আয়োজন করাটা প্রহসনের সামিল। তাছাড়া টিকেটের যে দাম ছিলো তাতে দরিদ্রঘরের তরুণদের পক্ষে ঐ কনসার্টে সামিল হওয়াটা কঠিন ছিলো। অর্থাৎ একদিকে আমরা চাইছি বটে তরুণদের ক্রীড়ায় সংযুক্ত করতে, কিন্তু অন্যদিকে আমরা সকল সুযোগ-সুবিধায় তৈরি করছি বৈষম্য। সকল কিছুই পরিকল্পনা করা হচ্ছে আর্থিক সামর্থ্যবানদের কথা মাথায় রেখে। ফলে আমাদের অনুজ প্রজন্মগুলো আশার চেয়ে হতাশায় ভুগছে বেশি। তাদের এই হতাশা থেকে টেনে তুলতে হলে চাই ক্রীড়া সমবায়৷ প্রতিটি অ্যাপার্টমেন্টে যেমন চাই ক্রীড়া চর্চা কেন্দ্র, তেমনি প্রতিটি পাড়ায় চাই বারো ঘর এক উঠোন তত্ত্বের সমবায় বিকাশ। ফলে ক্রীড়াও একসময় দশের লাঠি একের বোঝা হয়ে এগিয়ে যাবে তর তর করে। অর্থ নয়, উদ্দেশ্যই হোক ক্রীড়ার মূল অভিলক্ষ্য।