প্রকাশ : ০৪ ডিসেম্বর ২০২১, ০০:০০
সারা বিশে^ বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে পরিচিত। দুর্নীতিবাজরাই সমাজ ও দেশের উন্নয়নে এখন সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশে দুর্নীতি সবখানেই চলছে। তবে শিক্ষা খাতে দুর্নীতি হচ্ছে একটু বেশি। শিক্ষা খাতের শিক্ষাগুরুদের এখন নীতি নেই; অনিয়মে ঢাকা পড়েছে সব রীতিনীতি। শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান, সচিব শিক্ষার বড় একটা জায়গা দখল করে থাকেন। শিক্ষার্থীদের কাছে তাঁরা যেন দেবতুল্য। শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান, সচিব যদি দুর্নীতিগ্রস্ত হন তাহলে অবশিষ্ট আর কিছু থাকে না।
খবরটা খুবই ব্যথিত করে আমাদের। পাঁচ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ মাথায় নিয়ে পদ হারালেন যশোর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোল্লা আমির হোসেন এবং সচিব এএমএইচ আলী আল রেজা। ২৩ নভেম্বর তাদের দুজনকে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরে (মাউশি) ওএসডি করে আদেশ জারি করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এর আগে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে গত ১৮ অক্টোবর চেয়ারম্যান-সচিবসহ মোট পাঁচজনকে আসামি করে মামলা দায়ের করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। একই দিন এমন অভিযোগেই রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ড. মোহা. মকবুল হোসেনকেও ওএসডি করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের একটি বিখ্যাত কবিতার দুটি চরণ বেশ মনে পড়ছে, ‘তিনভাগ গ্রাসিয়াছো একভাগ বাকী/সুরা নাই পাত্র হাতে কাঁপিতেছে সাকী।’ দুর্নীতি এখন দেশের সর্ব শিক্ষিত মহলেও যেভাবে জায়গা দখল করে আছে তাতে অবশিষ্ট বোধ করি ১ ভাগও নেই। দুর্নীতিবাজদের আসলে কোনো নীতি নাই। দফায় দফায় প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধি করা হয়েছে, তবু ঘুষ-দুর্নীতি বন্ধ হচ্ছে না। শিক্ষাসহ সরকারি ও বেসরকারি খাতে যেভাবে দুর্নীতির প্রসার ঘটছে তা নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। ঘুষ, দুর্নীতি, অর্থ আত্মসাৎ, লুটপাট, জালিয়াতি বেড়েই চলছে। প্রতিদিন নানা ক্ষেত্রে দুর্নীতির প্রচুর অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। হাল সময়ে শিক্ষা খাতে দুর্নীতি বাড়ছে। এ অবস্থায় এখনই দেশের মেরুদ- খ্যাত শিক্ষা সেবা খাতকে নির্ঝঞ্ঝাট ও দুর্নীতিমুক্ত রাখা জরুরি হয়ে পড়েছে।
কীভাবে দুর্নীতির এই সর্বগ্রাসী থাবা থেকে মুক্ত হওয়া যায়? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে আমাদের বুঝতে হবে যে, কেন দুর্নীতি হয় বা দুর্নীতি বিস্তাারের প্রক্রিয়া কীভাবে বৃদ্ধি পায়। সার্বিকভাবে দেখলে দুর্নীতির ব্যাপকতার সাথে নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের একটি সম্পর্ক আছে। শিক্ষা সর্বোচ্চ জায়গা, এমন অবক্ষায় মেনে নেবার মতো নয়। এ কথার সত্যতা স্বীকার করে নিয়ে বলতে হয় যে, কেবল মূল্যবোধের অবক্ষয় বাংলাদেশের দুর্নীতির ব্যাপক প্রসারের প্রক্রিয়াকে ব্যাখ্যা করতে পারে না। কেননা দুর্নীতি পৃথিবীর সবদেশেই কম-বেশি হয়। কিন্তু বাংলাদেশে দুর্নীতির ব্যাপকতা জনগণের মনে যে পরিমাণ হতাশার সৃষ্টি করে তা তুলনাহীন। সমাজের সুশীল অংশেও ন্যায়-অন্যায়ের সংজ্ঞা পরিষ্কার নয়। জনগণের মনে এই ধারণা যত ক্রমবিকাশমান হচ্ছে, হতাশা তত বৃদ্ধি পাচ্ছে, সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্পর্কে বিরূপতা তত বেশি বেড়ে যাচ্ছে। এই হতাশার ফল ধরে আমরা হয়ে যাচ্ছি বছরের পর বছর দুর্নীতিতে শীর্ষস্থানীয় একটি দেশ।
কেবল শিক্ষা খাতে নয়, সমাজের প্রতিটি স্তরে ঘুষ, দুর্নীতি ক্যান্সারের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। এ ব্যাধি থেকে নিস্তার পাওয়ার পথ হচ্ছে সমাজ ও রাষ্ট্রের বেশকিছু ক্ষেত্রে ব্যাপক সংস্কার সাধন করা এবং উন্নয়ন ঘটানো। এ জন্য আমাদের রাজনীতিক, মন্ত্রী, আমলা আর দেশের মানুষের মানসিকতার পরিবর্তনেরও কোনো বিকল্প নেই। দুর্নীতি কমার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে না। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর অবস্থানের পাশাপাশি অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। কারণ সেবা খাতের এই দুর্নীতিই সুশাসন প্রতিষ্ঠাকে ব্যাধিগ্রস্ত করে তুলছে। আজ দুর্নীতি যেভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে ছেয়ে যাচ্ছে, সাধারণ মানুষ যার কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হচ্ছে, তার পেছনে রয়েছে দুর্নীতির সঙ্গে যুক্তদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়া। বেশিরভাগ সময়েই যারা দুর্নীতি করেন তারা পার পেয়ে যান। দুর্নীতির অভিযোগ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমলে নেওয়া হয় না, দুর্নীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি শাস্তি পায় না, ফলে দুর্নীতি রোধ করাও সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। দুর্নীতি রোধে আইনের কঠোরতা বাড়াতে হবে, সর্বোপরি এ জাতীয় অপরাধে জড়িতদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
একটি জাতির মেরুদ- সোজা করে দাঁড়াতে শিক্ষার বিকল্প নেই। তাই এই খাতে সরকারের বরাদ্দও অনেক। যত বরাদ্দ তত দুর্নীতি। দুর্নীতির মহোৎসব শিক্ষা খাতকে এমনভাবে আঁকড়ে ধরেছে যে, দেশের দুর্নীতিগ্রস্ত খাতগুলোর মধ্যে শিক্ষা খাতের অবস্থান এখন সর্বাগ্রে। শিক্ষা খাতে দুর্নীতির মহোৎসব চলছে, অস্বচ্ছতা আর জবাবহীনতার কারণে শিক্ষাখাত আজও অন্ধকারাচ্ছন্ন।
শিক্ষাখাতে বেশ ক’টি স্তরে দুর্নীতি হয়। দুর্নীতির ফলস্বরূপ ১৫ শতাংশ বাজেটের প্রকৃত কাজে ব্যয় হয় মাত্র ৫ শতাংশ বাজেট। বাকি ১০ শতাংশই জনগণের চোখের আড়ালে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে চলে যায়। শিক্ষাখাতের কিছু লোক হয়ে ওঠে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ। শিক্ষা খাতের উপবৃত্তি পেতে ৩২.৪ শতাংশ শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে ৪০ টাকা করে দিতে হয়। এছাড়া বিদ্যালয়গুলো প্রাথমিক স্তরে ৫ শতাংশ ও মাধ্যমিক স্তরে ৩৮ শতাংশ ছাত্রীর উপবৃত্তির টাকার এক-তৃতীয়াংশ কেটে রাখে। এই হচ্ছে অবস্থা। দুর্নীতি যে এ সময়ই হচ্ছে তা কিন্তু নয়। ২০০১ সালের একটি রিপোর্টে দেখা যায়, খাদ্যের বিনিময়ে শিক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়নে ৬টি উপজেলাতেই ১২৪১ টন খাদ্য দুর্নীতি হয়, যার আনুমানিক মূল্য ছিল ১২ মিলিয়ন টাকা। বিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে শিক্ষা উপকরণ, পরীক্ষার ফি ইত্যাদি প্রতিটি ক্ষেত্রে দুর্নীতি হচ্ছে অহরহ। আবার উচ্চতর শিক্ষায় ভর্তি বাণিজ্য, সার্টিফিকেট বিক্রি এখন যেন নিতান্তই সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) গবেষণা প্রতিবেদনে শিক্ষা খাতের সার্বিক যে চিত্র উঠে এসেছে, তা এককথায় ভয়াবহ। প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষার সর্বত্র দুর্নীতি, অনিয়ম, অব্যবস্থা জেঁকে বসেছে। টিআইবির প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের মাধ্যমিক শিক্ষায় এমপিওভুক্তি, নিয়োগ, বদলি, পাঠদানের অনুমতিসহ বিভিন্ন কাজে ৫ হাজার থেকে শুরু করে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়মবহির্ভূত (ঘুষ) দিতে হয়। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) ও এর অধীন বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটি, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, প্রধান শিক্ষক থেকে শুরু করে শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের এ ঘুষ দিতে হয়। এ ছাড়া বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারীদের এমপিওভুক্তির (মাসে বেতন বাবদ সরকারি টাকা) কাজে চার স্থানে ‘হাদিয়া বা সম্মানী’ দিতে হয়। এ কাজে পাঁচ হাজার থেকে শুরু করে এক লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়মবহির্ভূত ঘুষ দিতে হয়। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সহকারী শিক্ষক নিয়োগ বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে হলেও অধ্যক্ষ, প্রধান শিক্ষক ও সহকারী প্রধান শিক্ষক নিয়োগ হচ্ছে আগের নিয়মেই, যেখানে ঘুষ ও রাজনৈতিক প্রভাব দুটোই সক্রিয়। বিভিন্ন এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়মবহির্ভূত অর্থ আদায়ের মাধ্যমে প্রার্থী নিয়োগের পাশাপাশি সনদ জালিয়াতির মাধ্যমে সহকারী শিক্ষক পদে নিয়োগের অভিযোগ আছে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন পর্যায়ে বিপুল অঙ্কের অর্থ লেনদেনের তথ্য পত্রিকান্তরে পাওয়া গেছে। নিঃসন্দেহে অভিযোগগুলো গুরুতর।
প্রশ্ন হলো, ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে যারা নিয়োগপ্রাপ্ত হন, তাদের কাছে শিক্ষার্থীরা কী শিখবে? শিক্ষকদের মান প্রশ্নবিদ্ধ হলে দেশের মানবসম্পদের উন্নয়ন হবে কীভাবে? শিক্ষাখাতে দুর্নীতি সরকারের বড় বড় অর্জন ম্লান করে দিচ্ছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের অবস্থান যথেষ্ট শক্ত না হলে দেশ থেকে দুর্নীতির মূলোৎপাটন করা কঠিন। দুর্নীতি নির্মূলে সরকারকে যথার্থই ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অবলম্বন করতে হবে। মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার মান উন্নয়নে ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণের পাশাপাশি সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের উচিত হবে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়া। আমরা যদি নতুন প্রজন্মের কাছে ভালো কিছু আশা করি, তাহলে দুর্নীতির মূলোৎপাটন করতেই হবে।
মাধ্যমিক শিক্ষায় অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে টিআইবির গবেষণায় বলা হয়েছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে নীতিমালা লঙ্ঘন করে দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে এমপিওভুক্তির তালিকায় যুক্ত করা হয়। এমপিও সুবিধার প্রক্রিয়া বিকেন্দ্রীকরণ ও অনলাইনে হলেও চারটি স্থানে হাদিয়া বা সম্মানী দিতে হয়। এই চার ধাপ হলো প্রতিষ্ঠান প্রধান, উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস, জেলা শিক্ষা অফিস ও আঞ্চলিক উপ-পরিচালকের কার্যালয়। প্রতিটি ধাপে আবেদনের অগ্রগতির জন্য টাকা দিতে হয়। না হলে আবেদনে ত্রুটি, আবেদন অগ্রায়ন না করা এবং অহেতুক সময় ক্ষেপণ করা হয়। এ ছাড়া টাকার বিনিময়ে প্রাপ্যতা না থাকা সত্ত্বেও এমপিওভুক্তির ব্যবস্থা করা হয়। প্রধান শিক্ষক, অধ্যক্ষ ও সহকারী প্রধান শিক্ষক নিয়োগে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব, স্বজনপ্রীতি ও ঘুষ লেনদেনের ঘটনা ঘটে। সাধারণত তদবির ও নিয়মবহির্ভূত অর্থের মাধ্যমে বদলি বা পছন্দনীয় স্থানে থেকে যান শিক্ষক-কর্মকর্তারা।
পৃথিবীর সবদেশেই কম-বেশি দুর্নীতি আছে, ঘুষের রেওয়াজ আছে। এই কথাটির আপেক্ষিক সত্যতা মেনে নিয়েও, বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থায় দুর্নীতির ব্যাপকতাকে অস্বীকার করার কোনো অজুহাত নেই। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে যে, এই দুর্নীতি জনগণের মনে ব্যাপক হতাশাবোধের জন্ম দিয়েছে। এই হতাশাবোধ দূর করতে হবে। বিশেষ করে শিক্ষাখাতের নিচ মহল থেকে উপর মহল পর্যন্ত যেভাবে ঘুষ গ্রহণ চলে তা কোনো ভাবেই মেনে নেয়া যায় না। শিক্ষা বোর্ডের স্বয়ং চেয়ারম্যান-সচিব যদি দুর্নীতিবাজ হিসেবে চিহ্নিত হন তাহলে ছাত্র-ছাত্রীরা শিক্ষা নেবে কার কাছে? এ ধরনের অনৈতিক কাজের সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে কঠোর শাস্তির বিধান ও সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া জরুরি হয়ে পরেছে।
লেখক : মীর আব্দুল আলীম, সাংবাদিক, কলামিস্ট ও সমাজ গবেষক। ব-সধরষ-হবংিংঃড়ৎবসরৎ@মসধরষ.পড়স