বুধবার, ২৭ নভেম্বর, ২০২৪  |   ১৯ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জে সংবাদকর্মীর কন্যাকে অপহরণ চেষ্টায় অভিযুক্তদের অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবি ফরিদগঞ্জ প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন সংগঠনের
  •   লক্ষ্মীপুরে মাদকসহ বাবা ও দুই ছেলে আটক
  •   চাঁদপুর সদর মডেল থানা পুলিশের অভিযানে বিভিন্ন মামলার ৮ আসামী আটক
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার

প্রকাশ : ০১ ডিসেম্বর ২০২১, ০০:০০

সড়ক কি কখনোই নিরাপদ হবে না?

মীর আব্দুল আলীম

সড়ক কি কখনোই নিরাপদ হবে না?
অনলাইন ডেস্ক

সড়ক দুর্ঘটনা একটি গুরুতর জাতীয় সমস্যায় পরিণত হয়েছে। সংবাদমাধ্যমে প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির খবর প্রকাশিত হয়। বিষয়টি গভীর শঙ্কার ও উদ্বেগজনক। গুরুতর এই জাতীয় সমস্যাটি সরকারি কর্তৃপক্ষগুলোর কাছে যথেষ্ট গুরুত্ব পায় না; যেন ধরেই নেওয়া হয়েছে যে, সড়ক-মহাসড়কে মানুষের মৃত্যু প্রতিনিয়তই ঘটবে, কারোর কিছু করার নেই।

সড়ক নিরাপদ করতে আইন হয়েছে। ভেবেছিলাম সড়ক এবার হয়তো নিরাপদ হবে। সড়ক নিরাপদ হয়নি। আরও অনিরাপদ হয়েছে। প্রতিদিন সড়কে মূল্যবান প্রাণ যাচ্ছে। রাজীবের হাত যাচ্ছে, কারো পা যাচ্ছে, মাথা যাচ্ছে, মিশুক-মনির, সাইফুর রহমানদের জীবন যাচ্ছে। থামছে না সড়কে মৃত্যু মিছিল। আমরা বিশেষ দু’একজনের জন্য আহ্ উহ্ করি। প্রতিদিন কত খালিদ, কত হৃদয় পঙ্গু হচ্ছে, জীবন দিচ্ছে তার খোঁজ কি রাখি? আমরা কেন মৃত্যুর মিছিল রোধ করছি না? কেবল আলোচিত ঘটনায় মন্ত্রী, এমপিরা ছুটে যায় স্বজন কিংবা লাশের পাশে। আমরা মায়া কান্না করি; লাভ কি তাতে?

সড়ক নিরাপদ করতে নয়া আইন হয়েছে। তা বাস্তবায়ন শুরু হয় ১ নভেম্বর ২০১৯ থেকে। শুরুতে তর্জন গর্জন শুনেছি। ভালো লেগেছে। পরে দেখলাম শ্রমিক নেতাদের দেনদরবারে হঠাৎ থমকে গেছে সরকার ও প্রশাসনের আইন প্রয়োগের কার্যক্রম। সড়ক নিয়ে আন্দোলনে নামা নিরাপদ সড়ক চাই-এর প্রতিষ্ঠাতা ইলিয়াস কাঞ্চন উল্টো শাহজাহান খানের হুমকির মুখে পড়েন। থমকে গেছে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনও। তাই রাস্তায় আগের চেয়ে বেপরোয়া চালক। যা হবার তা-ই হচ্ছে সড়কে। উচ্চ আদালত ফিটনেসবিহীন গাড়ি সড়কে না চলতে নির্দেশনা দিয়েছে। কিন্তু ফিটনেসবিহীন গাড়ি এখনও সড়কে চলছে। সরকার নমনীয় হলে কিংবা আইনের প্রয়োগ না হলে সড়কে মানুষ তো মরবেই। উচ্চ আদালত ফিটনেসবিহীন গাড়িতে জ্বালানি সরবরাহ না করতে নির্দেশনা দিয়েছেন। জ্বালানি পাম্পগুলোতে সাইনবোর্ডও লাগিয়ে দেয়া হয়েছে, ‘ফিটনেস ছাড়া জ্বালানি সরবরাহ করা হয় না।’ অথচ, সে নির্দেশও এখন অকার্যকর।

আমাদের কত কিছুর জন্যই তো আইন আছে, প্রয়োগ হয় ক’টা? এদেশে কঠোর খাদ্য আইন আছে, তবুও প্রায় সব খাবারেই বিষ মিশানো থাকে। নারীর প্রতি সহিংসতাবিরোধী আইন আছে, কিন্তু এদেশের নারীরা কতটা নিরাপদ। ধর্ষিত হয়ে, খুন হয়ে যাবার পর নুসরাতের মতো ক’টা ঘটনার বিচার হয় এদেশে? সড়ক আইন ছিলো আগেও, এখনও আছে। প্রয়োগ হয় কি তা? নয়া আইনের প্রয়োগ নিয়েও মনে প্রশ্ন উঁকিঝুঁকি মারে। তবুও আশা করতে দোষ কোথায়? সড়কে সড়কে ফ্লাইওভার, মেট্রো রেল, স্বপ্নের পদ্মা সেতু সবইতো দেখছি। বয়স্ক মানুষ, দরিদ্র মানুষ ভাতা পাচ্ছে। একদিন আমরা দেশের সকল নাগরিকরা হয়তো ভাতার আওতায় আসবো। ফ্রি চিকিৎসা পাব। এমন স্বপ্ন এখন দেখতে পারি। ভাবি সব কিছুইতো হচ্ছে। কিন্তু সড়ক কি আদৌ নিরাপদ হবে কখনো? আমাদের বিশ্বাস, সড়ক ঠিকই নিরাপদ হবে। কিছু কিছু ঘটনায় দেখেছি, প্রধানমন্ত্রী নাড়া দিলে সব নড়েচড়ে ওঠে। তিনি দৃষ্টি দিলে সব সহজে হয়ে যায়। এখানেও তিনি যদি নজর দেন, তাহলেই হয়তো সব ঠিক হতে পারে, নিরাপদ হতে পারে সড়ক।

এদেশে সড়ক দুর্ঘটনা হলো ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মৃত্যুদূতের মতো। ঘর থেকে বের হয়ে আবার ঘরে ফেরা যাবে কি? এমন সংশয় বরাবরই থেকে যায়। এ প্রশ্নের ইতিবাচক জবাব পাওয়াও কঠিন বাংলাদেশে। তাই প্রতিদিন গণমাধ্যমে আমরা দেখতে পাচ্ছি সড়ক দুর্ঘটনার অসংখ্য বীভৎস ছবি, দেখতে পাই স্বজন হারানোদের আহাজারি। আমাদের সড়ক যেন এখন মরণফাঁদ। এমন কোনো দিন নেই, যেদিন অকালে প্রাণ ঝরছে না, প্রিয়জন হারানোর বেদনায় বাতাস ভারী হয়ে উঠছে না। দেশে যেভাবে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েছে, তাতে নিরাপদ সড়ক বলে আর কিছু নেই। এ অবস্থায় আজকাল আর কেউ ঘর থেকে বের হলে পৈত্রিক প্রাণটা নিয়ে ফের ঘরে ফিরতে পারবেন কিনা সে নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না। বিগত এরশাদ সরকারের আমলে সড়ক দুর্ঘটনা অস্বাভাবিক বেড়ে গেলে সরকার দুর্ঘটনা সংঘটনকারী গাড়ির চালকের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন করে। কিন্তু পরিবহন শ্রমিকদের আন্দোলনের মুখে পড়ে তা রহিত করতে বাধ্য হয় সরকার। এরপর থেকে বিভিন্ন সরকারকে পরিবহন শ্রমিকদের দাবি দাওয়ার কাছে প্রায় জিম্মি থাকতে দেখা যাচ্ছে। এভাবে দুর্ঘটনা সংঘটনকারী চালকদের শাস্তি না হওয়া, ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন, লাইসেন্সবিহীন ও অদক্ষ চালক কর্তৃক গাড়ি চালানো, আনফিট গাড়ি রাস্তায় চালানো, সড়ক যোগাযোগে অব্যবস্থাপনা ইত্যাদি কারণে ইদানীং সড়ক দুর্ঘটনা মারাত্মক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। দুর্ঘটনার সাথে জড়িত চালকদের বিচারের কাঠগড়ায় নিয়ে আসার ঘটনা এদেশে বিরল। দেখা গেছে, প্রায় সব ক’টি দুর্ঘটনার ক্ষেত্রেই চালকরা পার পেয়ে গেছে। কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থাই নেয়া হয়নি তাদের বিরুদ্ধে।

এদেশে সড়ক দুর্ঘটনা স্বাভাবিক এবং প্রাকৃতিক নয়, তা হচ্ছে মানবসৃষ্ট কারণে। এই হিসেবে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতরা পরোক্ষভাবে হত্যারই শিকার। কিন্তু হত্যাকারীদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনার কাক্সিক্ষত উদ্যোগ নেই। ফলে সড়ক দুর্ঘটনা না কমে জ্যামিতিক হারে বেড়েই চলেছে। সরকারি হিসেবে গত ১০ বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ মারা গেছে ৩৪ হাজার ৯১৮ জন। প্রতি বছর মারা যায় ৩ হাজার ৪৯১ জন। থানায় মামলা হয়েছে এমন দুর্ঘটনার হিসাব নিয়ে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে দায়িত্বশীলদের তরফে। বেসরকারি হিসেবে প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে ২০ হাজার ৩৪ জন। প্রতিদিন গড়ে মারা যাচ্ছে প্রায় ৫৫ জন। সরকারি তথ্য ও বেসরকারিভাবে প্রাপ্ত তথ্যের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান থাকার কারণ হলো, দুর্ঘটনার পর সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের ৬৭ ধরনের প্রশ্নের উত্তর সংগ্রহ করে প্রতিবেদন জমা দিতে হয়। এ ঝামেলার কারণে অনেক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর বিষয়টি যথাযথভাবে রেকর্ডভুক্ত হয় না। প্রকাশিত এক আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এশিয়া, ইউরোপ এবং অস্ট্রেলিয়ার ১৫টি দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার নেপালে, দ্বিতীয় বাংলাদেশে। সবচেয়ে কম হার যুক্তরাজ্যে। এ পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রতি ১০ হাজার নিবন্ধিত যানবাহনের দুর্ঘটনায় নেপালে মারা যায় ৬৩ জন এবং বাংলাদেশে ৬০ জন। যুক্তরাজ্যে এ হার মাত্র ১ দশমিক ৪ শতাংশ।

সড়ক দুর্ঘটনাজনিত ক্ষয়ক্ষতির সাম্প্রতিক এক গবেষণা তথ্যে দেখা যায়, সড়ক দুর্ঘটনায় ফি বছর ৭ হাজার কোটি টাকারও বেশি সম্পদহানি হয়। এই হার দেশজ উৎপাদন (জিডিপি)-এর ১ দশমিক ৯৫ শতাংশের সমান। বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির হার উন্নত দেশগুলোর তুলনায় শতকরা ৫০ ভাগ বেশি। অন্য এক গবেষণা জরিপ থেকে জানা যায়, ৪৮ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনার জন্যে দায়ী যাত্রীবাহী বাস, ৩৭ শতাংশ দায়ী ট্রাক। দেশে সন্ত্রাস দমনে যদি বিশেষ বাহিনী গঠন করা যায়, তাহলে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে এ জাতীয় বাহিনী গঠন করা হচ্ছে না কেন? জানমাল রক্ষা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। আইন না মানাই হচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম মূল কারণ। সবাইকে আইন মানতে বাধ্য করতে হবে। দুর্ঘটনার অন্যতম কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে ১. ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, ২. গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ফোন ব্যবহার, ৩. অতিরিক্ত যাত্রী এবং পণ্য পরিবহন, ৪. ট্রাফিক আইন না মানা, ৫. সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বে অবহেলা, ৬. চালকদের বেপরোয়া মনোভাব, অদক্ষতা ও অসতর্কতা এবং ৭. অরক্ষিত রেললাইন।

যে কোনো মৃত্যুই দুঃখজনক। মৃত্যু যদি অকাল ও আকস্মিক হয় তবে তা মেনে নেয়া আরো কঠিন। প্রতিনিয়ত সড়ক দুর্ঘটনার কবলে পড়ে একের পর এক অকালমৃত্যু আমাদের শুধু প্রত্যক্ষই করতে হচ্ছে না, এই দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে এক বিভীষিকাময় ও অরাজক পরিস্থিতিও মোকাবিলা করতে হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সবার প্রচেষ্টায় এই উদ্বেগজনক পরিস্থিতির নিরসন করতেই হবে। এভাবে চলতে পারে না। এভাবে মানুষের জীবনপ্রদীপ নিভে যেতে পারে না। পঙ্গুত্বের মতো দুর্বিষহ যন্ত্রণা নিয়ে মানুষ জীবন কাটাতে পারে না। কারণগুলো যেহেতু চিহ্নিত, সেহেতু সড়ক দুর্ঘটনা রোধে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা দুরূহ হবে কেন?

দুর্ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটছে, ঘটবেও। কেন তা রোধ করা যাচ্ছে না? আইনের সঠিক প্রয়োগ না থাকায় দেশে দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। আমরা সড়ক নিরাপত্তায় সরকারের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার বাস্তবায়ন দেখতে চাই। সড়কে মৃত্যুর মিছিল আর যেন দীর্ঘ না হয়। সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় সব রকম ব্যবস্থা নিতে হবে। দায়ীদের উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করার পাশাপাশি নিরাপদ চলাচলের বিষয়টি পরিবহণ সংশ্লিষ্ট সবার উপলব্ধিতে আনতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে এক বিভীষিকাময় ও অরাজক পরিস্থিতিও মোকাবিলা করতে হচ্ছে, যা আমাদের কারও কাছেই কাম্য নয়। আমরা সড়ক দুর্ঘটনা রোধে পরিবহণ মালিক ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছ থেকে সমন্বিত আন্তরিক, সচেতন, দৃঢ় ও দায়িত্বশীল ভূমিকা আশা করি।

লেখক : মীর আব্দুল আলীম, সাংবাদিক, কলামিস্ট ও সমাজ গবেষক।

[email protected]

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়