প্রকাশ : ০৩ জুলাই ২০২১, ০০:০০
পর্ব-১৬
পরীক্ষায় নকল প্রতিরোধকে কেন্দ্র করে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সাথে চাঁদপুর শহরের কলেজগুলোর শিক্ষকদের একটি আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠে। মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা তাদের পাবলিক রিলেশন যত বাড়াবেন ততই তারা মাঠ থেকে কাজ তুলে আনতে পারবেন। নকল প্রতিরোধ করতে গিয়ে সেটা প্রমাণিত হয়েছে। এই নকল প্রতিরোধে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে চাঁদপুর শহরের তিনটি কলেজের অধ্যাপকগণ। তবে নকল প্রতিরোধ করতে গিয়ে উপজেলা পর্যায়ের কলেজ শিক্ষকদের রোষানলে পড়তে হয়েছে বারবার। যদিও তারা প্রকাশ্যে বলেন নি, তবে তারা যে এতে সন্তুষ্ট ছিলেন না সেটা বোঝা গেছে।
আমার বারবারই একটা জিনিস মনে হতো, শিক্ষক কেন নকলের সাথে জড়িত হয়ে পড়বেন। যদি আপনি শিক্ষকতা করেন তবে ১০০% শিক্ষক হোন। এখানে ৯৯% শিক্ষক হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। শিক্ষক হবেন ছাত্রদের কাছে আইকন। আর যদি মনে করেন শিক্ষকতার মর্যাদা ধরে রাখতে পারবেন না, আপনার অনেক অর্থের প্রয়োজন, তবে আপনি অন্য পেশা বেছে নিতে পারেন। যেখানে অঢেল অর্থের যোগান রয়েছে। এ কথাগুলো আমি বিভিন্ন কেন্দ্রে গিয়ে বলেছিও। নকল প্রতিরোধ করতে গিয়ে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সমস্যায়ও পড়েছি। জেলা প্রশাসন থেকে আমার ওপর আদেশ জারি হলো, আমি যেন একা শহরের বাইরে না যাই। যে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা এড়ানোর জন্যে আমাকে সেটাই করতে হয়েছে। এছাড়া নানা রকম বিড়ম্বনাতো আছেই।
এসএসসি পরীক্ষায় ডিউটি করতে গিয়ে হাজীগঞ্জ বালিকা বিদ্যালয়ে বিচিত্র অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছি। সে অভিজ্ঞতাটা একটু শেয়ার করি। সহকারী কমিশনার (শিক্ষা) জনাব আনোয়ার হোসেন চৌধুরী (বর্তমানে অতিরিক্ত সচিব) আমাকে ড্রপ দিয়ে গেলেন হাজীগঞ্জ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে। তিনি চলে গেলেন পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে। পরীক্ষা ছিল অংকের। পরীক্ষা শুরু হলে দেখলাম কেন্দ্রের ভেতর মাঠের মাঝে ৩/৪ জন লোক চেয়ার নিয়ে বসে আছেন। তাদের মধ্যে একজন উপজেলা নির্বাহী অফিসার অপর দু’জন একটি রাজনৈতিক দলের নেতা। দোতলায় দেখলাম ছাত্রীরা নকল করছে। চারজনকে হাতেনাতে ধরে বহিষ্কারের জন্যে প্রধান শিক্ষকের নিকট পাঠালাম। এর কিছুক্ষণ পরই একজন পিয়ন এসে খবর দিলেন আপনাকে ডাকছে। বল্লাম, কে? সে বল্লো, ইউএনও সাহেব। আমি বল্লাম, আসছি আপনি গিয়ে বলেন। মাঠের মাঝখানে তারা ডাবের পানি এবং মাঠা খাচ্ছেন। আমাকেও খাওয়ার জন্যে বল্লেন। আমাদের প্রতি নির্দেশ ছিল কেন্দ্রে গিয়ে আমরা যেন কিছু না খাই। এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করলাম। এতেই তারা ক্ষিপ্ত হলেন। এর মধ্যেই একজন নেতা দোতলায় উঠে এসে ইউএনও-এর সামনে এক প্রকার জোর করেই নিচে নামিয়ে আনলেন। আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো প্রধান শিক্ষিকার রুমে। প্রধান শিক্ষিকাতো একচোট নিলেন আমাকে। দুজন নেতা এসেও আমাকে ধমকালেন ইউএনও-এর সামনে। আমি খুব অসহায় বোধ করলাম। কারণ ইউএনও অন্তত আমাকে সহায়তা করার কথা। কারণ, আমি জেলা প্রশাসকের প্রতিনিধি হিসেবে সেখানে গিয়েছি। সেই সহায়তাটুকুও পেলাম না।
আমাকে এবার ভয় দেখানো শুরু করলো কেন্দ্রের বাইরে হাজার হাজার মানুষ আপনাকে মেরে ফেলবে। পরিস্থিতি তাদের অনুকূলে নেয়ার জন্যে কিছু আপত্তিকর কথাও বল্লেন। যেগুলোর জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। কুমিল্লা বোর্ডের প্রতিনিধি হিসেবে সেখানে দুজন অধ্যাপকও ছিলেন। তারাও নিরূপায়। তাদের সামনেই ঘটনাগুলো ঘটে যাচ্ছে। ইউএনও সাহেব আমাকে রেখে চলে গেলেন। আমি প্রধান শিক্ষিকার রুমে বন্দী। এবার আমার ওপর চাপ দেয়া শুরু হলো চারজন ছাত্রীর বহিষ্কার প্রত্যাহার করতে হবে। কিন্তু আমি নাছোড়বান্দা। হবে না। এবার ভয় দেখানো শুরু করলো। এদিকে পরীক্ষা শেষের ঘন্টা পড়লো। সব উত্তরপত্র চলে এসেছে। কিন্তু একটি কক্ষের উত্তরপত্র এখনো আসেনি। পরীক্ষা শেষ হওয়ার ৩০ মিনিট পর সে কক্ষের উত্তরপত্র আনা হলো। কারণ সে কক্ষে দুই নেতার মেয়ে পরীক্ষা দেয়।
আমি যখন বহিষ্কার প্রত্যাহারে রাজি হলাম না তখন প্রধান শিক্ষিকা ও ঐ দুই নেতা আমাকে ভয় দেখানো শুরু করলেন, আপনি যদি বহিষ্কার প্রত্যাহার না করেন তবে আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হবে আপনি ছাত্রদের গায়ে হাত দিয়েছেন। সেই আদিম বর্বর অভিযোগ। আমি অপ্রস্তুত এবং লজ্জা পেলাম। শেষ পর্যন্ত আমার অবস্থানে আমি অনড় রইলাম। তখন মোবাইল ফোন ছিল না যে, আমি জেলা প্রশাসক বা অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের সাথে যোগাযোগ করবো। পরীক্ষা শেষে আনোয়ার হোসেন চৌধুরী অন্য কেন্দ্র থেকে এসে উদ্ধার করে চাঁদপুর নিয়ে আসলেন। বিষয়টি বিস্তারিত লিখে আমি জেলা প্রশাসককে জানালাম। জেলা প্রশাসক প্রচ- ক্ষুব্ধ হলেন। তিনি ইউএনওকে তলব করলেন এবং ঘটনা জানতে চাইলেন। ইউএনও সাহেব আসল ঘটনা এড়িয়ে গেলেন। আমার ওপর দোষ চাপাতে চাইলেন। জেলা প্রশাসক অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে তদন্তের দায়িত্ব দিলেন। এখন আমার দায়িত্ব হলো, আমি যা লিখেছি তা প্রমাণ করতে হবে। কিন্তু কেন্দ্রের কেউতো আমার পক্ষে সত্য বলবে না। কিন্তু সত্যের জন্যে সেটা অবশ্যম্ভাবী। ঐ যে কুমিল্লা বোর্ডের দুজন প্রতিনিধি কেন্দ্রের দায়িত্বে ছিলেন তারা পুরো বিষয় দেখেছেন। তাঁরা হলেন চাঁদপুর সরকারি কলেজের অধ্যাপক। তাঁরা দুইজনই স্পষ্ট করে লিখে দিলেন আমার বর্ণিত ঘটনা সত্য।
এতে করে ইউএনও সাহেব ফেঁসে গেলেন। জেলা প্রশাসক সাহেব ক্ষুব্ধ হলেন এবং তাকে তিরস্কার করলেন প্রকাশ্য মিটিংয়ে। বল্লেন ‘আমার প্রতিনিধি কেন্দ্রে লাঞ্ছিত হয়, আর তুমি মাঠে বসে মাঠা খাও। আমি তোমার বিরুদ্ধে লিখবো। আবেদন দিয়ে চলে যাও।’ পরদিনই প্রথম আলোতে বিষয়টি ছাপা হয়েছে। ফলস্বরূপ কেন্দ্র সচিব প্রধান শিক্ষককে প্রত্যাহার করা হয়েছে এবং তিন বছরের জন্যে কেন্দ্র বাতিল করা হয়েছে।
নকল প্রতিরোধ করতে গিয়ে এমন বহু বিচ্ছিন্ন ঘটনা দেখেছি। সারা জেলায় নকল প্রতিরোধ করার কারণে এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষার রেজাল্টে ধস নেমেছে। কোনো কলেজেই পাসের হার ১২%-এর ওপর যায়নি। সারা জেলাতো বটেই, নিজ কলেজের কোনো কোনো শিক্ষক দ্বারাও আমি সমালোচিত হয়েছি। তারা বলেছেন, এগুলো করে কী লাভ। ছাত্র-ছাত্রীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাদেরকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি, এভাবে একটি প্রজন্ম ধ্বংস হতে দেয়া যায় না। নকল করে হয়তো সার্টিফিকেট পাওয়া যাবে, কিন্তু বাস্তব জীবনে সে কিছুই করতে পারবে না। জেলার বিভিন্ন অধ্যক্ষ আমার কলেজের অধ্যক্ষের নিকট অভিযোগ দিতে থাকেন। আমাকে যেন আর ভিজিল্যান্স ডিউটিতে পাঠানো না হয়। কিন্তু জেলা প্রশাসক মহোদয় চিঠি দিয়ে আমাদেরকে টিমে নিয়ে যান। সেখানে আমার অধ্যক্ষেরও কিছু করার নেই। পাবলিক পরীক্ষায় প্রশাসন যেভাবে চাইবে সেটাই করতে হবে।
কুমিল্লা বোর্ড সিদ্ধান্ত নিলো যারা নকল রোধে অবদান রাখবেন তাদের পুরস্কার দেয়া হবে। পুরস্কারের তালিকায় স্থান পেলেন তৎকালীন এনডিসি জনাব এটিএম নাছির মিয়া এবং মতলব ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ। জনাব নাছির মিয়া নকল প্রতিরোধ করতে গিয়ে ছাত্রদের দ্বারা লাঞ্ছিত হয়েছেন, সে কারণে তিনি তালিকায় স্থান পেয়েছেন। কিন্তু মতলব ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষকে কোন্ ক্রাইটেরিয়ায় দেয়া হলো সেটা নিয়ে বিতর্ক ছিল। বলা হলো তিনি নকল প্রতিরোধ করতে গেলে তার কলেজে ছাত্ররা আগুন দিয়েছে। কথাটা একেবারেই সত্য নয়। আসল ঘটনা হলো, ঐ কলেজ নকলের সুযোগ দিবে বলে প্রবেশপত্র দেয়ার সময় মোটা অংকের টাকা নেয়া হয়েছে প্রতি ছাত্রের কাছ থেকে। কিন্তু প্রথমদিনই নকলের সুযোগ না পেয়ে অধ্যক্ষের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে ছাত্ররা কলেজের টিনশেড ভবনে আগুন দিয়েছে।
সে সময়ে একটি বিষয় পরিষ্কার ছিল যে, ছাত্রদের নকল সরবরাহ করে নিজ প্রতিষ্ঠানে পাসের হার বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় অধিকাংশ শিক্ষক সম্পৃক্ত রয়েছেন। অধ্যক্ষরা বলতেন, পাসের হার বেশি না হলে এমপিও বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু সেটাও ছিল তাদের অজুহাত। কারণ পাসের হার কম থাকার কারণে কোনো প্রতিষ্ঠানে এমপিও বন্ধ হওয়ার নজির নেই। আসলে সবকিছুর মূলেই ছিল অর্থ। যত বেশি ফরম ফিলাপ তত বেশি টাকা, যত বেশি পরীক্ষার্থী তত বেশি টাকা।
চাঁদপুরের একটি কলেজতো নকলের যতরকম কৌশল আছে তা প্রয়োগ করে পাসের হার সেরা করার প্রতিযোগিতায় নেমেছিল। সফলও হয়েছে ক’বছর। তাদের কৌশলগুলো এতটাই অভিনব ছিল যে, ধরার কোনো উপায় ছিল না। সবাই জানতো সে কলেজটি জেলার শ্রেষ্ঠ কলেজ হয়েছে নকলের অভিনব পদ্ধতির মাধ্যমে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, ফলাফল প্রকাশ হলে আমাদের সাংবাদিক বন্ধুরাও সে কলেজকে হাইলাইট করতেন। তারাও জানতেন কীভাবে ফলাফল ভালো করে। শোনা যেত সেখানেও অর্থের লেনদেন হতো। সেটাও ছিল কর্পোরেট। যেভাবে নকলের বিস্তার ঘটেছে তা শুধুমাত্র ভিজিল্যান্স টিম দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা দুরূহ হয়ে পড়েছে। প্রশাসন সে বিষয়ে উদ্যোগ নিলো। কিভাবে ছাত্রদের পড়ার টেবিলে ফিরিয়ে আনা যায় সে পদক্ষেপও নিয়েছিলো। কিন্তু সেটা তেমন ফলপ্রসূ হয়নি।
এর পরের বছরই আমি ভূগোল বিষয়ের প্রধান পরীক্ষক। আমার কাছে এক বান্ডেল খাতা আসলো। খাতা দেখেতো আমি হতবাক। ৭ জন ছাত্রের খাতা হুবহু একই রকম। ৭৫ নাম্বারের মধ্যে প্রতিজন পেয়েছে ৭২ থেকে ৭৩ নাম্বার। কীভাবে সম্ভব! আমি খাতাগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম। অনিয়ম যে হয়েছে তা আবিষ্কারও করে ফেল্লাম। খাতাগুলো যে বাইরে থেকে লিখে সাপ্লাই করেছে, লুজ শীট বাইরে থেকে লিখে এনে জুড়ে দিয়েছে সেটা সন্দেহাতীতভাবে নিশ্চিত হলাম। আমি প্রতিটি খাতার অসঙ্গতিগুলো এক এক করে বোর্ডে রিপোর্ট করে দিলাম। বোর্ডও খাতাগুলো দেখে নিশ্চিত হলেন অনিয়ম হয়েছে। ওএমআর সিস্টেম হওয়ার কারণে আমার বোঝার কোনো উপায় ছিল না খাতাগুলো কোন্ কেন্দ্রের। ৭ জন ছাত্রের রেজাল্ট স্থগিত করা হলো। রেজাল্ট দেয়ার পর জানা গেলো, এই ৭জন ছাত্রই একই কলেজের চাঁদপুরের তথাকথিত ভালো ফলাফল করা কলেজটির।
এই ছাত্রগুলোর পক্ষে বিভিন্ন জায়গা থেকে তদবির আসা শুরু করলো বোর্ডের চেয়ারম্যানের কাছে যেন তাদের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করা হয়। কিন্তু চেয়ারম্যান অনড় ছিলেন। ছাত্রদের আর্বিট্রেশন বোর্ডে ডাকা হলো। তাদেরকে জিজ্ঞেস করা হলো অনিয়ম সম্পর্কে। তারা লিখিত জবাব দিল যে, কলেজ কর্তৃপক্ষ তাদেরকে আগেরদিন খাতা দিয়ে দিয়েছে এবং লুজশীট দিয়ে দিয়েছে। পরীক্ষার দিন খাতা চেঞ্জ করে জমা দিয়েছে। স্বীকার করাতে তাদের শাস্তি কমিয়ে দু বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে। পরবর্তীতে বোর্ড সে কলেজের কেন্দ্র বাতিল করেছে। (চলবে)