প্রকাশ : ০২ জুলাই ২০২১, ০০:০০
বিম্বিত বীক্ষণ
অধ্যক্ষ রতন কুমার মজুমদার
পর্ব-১৫
|আরো খবর
উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষে চলে আসলো ডিগ্রি পরীক্ষা। সময়কাল ২০০০ সাল। সারা চাঁদপুরে একটা আলোড়ন হয়েছে। নকলের বিরুদ্ধে প্রশাসন জিহাদ ঘোষণা করেছে। এতে করে কেন্দ্রগুলোর স্বার্থের ব্যাঘাত ঘটেছে। যেখানে দলে দলে আশপাশের জেলাগুলো থেকে ছাত্ররা এসে এখানে পরীক্ষা দিতো তাতে কিছুটা ভাটা পড়েছে। কেন্দ্রগুলোর ইনকামও কমে গেছে। তখনকার সময়ে পরীক্ষার আগের দিনও বিশেষ ব্যবস্থায় ফরম পূরণ করার ব্যবস্থা ছিলো।
সবচেয়ে ভয়ানক যে জিনিসটা উদ্ঘাটিত হয়েছে, এই সমস্ত প্রক্রিয়ার সাথে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের কিছু অসাধু কর্মচারী জড়িত ছিলো। তারা অর্থের বিনিময়ে সকল অবৈধ কাজকে বৈধ করে দিতো। এ সমস্ত অপকর্মের সাথে যেমন কিছু কর্মচারী জড়িত ছিলো, তেমনি জড়িত ছিলো কেন্দ্রের কিছু শিক্ষক। তারা বোর্ড ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবৈধভাবে কিছু অতিরিক্ত উত্তরপত্র নিয়ে আসতো। যেগুলো অর্থের বিনিময়ে অবৈধ কাজে ব্যবহৃত হতো। যে কেন্দ্রেই আমরা ভিজিল্যান্স টীমের সদস্য হিসেবে যেতাম সেখানেই কেন্দ্রের শিক্ষকরা আমাদেরকে পাহারা দিতেন এবং ছাত্রদের নকলে সহযোগিতা করতেন।
ডিগ্রি প্রথম পরীক্ষায় গেলাম কচুয়া কেন্দ্রে। ২২০০ পরীক্ষার্থী। পরীক্ষা নয় যেনো হাট বসেছে। মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সিরাজুল ইসলাম, আমি, অধ্যাপক অসিত বরণ দাশ (বর্তমানে চাঁদপুর সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ) এবং অধ্যাপক শায়লা নাছরিন (যিনি বর্তমানে বদরুন্নেছা কলেজের উপাধ্যক্ষ) কেন্দ্রে গিয়ে দেখি, প্রতিটি রুমে আলোর স্বল্পতা। পরীক্ষা শুরু হতেই আর দেরি নেই। প্রায় ৯৮% পরীক্ষার্থী নকল করা শুরু করলো। যারাই নজরে এসেছে তাদেরকেই বহিষ্কারের আদেশ দেয়া হয়েছে। পরীক্ষা শেষের দিকে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সিরাজুল ইসলাম স্যার খবর পেলেন কেন্দ্রের বাইরে ক’জন ছাত্র পাশের বাড়িতে পরীক্ষা দিচ্ছে। পুলিশ নিয়ে স্যার সে বাড়িতে যেতেই টের পেয়ে সবাই দৌড়ে পালালো। পরীক্ষা শেষে দেখা গেলো, প্রায় ১৪৫ জন ছাত্র বহিষ্কার হয়েছে। বৃষ্টিও কমেছে। কলেজ থেকে বের হওয়ার পথেই ছাত্ররা জড়ো হয়েছে। পুলিশ ডাকা হলো। সিরাজ স্যার যেহেতু কচুয়াতে একসময় ইউএনও-এর দায়িত্ব পালন করেছেন সেহেতু তিনি অনেককেই চিনতেন। তিনি কয়েকজনকে ডেকে এনে বল্লেন, কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলে এর দায়দায়িত্ব আপনাদের এবং কেন্দ্রকে নিতে হবে। আগামী পরীক্ষা থেকে কেন্দ্র আর এখানে থাকবে না। এতে কাজ হলো। রাস্তার ভীড় কমে গেল। আমরা গাড়ি নিয়ে বের হয়ে আসলাম।
প্রতিদিন ভিজিল্যান্স টীমের সদস্যদের ডিসি-এর বাংলোতে সন্ধ্যায় ফলোআপ মিটিং হতো। পরদিনের কাজ নিয়ে কৌশল নির্ধারণ করা হতো। মতলব, কচুয়া এবং ফরিদগঞ্জ ছিলো নকলের স্বর্গরাজ্য। সিদ্ধান্ত হলো পরের পরীক্ষায়ও আমরাই আবার কচুয়া যাবো। যথারীতি গেলাম। অধ্যক্ষ এবং শিক্ষকরা আমাদের দিকে কটমট করে তাকাচ্ছে। হলে ঢুকেতো অবাক হয়ে গেলাম। গত পরীক্ষায় যাদের বহিষ্কার করা হয়েছে তারা আজ আবার পরীক্ষা দিচ্ছে। বিষয়টি সিরাজ স্যারের নজরে আনলে তিনি অধ্যক্ষকে ডেকে এর কারণ জানতে চাইলেন। কিন্তু অধ্যক্ষ হাসনাত এর কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। সোর্স মারফত যে খবরটি পাওয়া গেল তা হলো যাদেরকে বহিষ্কার করা হয়েছে তাদের মধ্য থেকে প্রভাবশালীদের রাতের বেলা পরীক্ষা নিয়ে খাতা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। অধ্যক্ষকে শোকজ করা হলো। আমরা যাদের বহিষ্কার করতাম তাদের রোল নাম্বার টুকে রাখতাম। দেখলাম সেখানকার অনেকেই আবার পরীক্ষা দিচ্ছে। একবার ভেবে দেখুন, যে শিক্ষকরা নকল প্রতিরোধ করবে তারাই এ সমস্ত অবৈধ কাজে জড়িয়ে পড়ছে। পরীক্ষা ব্যবস্থা কতটা ভঙ্গুর ছিলো একবার ভেবে দেখুন।
সিদ্ধান্ত হলো যাদেরকে বহিষ্কার করা হবে তাদের তালিকা ডিসি অফিসে পাঠাতে হবে। আমরা রাতের বেলা সেগুলো যাচাই করে দেখবো ঠিক আছে কিনা। এরা আরেকটা চালাকি করতো। বহিষ্কারের মোট সংখ্যা ঠিক রাখার জন্যে পুরানো বহিষ্কারের কিছু রোল নং এর মধ্যে ঢুকিয়ে দিতো। সেটাও ধরা পড়ে গেল। কতরকম কৌশল যে এরা জানতো এখানে সব বলাও সম্ভব নয়।
পরের সপ্তাহে আমাদের ডিউটি পড়েছে ফরিদগঞ্জ। বার ছিল শনিবার। যেহেতু আমি সিরাজ স্যারের টীমের সদস্য সেহেতু স্যার ঢাকা থাকার কারণে খবর পাঠালেন সহকারী কমিশনার জনাব আনিছুর রহমান মিয়া (বর্তমানে এপিডি, অতিরিক্ত সচিব জনপ্রশাসন) সহ আমরা যাবো। স্যার ঢাকা থেকে এসে আমাদের সাথে জয়েন করবেন। সকাল বেলায়ই আনিছ ভাই, আমি এবং বেলাল হোসাইন (বর্তমানে পরিচালক মাধ্যমিক মাউশি) তিনজন চলে গেলাম ফরিদগঞ্জ কেন্দ্রে। পরীক্ষা শুরু হওয়ার পূর্বেই অধ্যক্ষ এবং শিক্ষকদের সতর্ক করে দেয়া হলো। পরীক্ষা শুরুর কিছুক্ষণ পরই নকলসহ ৮ জনকে ধরলাম। তাদেরকে পাঠিয়ে দেয়া হলো অধ্যক্ষের কাছে। অধ্যক্ষকে বলা হলো এদেরকে একটি কক্ষে আটকে রাখতে। কারণ এরা বাইরে গেলে আইন শৃঙ্খলার অবনতি হতে পারে। ইউএনও রাখাল চন্দ্র বর্মনও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। আমি দোতলায় ডিউটি করছি। এমন সময় দেখলাম সেই ৮ জন ছাত্র দোতলার সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে আসছে। বুঝলাম অধ্যক্ষ তাদেরকে ছেড়ে দিয়েছেন। তাদের দেখে আমার মনের মধ্যে সন্দেহ হলো। সবাই আমার সামনে বারান্দায়। একজন আমাকে বাইপাস করে পেছনে গেলো। আমার সন্দেহ আরো প্রকট হলো। ছিলাম সতর্ক। মুহূর্তেই দেখলাম পেছনের ছেলেটা একটি বেঞ্চের পায়া উপরে তুলে আমার মাথা বরাবর। আমি তড়িৎ হাত দিয়ে ঠেকালাম। হাত কেটে গেল। একজন শিক্ষক এসে ছেলেটিকে ধরে রুমের ভেতর নিয়ে গেলো। আমি এক দৌড়ে একলাফে সিঁড়ি দিয়ে নেমে অধ্যক্ষের রুমে। কলাপসিবল গেট আটকে দিলাম। ইউএনও এবং আনিস ভাই দৌড়ে উপরে গেলেন। ছাত্ররা উপর থেকে বেঞ্চ ছোড়া শুরু করলো। পুলিশ খবর দেয়া হলো। পুলিশ এসে নিয়ন্ত্রণ করলো।
তড়িৎ এ খবর পৌঁছে গেল জেলা প্রশাসকের কাছে। তিনি ইউএনওকে বল্লেন, আসামী ধরে তারপর কথা বলার জন্যে। আমি হাত দিয়ে না ঠেকালে বেঞ্চের পায়ার বাড়িটা আমার মাথায়ই পড়তো। হাতের অনেক দূর কেটে গেছে। আমাকে ইউএনও অফিসে নিয়ে আসা হলো। হাতে স্টিচ দেয়া হলো। মামলা হলো। সন্ধ্যার দিকে পুলিশ স্কট দিয়ে আমাদের চাঁদপুর পৌছে দিলো। জেলা প্রশাসনের সকল কর্মকর্তা আমাকে সান্ত্বনা দিলেন। এটি বিনা পানিশমেন্টে ছাড়া হবে না। সেদিন রাতেই এই আটজনের বাড়িতে পুলিশ হানা দিলো। সবাই পলাতক। একজন ধরা পড়লো। পরের পরীক্ষায় আবার পুলিশ স্কট সহ সিরাজ স্যার আমাদের ১০ জনের টীম নিয়ে গেলেন ফরিদগঞ্জ। আমি, অধ্যাপক বিভূতি নারায়ণ দাশ (আমেরিকা প্রবাসী), উমেশ চন্দ্র লোধ ( রামগঞ্জ কলেজের অধ্যক্ষ), বেলাল হোসাইন (পরিচালক, মাধ্যমিক), আরডিসি মাসুক মিয়া , জনাব আনিছুর রহমান মিয়া (বর্তমানে অতিরক্তি সচিব) এবং আরো কয়েকজন অধ্যাপক ।
পুরো কেন্দ্র নীরব। তারা বুঝতে পারছে আজ আর রক্ষা নেই। অভিযান চললো। কেন্দ্রে গিয়েই সিরাজ স্যার কেন্দ্রের দুই অধ্যাপককে বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। বল্লেন, এক মুহূর্ত দেরি করলে এরেস্ট করা হবে। খবর ছিলো এই দুই জন অধ্যাপকের উস্কানিতে ছাত্ররা এমনটা করেছে। সেদিনের অভিযানে আমার হাতে ১২ জন বহিষ্কার হলো।
পরদিনই যাকে গ্রেফতার করা হলো তাকে জামিন না মঞ্জুর করে জেলে পাঠানো হলো। পরদিন সকল জাতীয় এবং দৈনিক পত্রিকার হেড লাইন ছিলো বহিষ্কৃত পরীক্ষার্থী দ্বারা ভিজিল্যান্স টীমের সদস্য আহত। বাকি ৭ আসামী পলাতক। তারা প্রায় ৩ মাস বাড়িতে আসতে পারেনি। পরবর্তীতে শোনা গেলো একজন বাদে বাকি ৭ জন বিদেশে পাড়ি দিয়েছে। মামলা চলেছে দীর্ঘদিন। মামলার বাদী ছিলো অধ্যক্ষ, ফরিদগঞ্জ কলেজ। ২০০৩ সালের দিকে অনেক রাজনৈতিক নেতা আমাকে অনুরোধ করেছেন মামলায় যেনো আমি সাক্ষ্য না দেই। কিন্তু আমি সাক্ষ্য দিলাম। যে একজন ধরা পড়েছে তার শাস্তি হলো। পলাতকদেরও শাস্তি হলো। পরবর্তীতে কী হয়েছে আর খবর রাখিনি। (চলবে)