প্রকাশ : ০৪ অক্টোবর ২০২১, ০০:০০
কোনো রাজনৈতিক দলের বিকাশধারাই সরলরৈখিক নয়। সংকট আর সংঘাতের ভেতর দিয়েই বাংলাদেশের রাজনীতির বিকাশ ঘটেছে এবং ঘটবে। ভবিষ্যতের সংকটে যদি কোনো রাজনৈতিক দল ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে তাহলে সে দল অথবা জোট নতুন এক স্তরে উপনীত হবে। আর যদি সংকট নিরূপণে বা সমাধানে গ্রহণযোগ্য পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয় তাহলে আবার রাজনীতির অরণ্যে ও ‘Political Wilderness’-এ হারিয়ে যাবে।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক জোট গঠনের ইতিহাস নতুন কোনো ঘটনা নয় বরং বৃটিশ শাসনামলেই এতদঞ্চলে রাজনৈতিক জোট গঠনের সর্বপ্রথম সূত্রপাত ঘটে। তখন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এবং নিখিল-ভারত মুসলিম লীগের বৃটিশ সরকার বিরোধী বিভিন্ন উদ্যোগ ও কর্মসূচি থেকেই রাজনৈতিক জোটের আবির্ভাব ঘটে। পাকিস্তান আমলেও এ ধরনের রাজনৈতিক জোট গঠিত হয়েছে। প্রতিটি জোটেরই নিজস্ব কর্মসূচি ও আদর্শ ছিল এবং সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সাধনের নিমিত্ত গঠিত হয়েছিল। সাধারণত বহুদলীয় ব্যবস্থায় জাতীয় ক্রান্তিলগ্নে কিংবা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে মোকাবিলা করার কৌশল হিসেবে একাধিক দলের সমন্বয়ে এ জোট গড়ে উঠে। বিশেষ কোনো লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে কেন্দ্র করে জোট গঠিত হয় এবং সে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সফল বা বিফল যা-ই হোক না কেন এক সময় তা ভেঙ্গে যায়। আর রাজনৈতিক জোট হিসেবে এ দেশের রাজনৈতিক দলের বিদ্যমান জোটবদ্ধতার কথা ধরলে তারা জাতীয় স্বার্থ ও জনগণের চাওয়া-পাওয়ার সংগ্রামে কতটুকু সার্থকতা অর্জন করতে পেরেছে সচেতন মহলে তার মূল্যায়ন হচ্ছে। তাই কথা উঠছে, বিদ্যমান রাজনীতির ক্ষেত্রে ভোট শেষ জোটও শেষ। আর ৯০’র পরবর্তী সময় থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এটা হয়ে আসছে।
আমাদের দেশের প্রথম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ। যে দলটির নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়ে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেই দলটির যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৪৯ সালের জুন মাসে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের বিপরীতে আওয়ামী মুসলিম লীগ হিসেবে। তারা প্রথম বড় ধাক্কা খেয়েছিল যখন এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ১৯৫৭ সালে দল ত্যাগ করে কাগমারী সম্মেলনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করলেন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ। এই ঘটনার অব্যবহিত পরে পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করা হয়। সামরিক শাসকরা যখন বেসামারিক লেবাস পরলেন, আওয়ামী লীগের অনেক নেতা দল বেঁধে সব ‘ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (ঘউঋ)’ যা পরে ‘পাকিস্তান ডেমোক্র্যাটিক মুভমেন্ট (চউগ)’-এ চলে যান এবং আরও পরে ‘পাকিস্তান ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (চউঋ)’ তে চলে যান। বঙ্গবন্ধু ১৯৬৬ সালে ৬-দফা কর্মসূচি দিয়ে আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করেন। এর মধ্যে অবশ্য ১৯৬৫ সালে সম্মিলিত বিরোধী দল (ঈড়সনরহবফ ঙঢ়ঢ়ড়ংরঃরড়হ চধৎঃরবং-ঈঙচ) করে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। বলাবাহুল্য, আওয়ামী লীগসহ সকল বিরোধী দল তাতে পর্যুদস্ত হয়। পাঁচ বছর পর আওয়ামী লীগকে আবারো ‘ডেমোক্র্যাটিক অ্যাকশন কমিটি (উঅঈ)’ করে ‘৬৮-৬৯’- এর আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে সামিল হতে হয়। তবে উক্ত আন্দোলন সফল হওয়ার পর ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগ একাই নির্বাচন করে।
ভারতে ১৯২১ সালে কম্যুনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত হলেও আজ অব্দি তারা কেন্দ্রে ক্ষমতায় যেতে পারে নি। প্রদেশ পর্যায়ও ক্ষমতায় যেতে চুয়াল্লিশ বছর লেগেছিল। বিজেপির অবস্থা তো আরো করুণ। বৃটিশ ভারতে তার নাম ছিল হিন্দু মহাসভা, স্বাধীন ভারতে হলো জনসংঘ, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য নব্বইয়ের দশকে বিলীন হলো জনতা পার্টির মধ্যে আর বেরিয়ে আসলো বিজেপি নামে। আর বিকশিত হওয়ার জন্য ‘গবঃধসড়ৎঢ়যড়ংরং’ হতে হলো অনেকটা সুয়োপোকার প্রজাপতি হওয়ার কাহিনী, এটাও একটা রাজনীতিতে স্বীকৃত কদাচিৎ পন্থা। যেমনটা করতে চাচ্ছে আমাদের দেশের বিদ্যমান রাজনীতিতে বিএনপি।
অনেকে ভাবতে পারেন, কই কংগ্রেস, মুসলিম লীগ কিংবা আওয়ামী লীগ তো সেই পথে যেতে হলো না। সেটা খানিকটা ঠিক, তবে পুরোটা না। প্রথমতঃ এসব দলের বড় ধরনের প্রাপ্তি বা অর্জন আছে তারা এক একটি রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছে আর দ্বিতীয়তঃ ব্যর্থতার দিকটা হচ্ছে একমাত্র কংগ্রেস ছাড়া আর কোনো রাজনৈতিক দল বেশি দিন রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকতে পারে নি। যে পাকিস্তান মুসলিম লীগ সৃষ্টি করলো সেখানেই তারা ৭ বছরের মাথায় ১৯৫৪ সালে রাজনৈতিকভাবে উচ্ছেদ হলো। এরপরে আইয়ুব খান থেকে এ পর্যন্ত মুসলিম লীগ নামে যে দলগুলো আছে তার সাথে প্রকৃত মুসলিম লীগের কোনো সম্পর্ক নেই। তেমনটা আমাদের দেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের চরিত্র বা বৈশিষ্ট্য-বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগের সাথে কোনো সম্পর্ক নেই বললে অত্যুক্তি হবে না।
ভারতে কংগ্রেসের ভবিষ্যৎ তুলনামূলকভাবে ভালো ছিল। কিন্তু সেখানেও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো যখন একত্রিত হলো তখন থেকেই কংগ্রেস পরাজিত হতে থাকলো। এটা প্রথম হয়েছিল ১৯৭৭ সালে। তারপর কংগ্রেস বিরোধীদের বিভাজনের সুযোগে আবারও ক্ষমতায় আসলে নব্বইয়ের দশক থেকে জোট বা ‘ঈড়ধষরঃরড়হ’ রাজনীতি করতে বাধ্য হয়। ভোট পরিসংখ্যান বলে, বিরোধী ভোট ভাগ না হলে কংগ্রেস ১৯৫০ সালের ভোট ছাড়া স্বাধীন ভারতের কোনো জাতীয় নির্বাচনে জয়ী হতো না।
বাংলাদেশেও বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ দেশ স্বাধীন করলেও মাত্র সাড়ে তিন বছর পর অনাকাক্সিক্ষতভাবে ক্ষমতাচ্যুত হয়। নব্বইয়ের দশকে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলেও একবিংশ শতাব্দীতে তা জোটের মাধ্যমেই বর্তমানে ক্ষমতায় আছে। টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটের শরিক দলের কাউকে মন্ত্রিসভায় রাখা হয়নি। সে কারণে এটাকে পূর্বের মত ঐক্য-সরকার না বলে আওয়ামী লীগের সরকার বলছেন জোট শরিকরা। জোট শরিক নেতারা মনে করছেন, একচেটিয়া বিজয়ের পর আওয়ামী লীগ নিজেই শরিকদের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করেছে। বিএনপিকে নিয়ে আওয়ামী লীগের ভাবনার খুব একটা নেই। বিএনপি যে পরিস্থিতিতে পড়েছে তা থেকে ঘুরে দাঁড়াতেই তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। তাই শরিকদের পাত্তা দেয়ার কিছু নেই। এ প্রসঙ্গে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ (মোজাফ্ফর)-এর ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘ভোট নেই তাই এখন জোটের দৃশ্যমান কার্যক্রম নেই। জোটকে যেভাবে সক্রিয় রাখা প্রয়োজন জোট প্রধান আওয়ামী লীগ তা করতে পারেনি।’ এ প্রসঙ্গে জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনুও বলেন, ‘করোনা, জঙ্গিবাদ এবং দুর্নীতি বন্ধে ১৪ দলীয় জোটকে সক্রিয় করা উচিত ছিল। কিন্তু তা হয়নি। সাম্প্রতিক সময়ে হেফাজতের তা-বের পর আবারও প্রমাণ হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে দেশ পরিচালনার জন্য অসাম্প্রদায়িক জোটের দরকার আছে।’ (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ৪ জুলাই ২০২১)
এদিকে আওয়ামী লীগ দাবি করছে, যে আদর্শ নিয়ে জোট গঠন করা হয়েছিল, সেটা বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত জোট থাকবে। সরকারে রাখা না রাখা বিষয়ে কোনো চুক্তি হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়, ক্ষুধা-দারিদ্র্য ও দুর্নীতিমুক্ত দেশ গঠনের জন্য একসঙ্গে আন্দোলন-নির্বাচন করতেই জোট করা হয়েছিল। এ জোট আছে, থাকবে। করোনা মহামারীতে হয়তো জোটবদ্ধ মাঠের কোনো কর্মসূচি নেওয়া হচ্ছে না। তার মানে এটা নয় যে জোট ভেঙ্গে গেছে। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, ‘শরিকদের মধ্যে কারও মন খারাপ থাকতেই পারে। এতে কোনো অসুবিধা নেই। জোটে ঐক্য ঠিকই আছে, কোনো দূরত্ব তৈরি হয়নি। সবার সঙ্গে আলোচনা করে কর্মসূচি ও করণীয় নির্ধারণ করা হবে।’ (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ৪ জুলাই ’২১)
বস্তুতঃ নব্বই-এর দশকে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলেও তেমন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে নাই এবং পরবর্তীতে ক্ষমতায়ও যেতে পারে নাই। একবিংশ শতাব্দীতে তা জোটের মাধ্যমেই বর্তমানে ক্ষমতায় আছে। কাজেই অতীত থেকে শিক্ষা, বর্তমান সিদ্ধান্ত এবং ভবিষ্যৎ পথচলা------।
লেখক পরিচিতি : অধ্যাপক মোঃ হাছান আলী সিকদার, সভাপতি, চাঁদপুর জেলা জাসদ, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রনেতা, চাঁদপুর জেলা শিক্ষক নেতা ও রাজনীতি বিশ্লেষক।