প্রকাশ : ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
রুহুল আমিন গাজী : এক বুক অভিমান নিয়ে চাঁদপুরে ফিরলেন অন্তিম পথের যাত্রী হয়ে
বিগত ১৫/১৬ বছরে মাত্র ২ বার নিজ বাড়ি চাঁদপুরে এসেছেন রুহুল আমিন গাজী। তিনি বাড়ি থেকে ফেরার পর বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন তাঁর আত্মীয় স্বজনদের অনেক হয়রানি করেছে। এরপর আর বাড়িমুখো হননি। গতকাল ২৫ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় সেই অভিমান বুকে নিয়েই তিনি চাঁদপুর ফিরেছেন। তবে লাশ হয়ে। লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের একটি মাদরাসার গোরস্তানে শায়িত হলেন বাবা মায়ের পাশে।
চাঁদপুরের কৃতী সন্তান, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন-বিএফইউজে’র সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা রুহুল আমিন গাজী ভাইয়ের সাথে সর্বশেষ দেখা হয়েছিলো তাঁর অফিসে গত আগস্ট ২০২৪-এর ১৯ তারিখ সন্ধ্যায় । শাহরাস্তি প্রেসক্লাবের নতুন সদস্যদের অভিষেক ও শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হয়ে সদস্যদের শপথ বাক্য পাঠ করাতে সম্মতি দিয়েছিলেন তিনি।
শাহরাস্তি প্রেসক্লাবের সভাপতি মঈনুল ইসলাম কাজল, সাধারণ সম্পাদক স্বপন কর্মকার ও নতুন সদস্য ফয়সালসহ আমরা গিয়েছিলাম অনুষ্ঠানের তারিখ নির্ধারণের জন্যে। শাহরাস্তির মানুষ জাতীয় প্রেসক্লাব সদস্য মোঃ আবদুল্লাহ মজুমদারকে বলেছিলেন, ভালো একটা দিন দেখে তিনি তারিখ জানাবেন। আমি বললাম, ভালোই হয়েছে প্রোগ্রাম শেষ করে আপনি নিজ গ্রাম থেকে ঘুরে আসতে পারবেন। এরপর তিনি অভিমানী কন্ঠে জানালেন, বিগত ১৫/১৬ বছরে মাত্র ২ বার তিনি বাড়ি গিয়েছেন। তিনি বাড়ি থেকে আসার পর বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন তাঁর আত্মীয় স্বজনদের হয়রানি করেছে। এরপর আর বাড়িমুখো হননি। সেদিন তিনি প্রাণ খুলে অনেক কথা বলেছিলেন, কীভাবে মেডিকেল কলেজের পড়াশোনা ছেড়ে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন, সাংবাদিকতা পেশায় যুক্ত হয়ে কীভাবে সাংবাদিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করেছিলেন। সাংবাদিকদের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে গোটা জীবন কী পরিমাণ মামলা-হামলার মোকাবিলা করতে হয়েছে--সেগুলোর কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন সাংবাদিক সাগর-রুনী হত্যাকাণ্ডের তদন্ত কার্যক্রম বারবার পেছানো নিয়ে। ১৭ মাস কারাভোগের কথা জানতে চাইলে বলেছিলেন, সহসা সেসব ঘটনা প্রকাশ্যে আনবেন, লেখাগুলোর সম্পাদনা চলছে।
সাংবাদিকতা পেশায় আসার পর থেকেই যে নির্মোহ সাংবাদিক নেতা আমার হৃদয়ে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার শিখরে আরোহন করেছেন, তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা রুহুল আমিন গাজী। ছোটবেলা থেকেই সাংবাদিকতার প্রতি দুর্বলতা কাজ করায় কৈশোরে বিটিভির পর্দায় সংবাদ বিশ্লেষক হিসেবে দেখা দারাজ কণ্ঠধারী গাজী ভাই মনের অজান্তে কখন যে আমার কাছে অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব হয়ে গেছেন টেরই পাইনি। চাঁদপুরের মানুষ হওয়ার সুবাদে ২০০৫ সাল থেকেই বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানে তাঁকে দেখেছি খুব কাছ থেকে।
রুহুল আমিন গাজীর যে কর্ম আমাকে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত করেছে, সেটি হলো সাগর-রুনী হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে সর্বদা সোচ্চার ছিলেন তিনি। শারীরিকভাবে অসুস্থ হওয়ার পরও সর্বশেষ গত মাসের ৩১ তারিখ ওনাকে প্রতিবাদ কর্মসূচিতে থাকতে দেখা গেছে।
২০১৭ সালে একটি কাজে চাঁদপুরের মানুষ ক্র্যাবের নেতা সাংবাদিক তোফাজ্জল হোসন কামাল ভাইয়ের সাথে দেখা করার জন্যে দৈনিক সংগ্রাম অফিসে যাই। সেখানে জানতে পারি পাশের রুমেই রুহুল আমিন গাজী ভাই বসেন। ফিরে আসার আগে কামাল ভাই আমাকে গাজী ভাইয়ের সাথে সাক্ষাৎ করিয়ে দেন। নিজ জেলার একজন অনুজকে তিনি সেদিন সাদরে গ্রহণ করে নিয়েছিলেন। পত্রিকা অফিসে বিকেলের শিফটে একজন চীফ রিপোর্টারের সকল ব্যস্ততা ছাড়িয়ে আমাকে দেয়া তাঁর উপদেশগুলো আজও হৃদয়ে ধারণ করে আছি।
সাংবাদিক সমাজের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর হিসেবে পরিচিত দেশের শীর্ষ এ সাংবাদিক নেতাকে ২০২০ সালের ২১ অক্টোবর তাঁর কর্মস্থল দৈনিক সংগ্রাম থেকে গ্রেফতার করেছিলো পুলিশ। দীর্ঘ ১৭ মাস কিডনি, লিভারসহ বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত এ সাংবাদিক নেতা কারাগারে নানা অসুস্থতায় ভুগছিলেন। কারাগারের নির্মম প্রকোষ্ঠে নানাবিধ মানসিক নির্যাতনের মাধ্যমে ধীরে ধীরে তাঁকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে। বঞ্চিত ছিলেন কারাগারে নিয়মিত চিকিৎসা সেবা নেয়ার সুযোগ থেকে।
সম্প্রতি তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে উন্নত চিকিৎসার জন্যে তাঁকে বিদেশে নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু নেয়ার সুযোগ হয়নি। সবাইকে কাঁদিয়ে মঙ্গলবার রাত ৯ টায় তিনি চলে গেছেন ওপারে। যাওয়ার আগে এদেশের আপামর জনতার দোয়া ও ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে গেছেন।
আমাদের তিনি কথা দিয়েছিলেন চাঁদপুর আসবেন, কিন্তু এলেন অন্তিম পথের যাত্রী হয়ে। গাজী ভাই তাঁর স্বজনদের গোয়েন্দা হয়রানি থেকে বাঁচাতে যে অভিমানে চাঁদপুর বিমুখ হয়েছিলেন সে অভিমান বুকে নিয়েই চলে গেলেন আপন ভূমে।
নীতি ও আদর্শিকতার অপূর্ব মিশেলে হৃদয়ের মণিকোঠায় তিনি থাকবেন একজন সত্যের সেনানী হিসেবে। বেঁচে থাকবেন প্রতিটি কলম যোদ্ধার অন্তরে একজন গণতন্ত্রকামী, দেশপ্রেমিক, অকুতোভয় সৈনিক হিসেবে।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী, চাঁদপুর।