প্রকাশ : ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
ইলিশ সংকট উত্তরণ জরুরি
ইলিশ বাংলাদেশের জাতীয় মাছ। যার বৈজ্ঞানিক নাম Tenualosa ilisha. ফিশবেইসে বলা হয়েছে, বৈশ্বিকভাবে ইলিশকে বলা হয় হিলশা শ্যাড এবং আলোস হিলশা। এটি একটি সামুদ্রিক মাছ, যা ডিম পাড়ার জন্যে বাংলাদেশ ও পূর্ব ভারতের নদীতে আগমন করে। বাঙালিদের কাছে ইলিশ খুব জনপ্রিয়। ২০১৭ সালে বাংলাদেশের ইলিশ মাছ ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায়। বাংলাদেশ ইলিশ মাছ রপ্তানি করেও প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে থাকে।
ইলিশ মাছ স্বাদে যেমন অতুলনীয়, তেমনি পুষ্টি উপাদানেও ভরপুর। ইলিশ একটি চর্বিযুক্ত মাছ। ইলিশ মাছ মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বাড়ায় এবং ইনসুলিন নিয়ন্ত্রণ রাখতে সহায়তা করে। ইলিশে বিদ্যমান ভিটামিন এ ও ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড চোখের জন্যে উপকারী। ইলিশ রক্ত কোষের জন্যেও বিশেষভাবে উপকারী। এপিএ ও ডিএইচএ নামক ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড থাকে বলেই ইলিশ মাছ দেহের রক্ত সঞ্চালনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। প্রতি ১০০ গ্রাম ইলিশে রয়েছে ২৫ গ্রাম প্রোটিন, ২০৪ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, ২৭ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি, ৩ দশমিক ৩৯ গ্রাম শর্করা, ২ দশমিক ২ গ্রাম খনিজ ও ১৯ দশমিক ৪ গ্রাম চর্বি। আরও রয়েছে উচ্চ পরিমাণে ওমেগা ৩ ফ্যাটি অ্যাসিড, নায়সিন, ট্রিপ্টোফ্যান, ভিটামিন বি-১২, সোডিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়ামসহ অন্যান্য ভিটামিন ও মিনারেলস। ইলিশ ভিটামিন ডি-এর ভালো উৎস। ভিটামিন ডি মানবদেহে ক্যালসিয়াম ও ফসফেটের কার্যকারিতা নিয়ন্ত্রণ করে। ইলিশে থাকা আয়োডিন, জিংক ও পটাশিয়ামের মতো বিভিন্ন খনিজ উপাদান রক্তের গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণে, কোষের সংক্রমণ কমাতে ও থাইরয়েড হরমোন নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
বহু গবেষণায় দেখা গেছে, সামুদ্রিক মাছ ফুসফুসের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে কার্যকর। শিশুদের ক্ষেত্রে হাঁপানি রোধ করতে পারে ইলিশ। যারা নিয়মিত মাছ খান, তাদের ফুসফুস অনেক বেশি শক্তিশালী হয়। ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড অবসাদের মোকাবিলা করতে পারে। সিজনাল অ্যাফেক্টিভ ডিসঅর্ডার (এসএডি), পোস্ট-ন্যাটাল ডিপ্রেশন (সন্তান প্রসব পরবর্তী বিষণ্নতা) কাটাতে সাহায্য করে ইলিশ মাছ।
বাংলাদেশের জিডিপিতে ইলিশের অবদান ১ শতাংশ। বিশ্বে আহরিত ইলিশের প্রায় ৮৬ শতাংশ আহরণ করা হয় বাংলাদেশে। কিন্তু এর পরিমাণ এখন অনেক কম।
ইলিশের ভরা মৌসুম চললেও ইলিশের সংকটে মেঘনাপাড়ের জেলেরা। দিনরাত নদীতে জাল ফেললেও কাঙ্ক্ষিত ইলিশের দেখা মিলে না। ইলিশের দেখা না পেয়ে জেলেদের ঋণের বোঝা বাড়ছে। আমাদের অতিমাত্রার লোভ, নদীর নাব্যতা সংকট, শব্দ দূষণ, নদী দূষণ, নদীর জল দূষণের ফলে ইলিশ সংকট আজকে অতিরিক্ত মাত্রায় পৌঁছেছে। এখনো সময় এবং সুযোগ আছে এই সংকট উত্তরণের। যেটা অনেকটা আমাদের সাধ্যের মধ্যে।
আমাদের নদীগুলো আজ প্রায় মৃত। দখলদারদের অধীনে অধিকাংশ নদী। নদী দূষণ নদীগুলোকে ভাগাড়ে পরিণত করেছে। যে নদীগুলো ইলিশের চারণভূমি, ইলিশের আঁতুরঘর, সেই নদীগুলোতে প্রচুর ডুবোচর। এতে নদীর স্বাবাভিক প্রবাহ ব্যাহত হচ্ছে। ফলে ইলিশের উৎপাদন কমে যাচ্ছে, নদীর দুই পাড়ে ভাঙ্গনের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
নদীর জলদূষণ আজকে অতিরিক্ত মাত্রায় পৌঁছেছে। চাঁদপুর, হাইমচর, লক্ষ্মীপুর, শরিয়তপুর নদীর জল দুর্গন্ধে ভরে গেছে। আর এইভাবে চলতে থাকলে আমাদের জাতীয় মাছ, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অংশ ইলিশও বিলুপ্তপ্রায় মাছের তালিকার নামে চলে আসবে।
নদীতে শব্দ দূষণের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় ইলিশ উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে এবং সেই সাথে নদীতে ইলিশের বিচরণ কমেছে। আর আমাদের পছন্দের প্রিয় ইলিশ মাছ এখন আমাদের নাগালের বাইরে।
মা ইলিশ এবং জাটকা রক্ষার অভিযানের সময় একদল আত্মঘাতী, কুচক্রী, অসাধু ব্যবসায়ী এবং স্থানীয় নেতা-কর্মী, প্রশাসন, পুলিশ ও কোস্টগার্ডের যোগসাজশে মা ইলিশ ও জাটকা রক্ষার অভিযান নিধনের মহোৎসবে পরিণত হয়। আমরা সাধারণ মানুষ কখনো তাদের ক্রেতা হই। আবার কেউ কেউ চেয়ে চেয়ে দেখে আর হতাশায় দীর্ঘশ্বাস ফেলে। জাটকাসহ নদীর অন্যান্য মাছ রক্ষার অভিযান সফল করতে এবং মৎস্য সম্পদকে রক্ষা করতে হলে ভ্রাম্যমাণ আদালত, নৌ-বাহিনী, কোস্টগার্ডসহ অন্যদের টহল আরও জোরদার করতে হবে এবং প্রত্যেকের কাজের সমন্বয় করতে হবে। প্রশাসনের কাজের জবাবদিহি এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল উৎপাদন এবং আমদানি বন্ধ করতে হবে যে কোনো মূল্যে। জাটকা ও মা ইলিশ নিধনে কেউ যেন কোনো প্রকার সুযোগ গ্রহণ করতে না পারে। জেলে এবং নাগরিকদের আরও সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
জাটকাসহ নদীর অন্যান্য মাছ রক্ষার গুরুত্বের বিষয়ে স্থানীয় পর্যায়ে চলমান সভা-সমাবেশ, লিফলেট, ফেস্টুন ইত্যাদি এবং গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার পরিচালনা করতে হবে। জেলেদের জন্যে মা ইলিশ এবং জাটকা রক্ষার অভিযানের সময় মাছচাষকেন্দ্রিক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। যা হবে সামাজিক মালিকানাধীন। মা ইলিশ ও জাটকা রক্ষায় প্রশাসনের দৃষ্টিতে কোনো রকম অবহেলা পরিলক্ষিত হলে তাকে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে।
জেলেদের বোঝাতে হবে যে, এই ইলিশের মালিক জেলেরাই। তাই জেলেদের ইলিশ রক্ষা এবং লালন-পালনের দায়িত্ব নিতে হবে। এক্ষেত্রে সরকার এবং প্রশাসন তাদের সর্বোচ্চ সহযোগী। সন্তানকে লালন-পালন করে বড়ো করলে এক সময় যেমন সন্তান তার পিতামাতার দায়িত্ব নেন, ইলিশ ও নদীর অন্যান্য মাছও জেলেদের জীবনে ঠিক তেমনি। আইনের সঠিক প্রয়োগ যেমন থাকতে হবে, তেমনি থাকতে হবে সচেতনতামূলক কার্যক্রম। তাহলেই রক্ষা পাবে পৃথিবী বিখ্যাত বাংলাদেশের ইলিশ, আর এতে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বাড়বে রপ্তানি আয়। আসুন, মৎস্য সম্পদ রক্ষার জন্যে প্রশাসনের পাশাপাশি সকলে মিলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করি। অপরাধীরা সংখ্যায় কম হয়েও আমাদের ওপর কর্তৃত্ব করে যাচ্ছে, যা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। প্রশাসন যতো কঠোর হবে, জাটকা এবং ইলিশ রক্ষার কার্যক্রম ততো সফল হবে।
জাটকা ও মা ইলিশ রক্ষা করতে পারলে জেলেদের জীবনে যেমন অর্থনৈতিক সচ্ছলতা, নিরাপত্তা আসবে, ঠিক তেমনি রাষ্ট্রের অর্থনীতির চাকাও সচল থাকবে। ডলার সংকট মোকাবিলায়ও ভূমিকা রাখবে। আমরা মা ইলিশ ও জাটকা রক্ষার সফল অভিযান দেখতে চাই। তা যতোই কঠোর ও কঠিন হোক। নদীর গভীরতা ঠিক রাখতে, নদীর প্রবাহ সচল রাখতে ডুবোচর এবং নদী ও সাগরের মোহনা ড্রেজিং করতে হবে। নদী দূষণ বন্ধ করতে হবে। তাহলেই ইলিশের সংকট গুচবে এবং ইলিশের কাঙ্ক্ষিত উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে, ইলিশের চাহিদা মিঠবে, আরও বেশি পরিমাণ ইলিশ রপ্তানি করা সম্ভব হবে।