মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর, ২০২৪  |   ১৯ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া, স্ত্রীর আত্মহত্যা
  •   ভারতকে কড়া বার্তা শ্রম উপদেষ্টার
  •   আধুনিক নৌ টার্মিনাল প্রকল্প পরিদর্শনে চাঁদপুরে নৌপরিবহণ উপদেষ্টা
  •   ডাকাতিয়া নদী ও সিআইপি অভ্যন্তরস্থ খাল খননসহ ৫ দফা দাবিতে সংগ্রাম কমিটির সংবাদ সম্মেলন

প্রকাশ : ১৫ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০

ডাকাতনামা

উজ্জ্বল হোসাইন
ডাকাতনামা

একটা সময় ছিলো বাংলার মায়েরা তার অবুঝ শিশু সন্তানকে ঘুম পাড়াতেন নানা কল্পকাহিনি শুনিয়ে। কুঁজো বুড়ির গল্প, চাঁদ মামার গল্প এবং ডাকাতের ভয় দেখিয়ে। দেশে সম্প্রতি সে সময়ের পুনরাবৃত্তি ঘটেছিলো। হয়তো মায়েরা তাদের শিশু সন্তানদের সেভাবেই ঘুম পাড়িয়েছেন।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে দেশের অনেক তরুণ তাজা রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করেছে। এতে দেশের শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষের মনে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে গত ১৫-২০ দিনে। ছাত্রদের এক দফা দাবির প্রেক্ষিতে ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকারের পতন এবং শেখ হাসিনার দেশ ত্যাগ আন্দোলনের পূর্ণতা দিয়েছে। জেনারেশন জেড এবং তরুণ ছাত্র জনতার এক দফা দাবি বাস্তবায়ন এবং দেশের গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে চলছে অব্যাহতি ও পদত্যাগের হিড়িক। অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের দায়িত্ব নিয়েছেন নোবেল জয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ দেশের সুশীল ও প্রগতিশীল অনেকে। এই সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে ড. ইউনূস কঠোর হাতে দেশ গঠনে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান।

৫ আগস্টের পর বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনী কর্মবিরতিতে যাওয়ার পর দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খুব একটা স্বাভাবিক ছিলো না।

এমতাবস্থায় দেশে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পাশাপাশি আপামর জনতা নিজেদের সুরক্ষার জন্যে প্রতিরোধ করে তোলেন। পাড়া-মহল্লায় সম্প্রীতি রক্ষা ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা থেকে বাঁচতে দিন-রাত পাহারায় ছিলো ব্যস্ত। তারপরও গুজবের কোনো কমতি ছিলো না। কারণ এই গুজবের মূল কাজ জনমনে আবেগ ও আতঙ্ক তৈরি করা। আতঙ্ক ও আবেগের বশবর্তী হয়ে বেশির ভাগ মানুষ যাচাই-বাছাই না করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার বাটনটি চেপে ধরে লিখেছেন, ডাকাত ডাকাত, আবার কেউ কেউ পোস্ট করছেন অমুক এলাকায় ডাকাত ঢুকেছে, সবাই সাবধান হোন। এতে কেউ কেউ মনে করে, গুজবের পোস্টটি শেয়ার দিয়ে অন্যদের গুজবটি সম্পর্কে সতর্ক করবে আর এতেই এটি আরও বেশি ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু বাস্তবে প্রতিরোধ না হয়ে আসলে হয় তার উল্টো, পোস্টটিই বেশির ভাগ মানুষ দেখে, আবেগের কাছে ক্যাপশন পড়ার ধৈর্য হারিয়ে যায় দ্রুতই। দেখে দেখে তিনিও লিখে দেন অমুক এলাকায় ডাকাত পড়েছে, সবাই সাবধান হোন।

কেউ কেউ ছোটবেলার সেই কবিতার মতো বলেছেন হয়তো--

সন্ধে হল, সূর্য নামে পাটে

এলেম যেন জোড়াদিঘির মাঠে।

ধূ ধূ করে যে দিক পানে চাই

কোনোখানে জনমানব নাই,

তুমি যেন আপনমনে তাই

ভয় পেয়েছ; ভাবছ, এলেম কোথা?

আমি বলছি, ‘ভয় পেয়ো না মা গো,

ঐ দেখা যায় মরা নদীর সোঁতা।’

চোরকাঁটাতে মাঠ রয়েছে ঢেকে,

মাঝখানেতে পথ গিয়েছে বেঁকে।

গোরু বাছুর নেইকো কোনোখানে,

সন্ধে হতেই গেছে গাঁয়ের পানে,

আমরা কোথায় যাচ্ছি কে তা জানে,

অন্ধকারে দেখা যায় না ভালো ।

তুমি যেন বললে আমায় ডেকে,

‘দিঘির ধারে ঐ যে কিসের আলো!’

গুজবের বশবর্তী হয়ে পাড়া-মহল্লার মানুষ শুরু করে দেন ডাকাত খোঁজার কাজ। কোনো কোনো এলাকায় রাত ১০টা থেকে শুরু করে দিতেন, ডাকাত ঢুকেছে সবাই সাবধান হোন। এটি ছড়াতে থাকে বিদ্যুৎ গতিতে, চলতে থাকে রাত ৩টা থেকে ৪টা পর্যন্ত। কিন্তু কেউ ডাকাত খুঁজে পেলো না। এরপর অনেকে উৎকণ্ঠার মধ্যে পড়ে শুরু করে চারদিকে ফোন দেওয়া। এছাড়াও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেন কোথায় ডাকাত পড়েছে। বেশ কিছু এলাকার মসজিদের মাইকে ইমাম সাহেবরা ঘোষণা দিতে থাকেন, প্রিয় এলাকাবাসী, সবাই সাবধান হোন, এলাকায় ডাকাত ঢুকেছে, এলাকায় ডাকাত ঢুকেছে, সকলে সাবধান হোন, কেউ ঘরের লাইট বন্ধ করবেন না। আপনারা জেগে থাকুন। মুহূর্তেই এ ঘোষণায় পুরো এলাকার মধ্যে তোলপাড় চলতে থাকে। নিকটাত্মীয় যারা আছেন তাদেরকেও ফোন করে কেউ সহায়তা চান, আবার সাবধান করেন। বিষয়টি নিয়ে চলতে থাকে জল্পনা-কল্পনা। পরিবারের কোমলমতি শিশুদের মনে চলে অজানা আতঙ্ক। কোমলমতি শিশুরা আবার জিজ্ঞেস করে বাবা-মাকে : ডাকাত দেখতে কেমন? সচেতন মা-বাবা হয়ত বলেছেন, ডাকাত আমাদের মতোই, ওসব নিয়ে টেনশন করো না। আর কিছু বাবা-মা হয়তো ছোটবেলার সেই কবিতার মতো ডাকাতের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবেই--

হাতে লাঠি, মাথায় ঝাকড়া চুল

কানে তাদের গোঁজা জবার ফুল।

আমি বলি, ‘দাঁড়া, খবরদার!

এক পা আগে আসিস যদি আর--

এই চেয়ে দেখ আমার তলোয়ার,

টুকরো করে দেব তোদের সেরে ।

শুনে তারা লম্ফ দিয়ে উঠে

চেঁচিয়ে উঠল, ‘হাঁরে রে রে রে রে।

এভাবেই শিশুদের কোমল মনও ভয়ে কেঁপে উঠে। তারা হয়ত বিশ্বাস করেছে, সত্যিই ডাকাত এসেছিলো। আবার কেউ কেউ ডাকাতের কথা জেনে বাসা-বাড়িতে ধারালো দা-বটি প্রস্তুতও করে রাখেন। স্বামী-স্ত্রী মিলে ফন্দি করেন কীভাবে ডাকাত সামলাবেন। তবে শহর কিংবা গ্রাম বা পাড়া-মহল্লার কোথাও গত ক'দিনে ডাকাতের সন্ধান কেউ দিতে পারেনি। কিন্তু ডাকাত আতঙ্ক দিন দিন বেড়েছে। পাড়া-মহলা, অফিস ও বাসা-বাড়িতে তখন একটাই আলোচনা ছিলো, কোন্ এলাকায় ডাকাত এলো, কীভাবে ডাকাত ধাওয়া করলো--এ সব বিষয়। চায়ের স্টল কিংবা রাজনীতি যে কোনো জায়গাতেই তখন একটাই আলোচনা ছিলো ডাকাত। আসলে বাস্তবে এই ডাকাতের দেখা খুব একটা মিলেনি।

আমাদের ভাবতে হবে যে, একটা দেশ গণঅভ্যুত্থানের পরে অনেক শান্তিতে আছে। সাধারণ এ ধরনের গণঅভ্যুত্থানের পরে যে ধরণের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি হওয়ার কথা সেটি হয়নি। গণঅভ্যুত্থানের পরে কারো পতনের পর রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সমাজে যে ধরনের পরিবর্তন আশা করা হয়, তাতে তাৎক্ষণিকভাবে অনেক কিছুতেই পরিবর্তন হতে পারে। আবার একটা অস্থিতিশীল পরিবেশের পর স্থিতিশীল পরিবেশ শতভাগ কার্যকর হবে, এমনটা ঘটুক। সমাজ তথা রাষ্ট্র ব্যবস্থায় পরিবর্তনগুলো যদি পরিকল্পিত হয়, তাহলে তার বাস্তবায়ন আরো সহজ হয় এবং দ্রুতই সেগুলো দৃশ্যমান হয়। কিন্তু সে রকম কোনো পরিকল্পনা না থাকা যে সমস্যা ছিলো, সেটা এখন প্রকটভাবে অনুভূত হতে শুরু করেছে। তবে সরকার ব্যবস্থায় দৃশ্যমান পরিবর্তন সাধারণ মানুষ যতো দ্রুত আশা করছে, সেটাও হয়ত হতে পারে। সমসাময়িক বিষয়ে মানুষের মাঝে আতঙ্ক, গুজব দূর করে এগুতে কবে।

আমাদের এটা ভুলে গেলে চলবে না সেই মিথ্যুক বালকের কথা, যে বালক প্রায় বলতো-- বাঘ এসেছে, বাঘ এসেছে। তাকে উদ্ধার করতে যখন গ্রামবাসী এগিয়ে আসতো, তখন সে বলতো, এটা একটি ফান ছিলো। কিন্তু বাস্তবে যেদিন বাঘ এলো, সেদিন শত কান্না ও চিৎকার করে আর কারো সাহায্য পেলো না। আমরা এখন সেই কথা ভাবছি 'ডাকাত এসেছে, ডাকাত এসেছে', কিন্তু ডাকাত আসেনি। বাস্তবে যেদিন ডাকাত আসবে তখন সচেতন সবাইকে মনে রাখতে হবে যে, সেটা যেনো প্রতিহত করা যায়।

পরিশেষে বাংলাদেশের মানুষ, রাষ্ট্রীয় সম্পদ, সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসহ সকল স্থাপনা দুষ্কৃতকারীদের হাত থেকে মুক্তি পাক--দেশ হোক শোষণ ও বঞ্চনা মুক্ত। ডাকাত এসেছে, ডাকাত এসেছে সেটা কল্পনাতেই থাকুক, সেটা যেনো বাস্তব না হয়--এই প্রত্যাশা করছি।

লেখক : উজ্জ্বল হোসাইন, লেখক ও সংগঠক, চাঁদপুর।

 

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়