প্রকাশ : ০৩ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
১৫ আগস্ট : প্রাণকে তুচ্ছজ্ঞান করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
মিজানুর রহমান রানা
একটি জাতিকে ভালোবেসে যিনি প্রাণকে তুচ্ছজ্ঞান করেছিলেন তাঁর নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জীবনের অধিকাংশ সময়টাই তিনি জেলখানায় কাটিয়েছেন দেশের মানুষের মুক্তির জন্যে। অথচ সে জাতির কিছু বিশ্বাসঘাতক, নরাধমের হাতেই প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছিলো জাতির এ মহান পুরুষকে। পাকিস্তানীদের নির্জন কারাগারে যাঁর জন্যে ১৯৭১-এ কবর পর্যন্ত খোঁড়া হয়েছিলো, সেখানেও তাঁর মৃত্যু হয়নি; হয়েছে এ দেশেরই কিছু দুষ্টু, বিশ্বাসঘাতক ও কুলাঙ্গার প্রকৃতির মানুষের হাতে, যা গোটা জাতিকে করেছে চরম কলঙ্কিত।
এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট কথাসাহিত্যক হুমায়ুন আহমেদের ‘স¤্রাট’ থেকে একটি উক্তি প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, ‘মানুষকে ঘৃণা করার অপরাধে কখনো কাউকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়নি, অথচ মানুষকে ভালোবাসার অপরাধে অতীতে অনেককেই হত্যা করা হয়েছে। ভবিষ্যতেও হয়তো হবে।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও এদেশের মানুষকে ভালোবাসার অপরাধেই কিছু কুলাঙ্গার চরিত্র তাকে সপরিবারে হত্যা করে। তাদের স্বীয় স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্যে তারা দেশের আপামর মানুষের কথা চিন্তা করেনি। বর্তমানকালে অনেককে বলতে শোনা যায়, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর কেনো দেশের একটি মানুষও প্রতিবাদের ভাষা উচ্চারণ করেনি। বঙ্গবন্ধুর অবদানকে খাটো করে দেখার জন্যে নানা কুৎসা প্রচার করে থাকে স্বার্থান্বেষী লোকেরা। আবার এও বলতে শোনা যায়, ‘বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা চায়নি। তিনি নিজেই পাকিস্তানীদের কাছে ধরা দিয়েছিলেন।’
এসব কথা যে তাদের নিজেদের স্বার্থের জন্যে প্রচার করা, তা এ প্রজন্মের সন্তানরা কি বুঝতে পারে? এ প্রজন্মের একজন মানুষ, যে কি না স্বাধীনতার পরে জন্মগ্রহণ করেছে। তারা তো ইতিহাসের অনেক কিছুই জানেন না। তবে জানার অদম্য ইচ্ছা নিয়ে প্রকৃত সত্য অনুসন্ধানে তৎপর হলে এবং চেষ্টা করলে নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার-বিশ্লেষণ করা যেতে পারে।
কবি শামসুর রহমান ‘বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কিছু কথা’ প্রবন্ধে বলেন, ‘তখন কান্নার আওয়াজও নিষিদ্ধ ছিলো বাংলাদেশে। শোকার্তদের ওপর যে কোনো মুহূর্তে নেমে আসতে পারে উৎপীড়নের খাঁড়া। তাই...জোরে কাঁদতেও পারিনি। এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের সংবাদ অপরিশীলিত, কর্কশ কণ্ঠে বেতারে উচ্চারিত হওয়ার পরই বুঝতে পারলাম, আমরা প্রবেশ করছি এক অন্ধকার যুগে..। কিন্তু জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে মাটির তলায় চাপা দিয়ে রাখা যায়নি। এক অর্থে তিনি সগৌরবে উঠে এসেছেন কবর থেকে, উঠে এসেছেন তাঁর প্রিয় বাংলাদেশে, ফসলের আভায়, কৃষকের হাসিতে, নদীর স্রোতে, মাঝির ভাটিয়ালী গানে, উত্তরবঙ্গের গাড়িয়াল ভাইয়ের ভাওয়াইয়া গানে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সঞ্চারী মিছিলে, সভায়। নতুন প্রজন্মের কাছে তিনি আজ উদ্ভাসিত স্বমহিমায় মহিমান্বিত।’
যারা স্বাধীনতা চোখে দেখেনি, ভালোভাবে এদেশের স্বাধীনতার প্রকৃত ইতিহাস জানেন না। তারা কী করে বুঝবে? তারা তো স্বীয় পার্টির অন্ধ টানে নিজ পার্টিকে বড় করে দেখার প্রবণতায়, নিজের স্বার্থের খাতিরে দেশের মহান এই বন্ধুকে অস্বীকার করছে, তার নামে কুৎসা রটনায় বিশ্বাস স্থাপন করছে অথবা নিজেও তা’ প্রচার করছে।
নীলিমা ইব্রাহীম তাঁর ‘১৫ আগস্টের আগে ও পরে’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে মূল অভিযোগগুলো ছিলো এ ধরনের : আকাঙ্ক্ষিত মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান ভেঙ্গে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করা, ভারতের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ চুক্তি আত্মসমর্পণতুল্য, দ্রুত সংসদীয় গণতন্ত্র থেকে রাষ্ট্রপতি শাসন প্রবর্তন এবং নিজে রাষ্ট্রপতি হয়ে সর্বক্ষমতা কুক্ষিগতকরণ, একদলীয় সরকার প্রতিষ্ঠা এবং কম্যুনিজমের প্রতি অতি আকর্ষণ, সংবাদপত্রের সংকোচন, ধর্ম নিরপেক্ষতার নামে ধর্মহীনতা এবং ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ।
কেউ তার যতো সমালোচনাই করুক, তাঁর স্বদেশপ্রীতি সম্পর্কে কটাক্ষ করার সুযোগ তিনি কাউকে দেননি এবং তিনি মনেপ্রাণে দেশকে ভালোবাসতেন। রাজাকার-আলবদরদের তিনি মাথা তুলতে দেননি। ওপরের অভিযোগগুলো ছাড়াও আরো কিছু বিষয় দেখতে পাই যা মুজিব সরকারকে লোকচক্ষে হেয় করেছিলো। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা দূরে সরে গেল। সংগ্রামে যারা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছিলো তাদের বিভক্ত করা হলো মুজিব বাহিনীর জন্ম দিয়ে। নিয়মিত সেনাবাহিনীকে সামনে রেখেও উন্নততর ব্যবস্থায় রক্ষীবাহিনী সৃষ্টি করা হলো। এ দরিদ্র দেশে দুটোর একটাকে অবলম্বন করা প্রয়োজন ছিলো। ফলে সামরিক বাহিনীতে অসন্তোষ দেখা দিলো। শিল্প প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের নামে লুটপাট শুরু হয়ে গেল। যারা এ চৌর্যবৃত্তিতে লিপ্ত ছিলেন তারা রটনা করলেন, ভারতীয়রা সব নিয়ে গেছে। অথচ মুক্তিযোদ্ধার আবরণে যারা আরামে দিল্লি-কলকাতায় অবস্থান করেছে তারা নিজেদের ইচ্ছেমত পদে যোগ দিলেন মুক্তিযোদ্ধার অধিকার নিয়ে। আর যারা শরণার্থীরূপে দশমাস অফিস-আদালত, ঘরে-বাইরে সংগ্রাম করে বেঁচেছিলেন তারা হয়ে গেলেন দালাল, কিছু কিছু লোভাতুরের স্বার্থে। এভাবে সর্বত্র সর্বক্ষেত্রে যে নৈরাজ্য চললো তার দায়ভার গিয়ে পড়লো শেখ মুজিবের ওপর। বাড়ি দখল, বাড়ির ফার্নিচার ও অন্যান্য জিনিস নিয়েছেন যারা, তারা সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি। এরা সংখ্যায় কম হলেও শেখ মুজিবের ওপর কম কালিমা লেপন করেননি। যারা ক্ষুব্ধ ছিলেন, তারা এ সুযোগ গ্রহণ করলেন। রাতারাতি অনেকে মুজিববাদী বনে গেলেন। মন্ত্রিসভার ভেতরে যারা ছুরি শান দিচ্ছিলেন তারা পুলকিত হলেন। এর সঙ্গে যুক্ত হলো আত্মীয় পোষণের অপবাদ, আত্মীয়েরা নিজেরাই নিজেদের তোষণ করেছেন শেখ মুজিবের অগোচরে কিন্তু অপরাধী সাব্যস্ত হলেন শেখ মুজিব।’
তৎকালীন সময় খুনিরা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করেই দেশকে এমন পরিস্থিতির দিকে নিয়ে গেছে, যেখানে দেশের আপামর মানুষ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গিয়েছিলো। এছাড়া ঘাতকচক্রের ক্ষমতার ভয়ে মানুষ সেদিন প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে ফেলেছিলো।
এ প্রসঙ্গে কবি নির্মলেন্দু গুণের ভাষায়, ‘বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর অনেকদিন চলে গিয়েছিলো, দেশের ভেতরে কোথাও প্রকাশ্যে কেউ তাঁর নাম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সঙ্গে উচ্চারণ করতে পারছিলাম না। এ ব্যাপারে সামরিক শাসকদের কোনো বিধি-নিষেধ আরোপিত না থাকলেও, তাদের আকারে-ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দেয়া অলিখিত বিধি-নিষেধ দেশের মানুষের মধ্যে একটা ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে রেখেছিলো। যার ফলে ১৯৭৬ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে প্রবল ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও আমি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা কোনো কবিতা পাঠ করার সাহস অর্জন করতে পারিনি। ১৯৭৬ সালে আমি একুশের কবিতা পাঠের অনুষ্ঠানে পড়েছিলাম ‘ভয় নেই’ নামের একটি কবিতা। ’৭৫-এর নির্মম-নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের পর যে ভয় চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিলো, তার চাপ থেকে দেশের মানুষকে মুক্ত করাটাই ওই কবিতার উদ্দেশ্য। সেই সঙ্গে নিজেকেও ভয়ের আগ্রাসন থেকে মুক্ত করা।’
বঙ্গবন্ধুকে রক্ষার্থে সে সময় সকল ভীতি উপেক্ষা করে নিজে গাড়ি চালিয়ে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনে গেটের নিকটে দায়িত্বশীল অফিসার কর্নেল জামিল ঘাতকদের গুলিতে নিজ প্রাণ বিসর্জন দেন। বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর ইতিহাসে কর্নেল জামিলের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ থাকবে।
বঙ্গবন্ধুর খুনিরা প্রচার করেছিলো যে, দেশের স্বার্থেই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে, অথবা ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা বা দেশের শাসনতন্ত্রের প্রয়োজনে পরিবর্তনের জন্য তারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে। ১৯৭৬ সালের আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে লন্ডন টেলিভিশনে মেজর রশিদ ও মেজর ফারুক সাংবাদিক অ্যান্থনী মাসকার্নহার্সকে এক সাক্ষাৎকার প্রদান করে। তাদেরকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো যে, তারা কেন বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিলো। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা ছাড়া কি তাদের বিকল্প কোনো পথ খোলা ছিলো না?
রশিদ বলেছিলো, বঙ্গবন্ধু সবাইকে দুর্নীতিপরায়ণ হবার সুযোগ দিয়েছিলেন। তিনি অমানবিক ও নীতিবিরোধী কার্যকলাপের অভিযোগের জন্য নিজের দলীয় সদস্য এবং অন্য কারো বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাগ্রহণ করেননি। তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিলো যে, এ ধরনের প্রেক্ষাপটে তারা কি বঙ্গবন্ধুকে জোর করে পদত্যাগের কথা বলতে পারতো না? নাকি তাকে হত্যা করাটা প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছিলো? জবাবে মেজর রশিদ জানায়, তাকে যদি বাঁচিয়ে রাখা হতো, তাহলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিলো না। তাদের প্রশ্ন করা হয় যে, মুজিব ও তার পরিবারের সদস্যদের আত্মসমর্পণের সুযোগ দেয়া কি উচিত ছিলো না?
উত্তরে তারা জানায়, মুজিব, শেখ মনি এবং আবদুর রব সেনিয়াবাত এই তিনজনের প্রত্যেককেই নিজ নিজ ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বিপ্লবীদের কাছে আত্মসমর্পণ করার অনুরোধ জানানো হয়েছিলো। কিন্তু আত্মসমর্পণের পরিবর্তে তারা গোলাবর্ষণ করতে থাকেন। এতে বেশ ক’জন বিপ্লবী সৈনিক ও অফিসার আহত হন এবং ক’জন মৃত্যুবরণ করে। ফলে তারা আত্মরক্ষার প্রয়োজনে গ্রেনেড নিক্ষেপ করে এবং স্বয়ংক্রিয় রাইফেলের গুলিবর্ষণ করে দুর্গগুলো বিধ্বস্ত করে দিতে বাধ্য হয়। অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় এবং এই অবাঞ্ছিত পরিস্থিতির শিকার হয়ে অনেকেই মৃত্যুবরণ করে।
সকল তর্ক-বিতর্কের অবসান ঘটিয়ে আজ এ কথাই প্রমাণিত হয় যে, আসলে খুনিচক্রের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে বঙ্গবন্ধুকে খুনের নেশাই বড় হয়ে ধরা দিয়েছিলো তাদের। দেশের বা তাদের প্রয়োজনে বঙ্গবন্ধুকে ও তার পরিবারবর্গের সবাইকে হত্যার প্রয়োজন কোনোকালেই ছিলো না। তারা যদি দেশের শাসন ক্ষমতা কুক্ষিগত করার প্রয়োজনে কিছু করে থাকতো তাহলে যে কোনো উপায়েই বঙ্গবন্ধুকে জীবিত রেখে তা’ করতে পারতো। কিন্তু তারা জানে বঙ্গবন্ধুকে দাবিয়ে রাখা যাবে না। কারণ তারাই বলেছে যে, বঙ্গবন্ধু আত্মসমর্পণ করেনি। কারণ আত্মসমর্পণ তার চরিত্রের মধ্যে নেই। শুধু বাঙালির কাছে কেন, তিনি শুধুমাত্র সৃষ্টিকর্তা ছাড়া আর কারো কাছে আত্মসমর্পণ করতে শিখেননি। তারা জানে, বঙ্গবন্ধুকে জেলে আটক রেখে তাদের মানসিক ইচ্ছা পূরণ করতে পারবে না। ফলে তারা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে খুন করার সিদ্ধান্ত নেয়।
কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে খুন করে তাদের কী স্বার্থ হাসিল হয়েছে? এ প্রশ্নের জবাবে তারা জানায়, ‘না, কিছুই হয়নি।’ কারণ বঙ্গবন্ধু হচ্ছে একটি ইতিহাস। তাই ‘শেখ মুজিবের নামে ইতিহাসের দরজা খুলে যায়’। তাকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশকে কল্পনা করা বড়ই কঠিন। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ-এ দুটি সত্তা একে অপরের প্রতি নির্ভরশীল। প্রতি বছর ১৫ আগস্ট আমাদের মাঝে এলেই আমরা তা’ মর্মে মর্মে উপলব্ধি করি।