বুধবার, ০৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫  |   ২৭ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   হাইমচরে মাটি বোঝাই বাল্কহেডসহ আটক ৯
  •   কচুয়ায় কৃষিজমির মাটি বিক্রি করার দায়ে ড্রেজার, ভেকু ও ট্রাক্টর বিকল
  •   কচুয়ায় খেলতে গিয়ে আগুনে ঝলসে গেছে শিশু সামিয়া
  •   কচুয়ায় ধর্ষণের অভিযোগে যুবক শ্রীঘরে
  •   ১ হাজার ২৯৫ কেজি নিষিদ্ধ পলিথিন জব্দ করেছে কোস্ট গার্ড

প্রকাশ : ৩১ জুলাই ২০২৪, ০০:০০

হাওর সংস্কৃতি : যাত্রাপালা ও নাটক

মুহাম্মদ ফরিদ হাসান

অনলাইন ডেস্ক
হাওর সংস্কৃতি : যাত্রাপালা ও নাটক

এক.

বাংলাদেশ হাওর-নদী-খাল-বিলের সুবর্ণ অঞ্চল। নদী-জল সংস্কৃতিকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করে। মানুষের আচরণ, বিশ্বাস, যাপনের অনুষঙ্গ, চিন্তা-ভাবনাকে স্বতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য দান করে। এ কারণেই মরু অঞ্চলের কেউ নৌকায় বসে জ্যোৎস্না দেখার সহজাত আনন্দ বুঝবে না। নদীভাঙন আতঙ্ক তাদের মধ্যে নেই। হাওর বললে বিস্তীর্ণ অঞ্চল চোখের সামনে ভাসবে না। জল-জীবনের প্রভাব সাহিত্য-সংস্কৃতি, রাজনীতি, দর্শনেও প্রবলভাবে উপস্থিত। হাওর-জল স্পর্শে মানুষ বাউলশিল্পী শাহ আবদুল করিম কত সহজেই নৌকাকে করেছেন ‘মানুষের’ প্রতীক। বলেছেন, ‘বাউল আব্দুল করিম বলে/বুঝে উঠা দায়/কোথা হইতে আসে নৌকা/কোথায় চলে যায়’। একইভাবে হাওর অঞ্চলের নাটক ও যাত্রাপালায় নিজস্ব পরিবেশ-প্রতিবেশ ও ঘটনা উপস্থাপিত হয় নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে।

হাওর অঞ্চলের নাটক ও যাত্রাপালা নিয়ে আলোচনায় প্রবেশের পূর্বে বাংলাদেশের হাওর অঞ্চল সম্পর্কে ধারণা নেয়া যাক। ভৌগোলিক অবস্থান বিবেচনায় হাওরাঞ্চলকে ৩ ভাগে বিভক্ত। ১. পাহাড় নিকটবর্তী হাওর-অঞ্চল। যেমন : সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলার হাওরসমূহ। ২. প্লাবন ভূমির হাওর। যেমন : নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার হাওরসমূহ। ৩. গভীর পানিতে নিমজ্জিত হাওর। যেমন : কিশোরগঞ্জের ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম ও নিকলী উপজেলার হাওরসমূহ। বাংলাদেশে ৩৭৩টি বড় ধরনের হাওর রয়েছে। হাওরাঞ্চলের জনসংখ্যা প্রায় ২ কোটি। যার ৭০ ভাগ মানুষের জীবিকা কৃষির উপর নির্ভরশীল। এই মানুষদের জীবনে নাটক ও যাত্রাপালা বিনোদনের মাধ্যম তো বটেই, একই সঙ্গে প্রতিবাদের অনুষঙ্গও।১

দুই.

বাংলাদেশের অগ্রগণ্য নাট্যদল প্রাঙ্গণেমোর। তাদের পরিবেশিত মঞ্চনাটক হাছনজানের রাজা। নাটকটির লেখক শাকুর মজিদ, নির্দেশক অনন্ত হিরা। জমিদার ও বিখ্যাত গীতিকবি হাসন রাজাকে উপজীব্য করে লেখা এ নাটকটি ব্যতিক্রম।২ কেননা, নাটকে হাসন রাজাকে বতর্মান বাস্তবতায় উপস্থাপন করা হয়েছে। নাটকটি সম্পর্কে লোকগবেষক সুমনকুমার দাশ লিখেছেন :

নাট্যকার শাকুর মজিদ হাসন রাজাকে অভিনব এক পদ্ধতিতে উপস্থাপন করেছেন। অত্যাধুনিক কিছু তরুণ-তরুণীর মুখোমুখি তিনি হাসন রাজাকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। শহুরে কিছু তরুণ-তরুণী সুনামগঞ্জের হাওরে চাঁদনি রাতে নৌকা ভাসান কেবল হাসন রাজাকে দেখার উদ্দেশে। লোকশ্রুতির বদৌলতে তাঁরা জানতে পেরেছেন, ১৯২২ সালে মারা গেলেও বর্ষার ভরা জোছনায় ‘হাছন রাজার নাও ঘুরিয়া বেড়ায়/ কাছে গেলে এই নাও আকাশে মিলায়।’ কেবল এই তথ্যটুকু সম্বল করে তাঁরা সুনামগঞ্জে এসে নৌকা ভাড়া করে হাওরে রাত কাটাতে যান। আর সেখানেই ঘটনা পরম্পরায় তাঁদের দেখা হয়ে যায় সখী-পরিবেষ্টিত হাসন রাজার সঙ্গে। এরপর তাঁরা হাসন রাজাকে জিজ্ঞেস করে জেনে নেন তাঁর জীবনকাহিনি এবং তাঁকে নিয়ে প্রচলিত নানা জনশ্রুতির বিষয়েও।৩

এই গীতি কাব্যনাট্যে হাওর অঞ্চলের প্রকৃতি-পরিবেশ, অতীত ও বর্তমানের প্রেক্ষাপটে জনজীবন উপস্থাপিত হয়েছে। নাটকের শুরুতেই নাট্যকার লিখেছেন, ‘অন্ধকার মঞ্চের পর্দা সরতেই উপরের দিকে মঞ্চের পেছন থেকে ঝলমলে চাঁদ দেখা যাবে। ধীরে ধীরে আলো ফুটলে দেখা যাবে অমল ধবল জ্যোৎস্নাকবলিত ভরা বর্ষার হাওর।’৪

শাকুর মজিদের আরেকটি নাটক ‘মহাজনের নাও’। নাটকটি বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিমের জীবন, সংগীত ও দর্শনকে ধারণ করে আছে। সুবচন নাট্য সংসদের ব্যানারে নাটকটি নির্দেশনা দিয়েছেন সুদীপ চক্রবর্তী। আবদুল করিম হাওর অঞ্চলে মানুষ। তাঁর জীবন-যাপন-দর্শনের সঙ্গে হাওর মিশে আছে। শাকুর মজিদের ‘মহাজনের নাও’ নাটকে তাই অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ হাওর। নাটকের শেষ দৃশ্যের সংলাপ শাহ আবদুল করিম ও হাওর মিলে মিশে একাকার :

কথক : এই নদী এই জল বরাম হাওর

দেখে শুনে রাখে তারে তিরান্নব্বই বছর।

এই হাওরের পানি, নাও, মাঝি, জনে জন

কত শত দিন তারে করেছে লালন।

এ জলের রূপ রসে জেগেছিল হুঁশ

এ জলে করিম হয় ভাটির পুরুষ।

বরাম হাওরে আজ শেষ যাওয়া তার

সুজন কান্ডারি আজ নিজেই সোয়ার।

বাউল আবদুল করিম তবে বুঝিয়া নায়ের ভাও

সারা জীবন বাইয়া গেলেন মহাজনের নাও।৫

হাওর অঞ্চলের যাত্রাপালা মঞ্চায়নের মুখ্য সময় শীতকাল। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত দলগুলো যাত্রা পরিবেশন করে। যাত্রাপালাকে কেন্দ্র করে হাওর অঞ্চলের মানুষের মধ্যে চাঞ্চল্য দেখা দেয়। এ অঞ্চলের কয়েকটি যাত্রা দল হলো : বুলবুল অপেরা, দিপালী অপেরা, গণেশ অপেরা, নবরঞ্জন অপেরা, বাসন্তী অপেরা, বাবুল অপেরা, বলাকা অপেরা, চারণিক নাট্যগোষ্ঠী, ফাল্গুনী অপেরা ইত্যাদি। যাত্রাপালার মধ্যে ‘একটি পয়সা’, ‘মা-মাটি-মানুষ’, ‘দেবী সুলতানা’, ‘আঁধারের মুসাফির’, ‘এই পৃথিবী টাকার গোলাম’, ‘এক মুঠো অন্ন চাই’, ‘মায়ের চোখে জল’, ‘মোঘল-এ-আজম’, ‘গঙ্গা থেকে বুড়িগঙ্গা’, ‘বর্গী এলো দেশে’, ‘রক্তস্নাত ৭১’, ‘নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা’ ইত্যাদি। কুশীলবদের মধ্যে নয়ন দত্ত, অমলেন্দু বিশ্বাস, আলিম, মুসলিম, নয়ন মিয়া, আশরাফ আলী, মঞ্জুশ্রী, জ্যোৎস্না বিশ্বাস, রিনা সুলতানা, চন্দ্রা ব্যানার্জী, শবরী দাশ গুপ্তা, নিবারণ চন্দ্র দাস প্রমুখ ছিলেন উল্লেখযোগ্য।

হাওর অঞ্চলে যাত্রা দেখার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে মোতাহার হোসেন লিখেছেন, ‘যাত্রা চলাকালীন দর্শকরা একেবারে বিমোহিত হয়ে যেতেন। পালার সুখ-দুঃখের কাহিনীর সাথে একাত্ম হয়ে হাসিতে ফেটে পড়তেন অথবা কান্নায় সবার চোখ ভিজে যেতো।’৬

হাওর অঞ্চলের সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ ‘ঢপ যাত্রাপালা’। ধর্ম-সমাজ-ইতিহাসের ঘটনাকে ধারণ করে ঢপযাত্রা পরিবেশিত হয়। সাধারণত, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের উৎসবে এ যাত্রাপালা মঞ্চস্থ হয়।৭ ঢপযাত্রার জন্যে উঁচু মঞ্চ তৈরি হয় না, দর্শক ও অভিনেতারা একই সমান্তরালে থাকেন। ঢপযাত্রা সম্পর্কে ‘বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা : সুনামগঞ্জ’ গ্রন্থে বলা হয়েছে :

সাধারণত রামায়ণ, মহাভারত, মনসামঙ্গলসহ হিন্দু ধর্মীয় বিভিন্ন পুরাণের একাধিক কাহিনি অবলম্বনে ঢপযাত্রা রচিত হয়ে থাকে। ঢপযাত্রার অভিনয়শিল্পীরা যাত্রার মতোই পোশাক-আশাক পরে মঞ্চে আসেন। কেবল ধর্মীয় রীতিনীতিটুকু পোষাকের মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়। নারী-পুরুষের চরিত্র থাকলেও পুরুষেরাই সাধারণত নারীর ভূমিকায় অভিনয় করে থাকেন। যাত্রা মঞ্চায়নের সময় একাধিক ধর্মীয় গানও পরিবেশিত হয়। সঙ্গত কারণেই হারমোনিয়াম, ঢোল, ঢোলক, করতাল, মন্দিরা, মৃদঙ্গ-এসব নানা লোকবাদ্যযন্ত্র আবশ্যকভাবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।৮

হাওরাঞ্চলের জনপ্রিয় ঢপযাত্রার মধ্যে সীতার বনবাস, নিমাই সন্ন্যাস, দাতা কর্ণ, দুর্গার মহিমা, নৌকাবিলাস, কংসবধ, মহাবীর শ্রীকৃষ্ণ, শনির চক্রান্ত, দাতা হরিশচন্দ্র, লক্ষ্মণ শক্তিমান, অভিমুন্য বধ, অজ্ঞাত পঞ্চপা-ব উল্লেখযোগ্য। ঢপযাত্রা গানের শিল্পীদের মধ্যে সুনামগঞ্জের সুধাংশু, অসিত তালুকদার, শ্রীকান্ত দাস, নিশিকান্ত, মনমোহন দাস, সুজিত কুমার চৌধুরী, চয়ন, লিটন দাস, অবনী দাস, সুবল দাস, নিবারণ; রণধীর দাস, পরেশ রঞ্জন চৌধুরী; প্রসেনজিৎ, বিমল দাস, যামিনী, রেনুকা রঞ্জন চৌধুরী, সুনীল, নীতেশ, দিলীপ দাস, রাজেন্দ্র তালুকদার প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।৯

হাওর অঞ্চলের ধর্মচিন্তা ও বিশ্বাস ধারণ-করা আরেকটি মঞ্চনাটক ‘কইন্যা’। নাটকটি লিখেছেন মুরাদ খান। নির্দেশনা দিয়েছেন আজাদ আবুল কালাম। মঞ্চস্থ করেছে প্রাচ্যনাট। নাটকটির মূল কাহিনী সম্পর্কে ব্রোশিউরে বলা হয়েছে :

‘কালারুকা’ নামের জনপদের মানুষ মনে করে ‘কইন্যাপীর’ তাদের দেখে রাখেন। কইন্যাপীর এসেছিলেন সেই কবে এই কালারুকায়; গত হয়েছেন তাও যুগ যুগ আগে, তবু এমত বিশ্বাস বর্তমান, তার সাথী ‘বহুরূপী’কে তিনি রেখে যান খালি বাড়ির এক পুকুরে মাছ রূপে।

খালি বাড়িতে এখন থাকেন নাইওর ও দিলবর দুই ভাই। জনপদের সবাই জানেন, বিপত্নীক নাইওরের ওপর কইন্যাপীরের ভর আছে। ইশকে মাতোয়ারা নাইওর ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলেন বহুরূপীর সাথে, যেন বহুরূপীর কাছে নিজেকে জানার দীক্ষা নেন।১০

তিন.

হাওর অঞ্চলের মধ্যে কিশোরগঞ্জ অন্যতম। কিশোরগঞ্জের নাট্যচর্চার ইতিহাস নিয়ে খুব বেশি লেখা চোখে পড়েনি। নাট্যাভিনেতা জাহাঙ্গীর আলম জাহান লিখেছেন ‘কিশোরগঞ্জে নাট্যচর্চা : অতীত ও বর্তমান’ শীর্ষক একটি মূল্যবান প্রবন্ধ। তাঁর প্রবন্ধ থেকে আলোচ্য লেখায় কিশোরগঞ্জের নাট্যচর্চা, নাট্যব্যক্তিত্ব ও নাট্যামোদীদের তথ্য সন্নিবেশিত হয়েছে।

কিশোরগঞ্জের নাট্যচর্চার সূচনা আনুমানিক ১৮৯১ সালে, সৌখিন নাট্যগোষ্ঠী ‘কিশোরগঞ্জ নাট্যসমাজ’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। চল্লিশের দশকের কয়েকজন সক্রিয় নাট্যকর্মী হলেন শচীন্দ্র চক্রবর্তী, দীনেশ বর্মণ, ভূপেন্দ্র চক্রবর্তী, অনাথ দাস, শশী দত্ত, কিরণ সেন, নূরুল ইসলাম নূরু লোকেশ আচার্য্য প্রমুখ। অনাথ দাস ও নূরুল ইসলাম নূরু নারী চরিত্রে অভিনয় করে সুনাম অর্জন করেছেন। তাদের পরবর্তীকালে নারী চরিত্রে অভিনয় করে সুনাম কুড়িয়েছেন অবণী বর্মণ (খরমপট্টি), নরেশ দাস, হীরা মিয়া (যশোদল), সিরাজ (পুরানথানা), গণেশ খলিফা, মোহাম্মদ সাইদুর, একেএম গিয়াস উদ্দিন খান, আলী হায়দার খান কাচ্চু, জ্যোতি মিয়া প্রমুখ।

১৯৫৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় কিশোরগঞ্জ আর্টস কাউন্সিল। এ সংগঠনের প্রথম মঞ্চায়িত নাটক ‘মহারাজ নন্দকুমার’। এ সংগঠনের ব্যানারে অধ্যাপক জিয়াউদ্দীন আহমদের নাটক ও প্রহসন ‘ছিন্নআশা’, ‘অপরাজেয়’, ‘ছায়াহরিণ’, ‘ঋণ পরিশোধ’, ‘ভাড়াটে চাই’ ইত্যাদি মঞ্চস্থ হয়।

কিশোরগঞ্জের ষাটের দশকের নাট্যকারদের মধ্যে কল্যাণ মিত্র, সৈয়দ ওয়াহিদুল ইসলাম (পট্টু মিয়া) উল্লেখযোগ্য। পট্টু মিয়া রচিত উল্লেখযোগ্য নাটক ‘অভিযান’। এই নাটকে সর্বপ্রথম নারী হিসেবে গীতা দত্ত ও মুক্তা বেগম অভিনয় করেন। এর আগে কিশোরগঞ্জের কোনো নাটকে নারীরা অভিনয় করেননি। এ জেলার নারী অভিনেত্রীদের মধ্যে রোজী, নাহার, সবিতা, শুক্লা, রেণু, হেনা, ফাতেমা আক্তার রত্না, নূরজাহান, গীতা, আরতি, দীপালি, মমতা, সুরভি, স্বরূফা, মালা, মায়া রাণী, চম্পা হাসান, পারভীন, নাসরিন, ফৌজিয়া জলিল ন্যান্সি, লুবজানা মুনা মুনমুন, কানিজ আমিনা লাভলী, সেলিনা ইয়াসমিন কাকলী, ইয়াসমিন সুলতানা মিঠু, নাসরিন সুলতানা শিপু, অলকা দাস গীতা, পুরবী দাস পূর্ণিমা, আফরোজা হাসান পারুল, ফরিদা হাসান মিনা, খুজিস্থা বেগম জোনাকী, আফরোজা সুলতানা সোমা, আফরিনা শিকদার তন্বি, সাবিনা আফরোজ হীরা, জান্নাতুল ফেরদৌস পিংকী শাহনাজ পারভীন নীলা, হাফসা আফরিন বৃষ্টি, সোহেলী শিরিন সীমা, মনিরা নাহার লুনা, সবিতা বসাক, সাদিয়া খান মিল্কী, নিগার সুলতানা উজমা, শারমিন আক্তার মীম, ঊর্মি সুলতানা, সেঁজুতি আক্তার, শান্তা ইসলাম, সিলভিয়া জেবিন প্রিয়া, তানিয়া তাহ্সিন রূপা, লাকি রেজা, সানিয়া আক্তার শ্রাবণ, নাভানা ইসলাম সুবর্ণা, সঞ্চিতা বর্মণ, মিষ্টি ঘোষ, ঊর্মিলা কর, তানিয়া আক্তার রূপা, সুজাতা রায় প্রমুখের নাম স্মরণ করা যায়।

কিশোরগঞ্জের নাট্যাঙ্গনে যারা সক্রিয় ছিলেন ও আছেন এমন কয়েকজন হলেন : অধ্যাপক চুনীলাল রায় (সি.এল.রায়), অধ্যাপক আতিকুল্লাহ চৌধুরী, সুধেন্দু বিশ্বাস, মৃণাল দত্ত, জগদ্বন্ধু রায়, অধ্যাপক নূরুল হক, ডাক্তার এম.এ. হক, অমর দে, অবণী বর্মণ, একেএম গিয়াস উদ্দিন, শাহেদ, হেকমতে সোলায়মান বিবেক, গোলাম রসুল খান ভিক্ষু মিয়া, প্রিয়নাথ বসাক; আলী হায়দার খান কাচ্চু, উদয়শঙ্কর বসাক বেনু, বদিউল আলম মতি, এস এ করিম খুশু, গণেশ খলিফা, আবদুল খালেক ভেণ্ডার, বিভাস চৌধুরী মিন্টু, মোজাম্মেল হক খান রতন, কাজী শহীদুল হক মিলন, মফিজউদ্দিন আহমদ, মলয় কর, সিরাজুল হক আঙ্গুর, এম এ আজিজ, কাজল লোহ, শহিদুল ইসলাম মতি, আলজুস ভূঁইয়া, শঙ্কর চন্দ্র সরকার, আতাউর রহমান খান মিলন, মুক্তি চৌধুরী, শাহ্ আজিজুল হক, সাইদুর রহমান মানিক, সোহরাব হোসেন দাদু, সন্দীপ রায়, শেখ ফরিদ আহাম্মদ, খালেদ মোসাদ্দেক নটু, জাহাঙ্গীর আলম জাহান, সুনীল দেবনাথ, মোঃ মাসুদুর রহমান, মানস কর, ম.ম. জুয়েল, হারুন-আল-রশীদ, ফজলুল হক, সাইদুল হক শেখর, আবু জাবিদ ভূঁইয়া সোহেল, আবদুল ওয়াহাব, মীর আশরাফুল হক চঞ্চল, পল্লব কর, শরদিন্দু বিশ্বাস, কামরুন নূর চৌধুরী, মীর মাসুদ, ইনামুল হক সাগর, মানব কর, শফিকুল ইসলাম শামীম, রজিত ভৌমিক, নাজমুল ইসলাম তাসরু, সাঈদ ইসলাম, সৈয়দ মোহসীন হোসেন রূপস, কবিরউদ্দিন ফারুকী সোয়েল, শামসুল আলম হাদিস, শাহ্দিন আহমেদ শুভ, আসলামুল হক আসলাম, বাবুল মিয়া ডালিম, এমদাদুল হক বুলবুল, এইচ.আর. হবি শেখ, মারুফ হাসান হিরণ, দেলোয়ার হোসেন শামীম, আমিনুল ইসলাম আল আমিন, হেলালউদ্দিন, আবুল ফজল মোহাম্মদ আহাদ, ফজলে এলাহী রকী, নূরুল হক খোকা, নূরুল হক শাহীন, শাহ্ নূর মোহাম্মদ শান্ত, সাইদুর রহমান সাঈদ, আবুল বাশার আদিত্য, সজল ফকির, মিঠুন ঘোষ, প্রদীপ সাহা, অপূর্ব, মিনহাজউদ্দিন, ইয়াসিন আরাফাত, ইঞ্জিনিয়ার পাভেল, কাওসার, সাফাত, প্রান্ত, বাপ্পী, মোস্তাক আহমেদ, তন্ময় প্রমুখ।

কিশোরগঞ্জের আরেকটি নাট্যদল ‘বৃহস্পতি নাট্য গোষ্ঠী’। এটি ১৯৭৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এর উদ্যোক্তা হলেন : শহীদুল ইসলাম মতি, রুহুল আমিন মনু, বিভাস চৌধুরী মিন্টু, খোরশেদ আলম খুশু, মুক্তি চৌধুরী প্রমুখ। তাদের আলোচিত নাটক ‘ইতিহাস কাঁদে’। এ জেলার স্বনামধন্য নাট্যসংগঠন ‘স্বরবর্ণ নাট্যমঞ্চ’ (স্বনাম)। ২০০০ সালে এ সংগঠনটি পাঁচদিনব্যাপী নাট্যউৎসব করে।১১

কিশোরগঞ্জে লোকনাট্য মঞ্চস্থ হয়। এ জেলায় প্রচলিত লোকনাট্যের মধ্যে ‘চন্দ্রাবতী’, ‘বীরাঙ্গনা সখিনার পালা’, ‘মহুয়া পালা’ ইত্যাদি।১২

চার.

১৯৭০ সালে সুনামগঞ্জে ‘আশার আলো’ ও ‘কুয়াশা কান্না’; সিলেটে ‘রাত্রিশেষ’, ‘পল্লীর মেয়ে’, ‘দায়ী কে?’, ‘শেষফল’, ‘সাজাহান’, ‘আপট্রেন’ ও ‘একে শূন্য দশ’ ও ‘হায়দার আলী’ নাটক মঞ্চস্থ হয়। মহান মুক্তিযুদ্ধকালে সিলেটের নাট্যাঙ্গন সরব ছিলো। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে মঞ্চস্থ হয় ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ নাটকটি। গবেষক ফাহিম মালেক লিখেছেন :

২৫ মার্চ রাতে সিলেটের কয়েকজন নাট্যকর্মী এবং কুমিল্লার কয়েকজন মিলে এই নাটক মঞ্চস্থ করেন। নিজাম উদ্দিন লস্করের নির্দেশনায় এতে অভিনয় করেন বিদ্যুৎ কর, মানসী বিশ্বাসসহ আরও অনেকে। ২৫ মার্চ রাতে সিলেট শহরের অদূরে একটি গ্রামে মঞ্চস্থ করেন নাটকটি। প্রায় ৩০জন নাট্যশিল্পী এই নাটকে অংশগ্রহণ করেন। সিলেটে তৎকালীন সময়ে যারা নাট্যসংস্কৃতির সাথে জড়িত অধিকাংশই ছিলেন এই দলে। নাটকের নির্দেশক নিজাম উদ্দিন লস্কর সাক্ষাৎকারে দেওয়া তথ্য থেকে জানা যায়, সিলেট শহর থেকে একটি দল নিয়ে শহরের একটু দূরে নাটক প্রদর্শনীতে যান। নাটক মঞ্চায়নের কিছু আগে রাত ১২টার পর লোকমুখে জানতে পারেন ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর মাধ্যমে সংগঠিত নৃশংস হত্যাযজ্ঞের কথা। সংবাদটি শুনে নাটক বন্ধ করে সিলেট শহরের দিকে যাত্রা করেন।১৩

সম্প্রতি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির উদ্যোগে জেলায় জেলায় বধ্যভূমিতে গণহত্যার নাটক মঞ্চস্থ হয়। এ উদ্যোগের অংশ হিসেবে সুনামগঞ্জে বধ্যভূমিতে মঞ্চস্থ হয় নাটক ‘দাঁড়াও পথিক’। নাটকটি রচনা ও নির্দেশনা দিয়েছেন আহমেদ মঞ্জুরুল হক চৌধুরী। কিশোরগঞ্জে বধ্যভূমিতে গণহত্যার নাটক ‘বরইতলা ট্রাজেডি’। নাটকটি রচনা ও নির্দেশনা দিয়েছেন আকতারুজ্জামান। সিলেটের গল্লামারি বধ্যভূমির পটভূমিতে রচিত নাটক ‘বধ্যভূমিতে শেষদৃশ্য’। নাটকটি লিখেছেন কাজী মাহমুদুর রহমান, নির্দেশনা দিয়েছেন নাট্যকর্মী ও সংগঠক রজত কান্তি গুপ্ত।

পাঁচ.

হাওরের জল-প্রাণে সিক্ত সিলেট বিভাগের কয়েকটি নাট্যদল হলো : কথাকলি, নাট্যমেলা, নাট্যলোক, শায়েস্তাগঞ্জ থিয়েটার, থিয়েটার সাস্ট, তারুণ্য নাট্যগোষ্ঠী, দিক থিয়েটার, শ্রীমঙ্গল থিয়েটার, জীবন সংকেত নাট্যগোষ্ঠী, প্রান্তিক থিয়েটার, খোয়াই থিয়েটার, মুনিপুরী থিয়েটার, উচ্ছাস থিয়েটার, নাটগোষ্ঠী, প্রতীক থিয়েটার, নাট্যলোক (সুরমা) সিলেট, নাট্যমঞ্চ সিলেট, নবশিখা নাট্যদল, বন্ধন থিয়েটার, সবুজ বাংলা থিয়েটার, বিজয় থিয়েটার, বিরানীবাজার সাংস্কৃতিক কমান্ড, সুনামগঞ্জ প্রসেনিয়াম, স্বপ্তস্বর নাট্যদল, লিটল থিয়েটার সিলেট, উদীচী সিলেট, প্রতিবেশী নাট্য গোষ্ঠি (সিওমেক) কথাকলি সিলেট, নাট্যমঞ্চ সিলেট, নগরনাট, নাট্য নিকেতন সিলেট, নৃত্যশৈলী সিলেট, পাঠশালা সিলেট, এমকা সিলেট, মৃত্তিকায় মহাকাল, থিয়েটার একদল ফিনিক্স ইত্যাদি।

সিলেটের নাট্যান্দোলনের কয়েকজন সারথি হলেন পথিকৃৎ কুমার গোপীকারমণ, কুমার বাহাদুর, কৈলাস দাস, ক্ষীরোদ দেব, বনমালী ঘোষ, ইরেশলাল সোম, বিশ্বেশ্বর রায়, প্রমথ পোদ্দার, বাদশা মিয়া, ব্যোমকেশ ঘোষ, ভানু রায়, আব্দুস সামাদ, খোকন পুরকায়স্থ, বাদল রায়, লোকনাথ পাল, যামিনী পাল, তরুণারায়, মুহম্মদ রমজান, বুলু মিয়া, রাধিকা গোস্বামী, কামরুজ্জামান, বীরেন্দ্র দাস, নুরুল হোসেন খান, আলী হায়দার খান, বীরেনদ্্র রায়, পরিমল বিকাশ দেব, লোকেশ আচার্য, ভুবন ঘোষ, সাজ্জাদুর রহমান,মাহমুদুর রহমান, হিমংশু ভটাচার্য, হিরন্ময় ভটাচার্য, নুরুজ্জামান চৌধরী, মুকুন্দ ভটাচার্য, নুরুল ইসলাম, সিরাজুল ইসলাম, খাদেমুল ইসলাম, তুলসিলাল পান্ডে, বিলায়েত মিয়া, রণদা গুপ্ত, কালীপদ চৌধুরী, রওনক চৌধুরী, আজমল আলী চৌধুরী, রাকেন্দু লোভান, সমাদ্দার, নলীনি দাস, আব্দুল হক, আব্দুর রহিম, টিপু, বকুল, মজুমদার, কৌশিক ভট্টাচার্য, শরফ উদ্দিন, ফড়িংবাবু, অমিয় নন্দী, রণধীর সেন, মোয়াজ্জেম হোসেন চৌধুরী, ত্রিপুরেশ্বর রায়, ইনাম আহমদ, তরুণী দাস, প্রসন্নদাস, চটইবাবু, শিশু, দীপেন্দ্র দাস, প্রাণেশ দাস, নরেন্দ্র ভট্টাচার্য, নগেন্দ্র সোম, বিমলেন্দু দাস, অমলেন্দু দাস, বিনয় দাস বীরেন সোম হিমাংশু দাশগুপ্ত, বিমান দাস, ত্রিগুণা সেন, অসিত চৌধুরী, এনায়েত উল্লাহ খান, শিবু ভট্টাচার্য, খলিল উল্লা খান, হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য, সুনির্মল কুমার দেব, মীন প্রমুখ।১৪

হাওর অঞ্চলের নাটক ও যাত্রাপালা নিয়ে এ পর্যন্ত কোনো সুনির্দিষ্ট প্রবন্ধ লেখা হয়নি। এ লেখাটি প্রাথমিক একটি প্রয়াস। ফলে পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্তের ঘাটতির কারণে লেখাটি পূর্ণাঙ্গ হয়নি। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট অনেকের সাথে যোগাযোগ করেও সাড়া পাইনি। তবে সবার সহযোগিতায় এ লেখাটি পরিপূর্ণ করার ইচ্ছে রয়েছে।

তথ্যসূত্র

১. এশিয়ার বৃহত্তম হাওরাঞ্চল ও উন্নয়নের মহাপরিকল্পনা, কৃষি তথ্য সার্ভিস ওয়েবসাইট (www.ais.gov.bd)

২. সুমনকুমার দাশ, প্রসঙ্গ : ‘হাছনজানের রাজা’, রাইজিংবিডি.কম, প্রকাশকাল : ১০ মে ২০১৮।

৩. আলোচিত মঞ্চ নাটক, বাংলানিউজ টোয়েন্টিফোর.কম, প্রকাশকাল : ১ জানুয়ারি, ২০১৯ খ্রি.

৪. শাকুর মজিদ, হাছনজানের রাজা, পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স, ২০১৮, পৃ. ১১।

৫. শাকুর মজিদ, ভাটির পুরুষ, পূর্বপশ্চিম ডটকম, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭।

৬. মো. মোতাহার হোসেন, হাওরের জীবন, হাওরের সংস্কৃতি, দি ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেস, ২৩ জুলাই, ২০২১ খ্রি.

৭. সুমনকুমার দাশ, হাওরের সংস্কৃতি, হাওরের গান, গানপার ডটকম।

৮. শামসুজ্জামান খান, (প্রধান সম্পাদক), বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা সুনামগঞ্জ, বাংলা একাডেমি, এপ্রিল ২০১৪, পৃ. ২৫৫-২৫৭।

৯. শামসুজ্জামান খান, পূর্বোক্ত, ২৫৫-২৫৭।

১০. আহমাদ মোস্তফা কামাল, প্রাচ্যনাটের কইন্যা : লোকায়ত ধর্মচর্চার মঞ্চরূপ, থিয়েটার ওয়ালা, জুলাই-ডিসেম্বর ’০৭।

১১. জাহাঙ্গীর আলম জাহান, কিশোরগঞ্জে নাট্যচর্চা : অতীত ও বর্তমান, প্রকাশকাল : ২৭ জুন ২০১৯

১২. শামসুজ্জামান খান, (প্রধান সম্পাদক), বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা কিশোরগঞ্জ, বাংলা একাডেমি, জুন ২০১৪, পৃ. ৪০৫।

১৩. ফাহিম মালেক, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন নাট্যচর্চা, দি জাহাঙ্গীরনগর রিভিউ, ভলিয়ম তিন, সংখ্যা ৩০, পৃ. ৩৬৬-৩৬৭।

১৪. সুমন দে, সিলেটে নাটকের ইতিহাস ও প্রেক্ষাপট, বিডিনিউজ২৪ ডটকম, প্রকাশকাল : ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৭।

মুহাম্মদ ফরিদ হাসান : লেখক ও গবেষক। প্রকাশিত গ্রন্থ ২৭টি। তাঁর দুটি গ্রন্থ বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি ও প্রেস ইন্সটিটিউট বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিষ্ঠাতা : সেন্টার ফর হিস্ট্রি অ্যান্ড কালচারাল রিসার্চ।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়