প্রকাশ : ৩০ জুলাই ২০২৪, ০০:০০
হারিয়েই বুঝি কী হারালাম
মুক্তা পীযূষ
এই চাঁদপুরে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনে আমাকে প্রতিষ্ঠিত করতে যিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন তিনি অ্যাডভোকেট সাইদুল ইসলাম বাবু ভাই। শোভন পরিবেশে কোন্ সংগঠনে আমি থাকতে পারি আবার কোথায় নয় তা তিনিই সবচেয়ে আগে ঠিক করতেন। আমি আর বাবু ভাইই কেবল জানতাম এসব।
রোটারী পরিবারের সদস্য হিসেবে আমার বর ডাক্তার পীযূষের যুক্ত হওয়ার পরেই তাঁর সাথে আমার পরিচয়। এর মধ্যে কখন যে তিনি আমার বড়োভাইয়ের ভূমিকা পালন করতে শুরু করেছেন বুঝতে পারিনি।
২০১৬ সালে বঙ্গবন্ধু শিশু কিশোর মেলা চাঁদপুরের সহ-সভাপতি হওয়ার পরে বাবু ভাই জানালেন তিনি এই সংগঠনের উপদেষ্টা এবং তিনিই আমাকে আর পীযূষকে এখানে যুক্ত করতে বলেছেন কিরণ ভাইকে। নানাবিধ অসঙ্গতির কারণে আমিই বাবু ভাইকে বললাম, আমি আর থাকতে চাই না এখানে। তিনি বোঝালেন, কিন্তু আমি মানিনি। পরবর্তীকালে আমরা আর কমিটিতে থাকিনি।
আমি যখন ইনার হুইল ক্লাব অব চাঁদপুর সেন্ট্রাল (ডিস্ট্রিক্ট-৩২৮)-এর প্রেসিডেন্ট, তখন তিনি আমার অনুষ্ঠানে আসার চেষ্টা করতেন রোটারিয়ান হিসেবে। আর বলতেন পলিকেও নিয়ে নেন আপনার সাথে। (পলি ভাবি, বাবু ভাইয়ের সহধর্মিণী, তার মতো বিনয়ী, নম্র ও মার্জিত নারী আমি খুব কম দেখেছি)। যেবার বাবু ভাই চাঁদপুর রোটারী ক্লাবের প্রেসিডেন্ট হলেন, সেবার শুধুমাত্র তার সময়ের রোটাবর্ষ শুরুর (১লা জুলাই) অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পীযূষ আর আমি ছেলেদেরসহ পারিবারিক অনুষ্ঠান বাদ দিয়ে ঢাকা থেকে চলে আসি এবং চাঁদপুর লঞ্চ টার্মিনাল থেকে রোটারী ক্লাবে চলে গেছি, বাসায় না গিয়ে। কারণ তিনি আমাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন চাঁদপুরের প্রতিবন্ধীদের বিদ্যালয়ের শিক্ষক বিচিত্রা দিদি ও বীণা দিদিকে যেনো রোটারী ক্লাবে আনি ঐ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আর্থিক প্রণোদনা দিবেন তাই। তিনিই ঐ অনুষ্ঠানে প্রথম আমার দুই ছেলেকে দিয়ে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন করান রোটারীর কোনো আয়োজনে।
প্রয়াত পীযূষ কান্তি রায় চৌধুরী দাদা বহুবার বুঝিয়ে আমাকে চার দেয়ালের বাইরে এনে তাঁর মাধ্যমে গড়া বঙ্গবন্ধু আবৃত্তি পরিষদ, চাঁদপুরে ২০১১ সালে সরাসরি সহ-সভাপতি হিসাবে যুক্ত করেন। দাদার পরলোকগমনের পরে সংগঠনের সকলেই যখন আমাকে সভাপতি হিসেবে চিন্তা করছে তখন রায় চৌধুরীর ইচ্ছা অনুযায়ী (আমার আরেক বড় ভাই) কাজী শাহাদাত ভাইকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে চিন্তা করে পূর্বের উপদেষ্টা ডাক্তার পীযূষের সাথে বাবু ভাইকে আমার উপদেষ্টা হিসেবে থাকার অনুরোধ করে বললাম, আপনি থাকবেন বঙ্গবন্ধু আবৃত্তি পরিষদের সাথে। তিনি বললেন যে, না করার কোনো সুযোগ আপনি আমাকে দিবেন না আমি জানি। এরপর মে ২০১৯ থেকে গত ২০২৪-এর মে মাস পর্যন্ত করা সংগঠনের সকল কাজের আগে পরে মাঝখানে তিনি আমাকে মানসিক শক্তি ও সাহস দিয়েছেন, আমার বড়োভাই থাকলে ঠিক যেভাবে সাহস দিতেন তেমন করেই। মনে আছে ২০১৯ সালে সভাপতি হওয়ার পরে একবার একজনকে দাওয়াত দিতে যেতে হবে আমাকেই সভাপতি হিসেবে, তিনি আমাকে বললেন প্রত্নকে সাথে নিয়ে আপনি অমুক রাস্তার মোড়ে দাঁড়ান, আমি কোর্ট থেকে ১২ টায় আপনার সাথে যাবো, একা ওখানে যাবেন না।
'পদক্ষেপ বাংলাদেশ, চাঁদপুরে'র সভাপতি হিসেবে আমাকে নিযুক্ত করার পরে বাবু ভাইকে যথারীতি আমার উপদেষ্টা হিসেবে পেলাম এবং তিনি আমার জন্যে যা যা করেছেন কিছুই কখনো ভুলতে পারবো না আমি। সবাই মনে করে ডাক্তার পীযূষ আর আমার বন্ধু আমাকে সাপোর্ট করে বলে আমি এতো সাহস পাই, আদতে বাবু ভাই আমার শক্তি ও সাহস ছিলেন।
রতনদা, কাজী শাহাদাত ভাইয়ের সাথে বড়োভাই হিসেবে আমার একটা সমীহ তথা শ্রদ্ধামূলক ভয়ের ভাব থাকলেও বাবু ভাইয়ের সাথে আমি ছিলাম ভয়ডরহীন। নিজেদেরকে সহীহ শুদ্ধ আর হামবড়া মনে করা কতিপয় অতি পাকনা ব্যক্তিদের করা এক সংগঠন থেকে তিনি আমাকে সুকৌশলে বের করে আনেন (তিনি জানতেন কারও গোলামি করা আমার দ্বারা হবে না), কিন্তু সবাই মনে করেছে আমার জিদ আর ঘাড়ত্যাড়া স্বভাবের কারণে যাইনি আর।
পারিবারিক জীবন ও সামাজিকভাবে নিজের সম্মান নিয়ে চলতে তিনি আমাকে পরামর্শ দিতেন, সংগঠনের কাজে ম্যাসেজ লিখলে উত্তর কম দিয়ে ফোন করতেন বেশি। রোটারী ক্লাবের সেক্রেটারী হিসেবে ডাক্তার পীযূষ যখন দায়িত্ব নিতে রাজি হচ্ছিলেন না তখন বাবু ভাই বুঝিয়ে রাজি করিয়েছিলেন। কতো বিষয়ে যে আমরা কথা বলতাম পলি ভাবী জানতেন কিছুটা।
আমাকে স্নেহ করেন এমন দুই-একজনের অনুমোদনের পরে, জেলার সর্বোচ্চ কর্তা ব্যক্তি কোনো একটা সংগঠনে আমাকে যুক্ত করতে চাইলেন যখন, তখন বাবু ভাই জানলেন এবং বুঝলেন কুতুবদের কেউ কেউ সরাসরি আমাকে ও আমার পরিবারকে পছন্দ করেন না তাদের তোয়াজ-তুমার না করার কারণে! আমি পরে অসুবিধায় পড়তে পারি দেখে তিনি কমিটি প্রকাশিত হওয়ার আগেই আমার নাম বাদ দিতে বলেছিলেন। স্নেহ তিনি আমাকে করতেন তা আমি জানতাম, এতোটা যে করতেন তা অনুমান করতে পারিনি।
ভাই হারানোর শোক কেমন হয় তা এই প্রথম আমি অনুভব করলাম। তাঁর অসুস্থতার কথা আমি বুঝতে পেরেছিলাম, কিন্তু কষ্ট পাবেন তিনি বা আমি কষ্ট পাবো বলে সরাসরি বলিনি তাঁকে এবং তিনিও বলেননি আমাকে, আমাদেরকে। বাবু ভাইকে হাসপাতালে দেখতে গেলাম, তখন আমার ছোট ছেলেটাও কান্না জড়িত কণ্ঠে বললো, বাবু আঙ্কেলকে এভাবে দেখতে ভালো লাগে না। এতো প্রাণচঞ্চল মানুষের এমন বিদায় খুব কষ্টের। আর আমি কতোটা অভাগা তাঁর প্রতি শেষ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা কৃতজ্ঞতা জানানোরও সুযোগ পাইনি, পারিবারিক কাজে ঢাকায় ছিলাম এবং আসতে দেরি হওয়ায়।
আল্লাহ আমার ভাইকে অবশ্যই জান্নাতে রাখবেন এই দোয়া করি।