প্রকাশ : ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০০:০০
স্বাধীনতার স্থপতির আদর্শই হোক দেশ চালনার ভিত্তি
ড. মোঃ নাছিম আখতার
আধুনিক যুগেও পৃথিবীময় আপনার দৃষ্টি প্রসারিত করুন, দেখবেন ভূখ-বিহীন পরাধীন জাতির দুঃখ-দুর্দশা, শুনবেন তাদের হৃদয়ের আর্তনাদ। পরাধীনতার গ্লানি থেকে বাঙালি জাতিকে মুক্তির স্বপ্ন যিনি দেখিয়েছিলেন তিনি আর কেউ নন, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি বাঙালি জাতির জীবনে এসেছিলেন আলোকবর্তিকা হয়ে। তাঁর অসামান্য ত্যাগ-তিতিক্ষার ফলস্বরূপ আমরা পেয়েছি লাল-সবুজের পতাকার স্বাধীন দেশ বাংলাদেশ।
|আরো খবর
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান নামে দেশটি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বাঙালির অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের ওপর আঘাত আসে। বঞ্চনার শিকার হয় বাঙালি। হাজার মাইল দূরে অবস্থিত দু’টি ভূখণ্ড নিয়ে পাকিস্তান সৃষ্টি হয়। পূর্ববঙ্গে ৫৬ শতাংশ জনসংখ্যা থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তানের রাজধানী হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। পূর্ববঙ্গের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় পূর্ব পাকিস্তান। বাংলা ভাষার পরিবর্তে উর্দুকে মাতৃভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র শুরু হয়। নানা অত্যাচার, নিপীড়ন, বৈষম্য ও জুলুমের ফলে বাঙালি জাতি প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। প্রতিবাদী বাঙালির শক্তিকে একত্রিত করে যিনি স্বাধীনতাকামী মানুষের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন, তিনি হলেন স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
বাঙালি জাতির সবচেয়ে বড় অর্জন স্বাধীনতা। টানা ৯ মাসের সশস্ত্র যুদ্ধ ও ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এ স্বাধীনতা। ১৯৫২ সাল থেকেই শুরু হয়েছিল রক্তদানের পালা। এরপর রাজনীতির দীর্ঘ চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আসতে হয়েছিল স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে। একাত্তরের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যার হাতে যা আছে, তাই নিয়ে দুর্গ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বলতে গেলে সেদিনই বাঙালির অন্তরে রোপিত হয় স্বাধীনতার বীজমন্ত্র।
স্বাধীনতার পর দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পেলেও তা হোঁচট খেয়েছে বারবার। বজায় থাকেনি তার ধারাবাহিকতা। রাজনীতিতে ঐকমত্যের অভাব ও অসহিষ্ণুতা এর বড় কারণ। অন্তত জাতীয় ইস্যুগুলোয় সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে ঐক্য থাকা প্রয়োজন হলেও কোনো শাসনামলেই তা দেখা যায়নি। এ ক্ষেত্রে দেশের চেয়ে দলের স্বার্থই হয়ে উঠেছে মুখ্য। একইভাবে সরকার পরিবর্তনের পর আগের সরকারের উন্নয়নমূলক কাজ থমকে গেছে। এটা দেশের অগ্রগতির পথে হয়েছে অন্তরায়। এটা সত্যি, দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষার প্রসার, নারী উন্নয়ন, শিশুমৃত্যুর হার কমানো ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রভূত সাফল্য রয়েছে আমাদের। জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিলেও এর উত্থান ঠেকিয়ে রাখা গেছে।
আশার কথা হলো, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ এখন বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিচ্ছে। রাজনীতির দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, টানাপড়েন কাটিয়ে মহাজোট সরকার দেশকে একাত্তরের চেতনায় পরিচালিত করার ব্যাপারে সংকল্পবদ্ধ। ইতিহাসের এই নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করতে গিয়ে আমাদের নতুন প্রজন্মকে এটাও বুঝতে হবে যে স্বাধীনতা মানে শুধু পরাধীনতা থেকে মুক্তি নয়। নতুন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আয়োজনও শুধু নয়। স্বাধীনতা হলো স্বাধীন রাষ্ট্রে সার্বভৌম জাতি হিসেবে টিকে থাকার আয়োজন। স্বাধীনতা মানে বৈধ ও নৈতিক ইচ্ছার স্বাধীনতা। রাজনীতির স্বাধীনতা এবং অবশ্যই অর্থনৈতিক মুক্তি। আর এ বিষয়ে সফলতার জন্য বঙ্গবন্ধুর জীবনদর্শন, তাঁর আদর্শ ও মূল্যবান উক্তি বিশ্লেষণ ও বাস্তবায়নে সবাইকে সচেষ্ট হতে হবে। তবেই আসবে স্বাধীনতার সত্যিকার সুফল।
১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না। সাম্প্রদায়িকতা যেন মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বাংলাদেশ। মুসলমান তার ধর্ম-কর্ম করবে, হিন্দু তার ধর্ম-কর্ম করবে, বৌদ্ধ তার ধর্ম-কর্ম করবে, খ্রিস্টান তার ধর্ম-কর্ম করবে। কেউ কাউকে বাধা দিতে পারবে না।’ একই ভূখণ্ডে থাকা বিভিন্ন ধর্মের মানুষ যদি ধর্মীয় কারণে দ্বিধা-বিভক্ত থাকে, তাহলে দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা, অগ্রগতি কখনো সম্ভব নয়। বহিঃশত্রু ধর্মের বিভেদকে পুঁজি করে ওই দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হরণ করার চেষ্টায় ওত পেতে থাকে। তাই উন্নত, স্বনির্ভর ও শান্তির দেশ গড়তে ধর্মনিরপেক্ষতার বিকল্প নেই। ১৯৭৩ সালের ১৯ আগস্ট সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একটি জাতীয় সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বাবারা একটু লেখাপড়া শিখ। যতই জিন্দাবাদ আর মুর্দাবাদ করো, ঠিকমত লেখাপড়া না শিখলে কোনো লাভ নেই। আর লেখাপড়া শিখে যে সময়টুকু থাকে বাপ-মাকে সাহায্য করো। প্যান্ট পরা শিখছো বলে বাবার সঙ্গে হাল ধরতে লজ্জা করো না।’ এই বক্তব্যে পড়াশোনার গুরুত্ব প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি জানতেন, শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। শিক্ষা একটি দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম। এ ছাড়া মা-বাবার প্রতি থাকতে বলেছেন সমমর্মী এবং কোনো কাজকেই ছোট হিসেবে দেখতে বলেননি। আমরা যদি সবাই একে অন্যের প্রতি সমমর্মী হই এবং সুশিক্ষায় শিক্ষিত হই, তাহলে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়া শুধু সময়ের অপেক্ষা মাত্র।
‘এই দেশ হিন্দুর না, এই দেশ মুসলমানের না। এই দেশকে যে নিজের বলে ভাববে, এই দেশ তার। এই দেশের কল্যাণ দেখে যার মন খুশিতে ভরে উঠবে এই দেশ তার। এই দেশের দুঃখে যে কাঁদবে এই দেশ তার এবং এই দেশ তাদের যারা এই দেশের স্বাধীনতার জন্যে সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়েছে এবং ভবিষ্যতেও দিবে।’ এই বক্তব্যের মাধ্যমে দেশকে তিনি গভীরভাবে ভালোবাসার উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। সব ধর্মের মানুষই এই দেশের সমান ভাগীদার। তাই সবারই দেশের প্রতি থাকতে হবে অপরিসীম মমত্ববোধ, কৃতজ্ঞতা ও দেশপ্রেম। তাহলেই দেশ হবে দুর্নীতিমুক্ত, উন্নত ও শান্তির আবাসস্থল। কারণ দেশপ্রেমিক মানুষ কখনোই কোনো লোভের হাতছানিতে দেশের সর্বনাশে সাড়া দেয় না। বরং দেশ রক্ষায় প্রয়োজনে তারা জীবন দিতে প্রস্তুত থাকে।
‘অযোগ্য নেতৃত্ব, নীতিহীন নেতা ও কাপুরুষ রাজনীতিবিদদের সঙ্গে কোনো দিন একসঙ্গে হয়ে দেশের কাজে নামতে নেই। তাতে দেশসেবার চেয়ে দেশ ও জনগণের সর্বনাশই হয় বেশি।’ তাঁর মতো সৎ, ন্যায়পরায়ণ রাজনীতিবিদের জীবনোপলব্ধি থেকে নিঃসরিত এই উক্তিটি জনগণ ও রাষ্ট্রকে ভবিষ্যতের ভুল পদক্ষেপ থেকে নিবৃত্ত করবে। ‘ভুলে যেয়ো না। স্বাধীনতা পেয়েছো একরকম শত্রুর সঙ্গে লড়াই করে। তখন আমরা জানতাম আমাদের এক নম্বর শত্রু পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ও শোষকগোষ্ঠী। কিন্তু এখন শত্রুকে চেনাই কষ্টকর।’ বর্তমান প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধুর শাশ^ত উক্তিটি দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদদের চলার পথের পাথেয়। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা স্বাধীনতার সপক্ষের দল আওয়ামী লীগে অন্য মতাদর্শের অনেক চাটুকার, বিশ্বাসঘাতক, কুচক্রী অনুপ্রবেশ করেছে। এদের চিহ্নিত করে নিষ্ক্রিয় না করলে যেকোনো সময় ঘটতে পারে বড় ধরনের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা।
স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা, সার্বভৌম বাংলাদেশের রূপকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু অবিসংবাদিত নেতাই ছিলেন না, ছিলেন একজন আদর্শ, সৎ, দেশপ্রেমিক ও বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ। দেশ পরিচালনায় তাঁর জীবনদর্শন, সততা ও বিচক্ষণতা অনুসরণ স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা।
লেখক : ভাইস চ্যান্সেলর, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।