প্রকাশ : ২৫ মে ২০২৪, ০০:০০
তরুণদের আত্মহত্যা প্রবণতা : প্রেক্ষিত এমিল ডুর্খিমের তত্ত্ব ও আমার ভাবনা
কচুয়া উপজেলায় ধারাবাহিকভাবে ৩ জন তরুণ আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। গত ২১ মে কচুয়া পৌর সদর বাজার সংলগ্ন করইশ গ্রামে বড় বাড়ির তুষার (২১) ও পরদিন তারই বন্ধু কড়ইয়া গ্রামের সাব্বির (২১) আত্মহত্যা করে। তাদের দুজনের ফেসবুক পোস্ট ছিলো একই রকম। ২৩ বৃহস্পতিবার ১০নং উত্তর গোহট ইউনিয়নের তালতলী গ্রামের মিয়াজী বাড়ির আকরাম (২০) পালগিরি মাছের প্রজেক্ট পাড়ে তার মায়ের ভাষ্যমতে ইঁদুর মারার ঔষধ খেয়ে আত্মহত্যা করে। আত্মহত্যা একটি সামাজিক ঘটনা। ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী এমিল ডুর্খিম সামাজিক ঘটনা হিসেবে আত্মহত্যা কীভাবে সামাজিক সংহতি বা যৌথ চেতনার সাথে সম্পর্কিত তা সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত সুন্দরভাবে তার ‘The suicide’ গ্রন্থে তুলে ধরেছেন।
এমিল ডুর্খেইমের মতে, আত্মহত্যা একটি সামাজিক ঘটনা। তিনি সামাজিক সংহতি এবং সামাজিক সচেতনতার সঙ্গে আত্মহত্যা সম্পর্ক নির্ণয় করেছেন। অভিজ্ঞতাভিত্তিক ও পরিসংখ্যানগত পদ্ধতির মাধ্যমে তিনি আত্মহত্যা সম্পর্কে বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি তাঁর ঝঁরপরফব গ্রন্থে আত্মহত্যার জৈবিক, মনস্তাত্ত্বিক এবং ভৌগোলিক কারণসমূহকে যৌক্তিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রত্যাখ্যান করে সামাজিক কারণসমূহকে গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরেন। তিনি মূলত অন্যের যুক্তি খণ্ডন করেন, তারপর আলোচ্য বিষয়ে নিজের যুক্তি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি আত্মহত্যাকে শ্রমবিভাজনের নেতিবাচক দিক হিসেবে ব্যাখ্যা করেন, যা সামাজিক সংহতির সঙ্গে সম্পৃক্ত।
আত্মহত্যার সংজ্ঞা দিতে তিনি বলেন, suicide is applied to all cases of death resulting directly or indirectly by a positive or negative act of the victim himself which he knows will produce this result.
ডুর্খেইম ৩ ধরনের আত্মহত্যার কথা তুলে ধরেছেন। এগুলো হলো : আত্মকেন্দ্রিক আত্মহত্যা (Egoistic Suicide), পরার্থপর আত্মহত্যা (Altruistic Suicide) এবং নৈরাজ্যমূলক আত্মহত্যা (Anomic Suicide)।
আত্মকেন্দ্রিক আত্মহত্যা : সমাজ বা গোষ্ঠীর সঙ্গে সংহতির অভাব দেখা দিলে এ ধরনের আত্মহত্যা ঘটে। সমাজ থেকে ব্যক্তি যখন নিজেকে বিচ্ছিন্ন মনে করে তখন এ ধরনের আত্মহত্যা ঘটে। সচরাচর যে সকল সমাজে সামাজিক সংহতি কম থাকে সে সকল সমাজে আত্মকেন্দ্রিক আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি হয়। ডুর্খেইম পরিসংখ্যানের মাধ্যমে দেখান যে, বিবাহিতদের চেয়ে অবিবাহিতদের মধ্যে, নারীদের চেয়ে পুরুষদের মধ্যে, গ্রামবাসীর চেয়ে নগরবাসীর মধ্যে এ ধরনের আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি।
পরার্থমূলক আত্মহত্যা : এই আত্মহত্যা আত্মকেন্দ্রিক আত্মহত্যার বিপরীত। যখন কোনো ব্যক্তি দেশ বা সমাজের প্রতি অতি বেশি দরদী হয়ে আত্মহত্যা করে তবে তাকে পরার্থমূলক আত্মহত্যা বলে। যেমন : ১৯৭১ সালে দেশের জন্যে যুদ্ধ করে আত্মহত্যা।
নৈরাজ্যমূলক আত্মহত্যা : এমিল ডুর্খেইম মনে করেন, যখন সমাজে ব্যক্তির ওপর মূল্যবোধের প্রভাব হারিয়ে ফেলে তখন তাকে নৈরাজ্যমূলক অবস্থা বলে। এ ধরনের পরিস্থিতি হলে ব্যক্তি তার নিজ নিজ ইচ্ছানুযায়ী আচরণ করে, যা সামাজিকভাবে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয় যার প্রভাবে বা কারণে অনেকে আত্মহত্যা করে। এ রকম পরিস্থিতিতে আত্মহত্যা করাকেই নৈরাজ্যমূলক আত্মহত্যা বলে।
এছাড়া suicide গ্রন্থের Footnote -এ তিনি আরেক ধরনের আত্মহত্যার কথা বলেছেন, সেটি হলো ভাগ্যবাদী আত্মহত্যা। সমাজের অতিরিক্ত অনুশাসনের ফলে এ ধরনের আত্মহত্যা দেখা দেয়।
কচুয়ার ৩ জন তরুণের আত্মহত্যার বিষয়ে তাদের পিতামাতার স্পষ্ট বক্তব্য পাওয়া না গেলেও তাদের বন্ধুবান্ধবদের সাথে কথা বলে আত্মহত্যাগুলোকে আত্মকেন্দ্রিক আত্মহত্যা বলেই মনে হয়েছে।
সামাজিক অনুশাসন, দারিদ্র্য, হতাশা, প্রেমে ব্যর্থতা, পাশ্চত্য সংস্কৃতির অনুকরণ, যৌথ পরিবার কাঠামো হ্রাস, পারিবারিক সহিংসতা, মাদকদ্রব্য সেবন এবং সৃষ্ট হতাশা, বেকারত্ব ইত্যাদি আত্মহত্যার কারণ হিসেবে ধরে নেয়া যেতে পারে। কারণ যাই হোক না কেনো আত্মহত্যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। তরুণদের হতাশা দূর করে কর্মমুখী জীবনে ফিরে আসতে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র সবাইকেই এগিয়ে আসতে হবে। আমরা চাই না আর একটি প্রাণও যেনো অকালে ঝরে না যায়।
তথ্যসূত্র :
১. ধ্রুপদী সমাজতাত্ত্বিক তত্ত্ব, কবির পাবলিকেশন, বাংলাবাজার, ঢাকা।
২. সাংবাদিক মফিজুল ইসলাম বাবুলের ভিডিও প্রতিবেদন।
৩. শিক্ষক বাতায়ন ও গুগল।
সার্বিক সহযোগিতা : আবুল কালাম আজাদ, সহকারী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ।
মোঃ মেহেদী হাসান সোহেল : অনার্স চতুর্থ বর্ষ, সেশন : ২০১৯-২০। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়।