বুধবার, ০৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫  |   ২৭ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   হাইমচরে মাটি বোঝাই বাল্কহেডসহ আটক ৯
  •   কচুয়ায় কৃষিজমির মাটি বিক্রি করার দায়ে ড্রেজার, ভেকু ও ট্রাক্টর বিকল
  •   কচুয়ায় খেলতে গিয়ে আগুনে ঝলসে গেছে শিশু সামিয়া
  •   কচুয়ায় ধর্ষণের অভিযোগে যুবক শ্রীঘরে
  •   ১ হাজার ২৯৫ কেজি নিষিদ্ধ পলিথিন জব্দ করেছে কোস্ট গার্ড

প্রকাশ : ১৯ মে ২০২৪, ০০:০০

করোনা বিষ!

শ্বাসরুদ্ধকর সেই ৯ ঘণ্টা কোনোদিন ভুলবো না

মোঃ আনোয়ার হাবিব কাজল
শ্বাসরুদ্ধকর সেই ৯ ঘণ্টা কোনোদিন ভুলবো না

২০২০ সাল যেমন বিশ্ব ইতিহাসের পাতায় চিহ্নিত হয়ে থাকবে ভয়ঙ্কর এক মহামারির বছর হিসেবে, তেমনি আমার জীবনে তথা আমাদের গোটা পরিবারের কাছেও এ বছরটি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। মাত্র ৯ ঘন্টার ব্যবধানে আমরা হারিয়েছি আমাদের প্রাণপ্রিয় বাবা-মাকে। দিনটি ছিল ১৮মে। আর এ মুহূর্তটি সন্ধ্যা ৭টা ২০ মিনিট।

করোনাকালে বিশ্বসংসারে চমকে ওঠার মতো কতো ঘটনাই না ঘটেছিল প্রতিদিন। সন্তান আপন বাবা/মা’র লাশ পথে ফেলে চলে গেছে। বাবাকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দিয়ে একটি বারের জন্যেও আর দেখতে যায়নি। এমনি আরো বিচিত্র সব ঘটনা। বাসায় ড্রইংরুমে বসে হোম অফিস করছিলাম। পাশের একরুমে অশীতিপর আব্বা মোঃ মজিবুর রহমান পাটোয়ারী (৮৭) বিছানায় শয্যাশায়ী আর আরেক রুমে অসুস্থ আম্মা রাবেয়া বেগম (৭৬)। আম্মা ২/৩ দিন যাবৎ জ্বর জ্বর অনুভব করছেন। আম্মাই মূলত আব্বার সেবা শুশ্রƒষা করতেন। বিকেল বেলায়ও বাথরুম থেকে বড় বোন-ভাবীর সহায়তায় নিজের বিছানায় যাওয়ার সময় আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আম্মা এখন কেমন লাগছে? তিনি উত্তর দিলেন, ‘বুঝতেছি না’। তারপর আব্বার রুম ডিঙ্গিয়ে নিজ বিছানায় যাওয়ার সময় বার বার আব্বার দিকে তাকাচ্ছিলেন আর বলতেছিলেন, আমার শরীরটা ভালো না থাকায় তোমার শ্বশুরের কোনো খবর আজ নিতে পারলাম না। ঠিকমত খাওয়াইছো তো? ভাবীকে বলতে শুনলাম, আগে আপনি নিজে সুস্থ হয়ে উঠেন তারপর আব্বার খোঁজ খবর নিতে পারবেন। আম্মাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে ভাবী ইফতার তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। আমার বড় বোন তখনও আম্মার সেবা চালিয়ে যাচ্ছিলেন।

ইফতার শেষ করে মাগরিব নামাজ শেষে মুনাজাত দিবো এমন সময় ভাতিজি সামিয়া এসে বললো, চাচু একটু তাড়াতাড়ি আস, দাদু কেমন যেন করছে। সাথে সাথে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেলাম মায়ের কাছে। আম্মা বিছানায় এপাশ ওপাশ ছটফট করছে আর জোরে জোরে আল্লাহকে ডাকছে। আমার বড়বোন ও ভাবী মায়ের বুকে-হাতে গরম তেল রসুন আর কী যেন মালিশ করছিল। মিনিট ২/৩-এর মধ্যে আম্মার শরীর নিথর হয়ে গেল। আমি পালস্ বুঝতে চেষ্টা করলাম, পেলাম না। ততক্ষণে তিনি না ফেরার দেশে চলে গেছেন। বড় বোন-ভাবী হাউ মাউ করে কাঁদলেও আমি ছিলাম বাকরুদ্ধ। আমি আসলে শত কঠিন বাস্তবতায় কখনো মুষড়ে পড়ি না বা কাঁদতে পারি না। অনেকক্ষণ দম মুখ বন্ধ করে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে রইলাম। হাজারো স্মৃতি যেন আমাকে আঁকড়ে ধরেছে।

তারপর নিজেকে অনেকটা সামলে নিয়ে কানাডা প্রবাসী বড়ভাই আবদুল্লাহকে ফোন দিলাম। খবর শুনেই তিনি আম্মাগো বলে এক চিৎকারে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন। আমার মেজো ভাই কলেজ শিক্ষক গোলাম সরওয়ার কচি ও ভাতিজা কলেজ শিক্ষার্থী শাহরিয়ারের চারদিন আগেই করোনা পজিটিভ ধরা পড়ে। তাই তাদের দুজনকে আলাদা দুই রুমে কোয়ারেন্টাইন অবস্থায় রাখা হয়েছিল। আর সতর্কতা হিসেবে দুদিন আগে আব্বা-আম্মাসহ পরিবারের সবার করোনা টেস্ট করানো হয়েছিল। অপেক্ষা শুধু রিপোর্ট পাওয়ার। আম্মা-আব্বার মৃত্যুর দুদিন পর রিপোর্ট আসলে জানা গেল তাদের করোনা পজিটিভ ছিল।

করোনাক্রান্ত মেজো ভাই ও ভাতিজা অবরুদ্ধ থাকায় যা কিছু করার আমাকে একাই করতে হয়েছে। ছোট ভাই আহসান হাবিব বাবু লকডাউন থাকার কারণে সেও ঢাকা থেকে আসতে পারেনি। এমনকি আমার ছোট বোন নাসরিন একই শহরে আধা কিলোমিটার দূরত্বে থেকেও স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির নিষেধাজ্ঞার কারণে শেষ মুহর্তের দেখাটুকু পর্যন্ত দেখতে পারেনি। করোনা গোটা সমাজকে তখন বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল। এ প্রতিকূল পরিবেশে আমাকে শক্তি ও সাহস জুগিয়েছে আমার দুই বেয়াই আরজু ও জুয়েল।

এমন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে আমিই হয়ে উঠলাম একমাত্র ভরসার স্থল। যা কিছু করার আমাকেই করতে হয়েছে। মহান আল্লাহর কাছে লাখো শোকরিয়া, তিনি আমাকে সেই সুযোগটি দিয়েছেন এবং শত বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে আমি আমার মা-বাবাকে শেষ পর্যন্ত পৈত্রিক কবরস্থানে দাফন করতে পেরেছি। সেই সাথে কৃতজ্ঞ আমার সাংবাদিক বন্ধুদের প্রতি। আমি প্রথমে যোগাযোগ করি আমার মামা নাছির উদ্দিন আহমেদের সাথে। তিনি সান্ত¡না দিয়ে বললেন, আমি ইসলামী আন্দোলনের আনোয়ার হুজুরকে বলে দিয়েছি তিনি লোকজন নিয়ে এসে সব ব্যবস্থা করবেন। রাত সাড়ে আটটার দিকে বাড়িতে আমার আপন কাকাকে ফোন করলাম আমাদের পারিবারিক কবরস্থানে কবর খোঁড়ার জন্য। তিনি আমাকে জানালেন, বাড়ির পরিস্থিতি ভালো নয়, সবাই একযোগে নিষেধ করছে বাড়িতে তারা দাফন করতে দিবে না, তোমরা বরং চাঁদপুর পৌর কবরস্থানে দাফনের ব্যবস্থা করো। আমি বললাম, এটা কী করে হয়? আমি জানতে চাইলাম, কী কারণে বাড়িতে দাফন করতে পারবো না? তিনি জানালেন, কোনো করোনা রোগীকে বাড়িতে দাফন করতে দিবে না। এমন পরিস্থিতির জন্যে আমি প্রস্তুত ছিলাম না। আমি যেহেতু চাঁদপুর প্রেস ক্লাবের সম্মানিত সদস্য, তাই ইতোমধ্যে আমার সাংবাদিক সহযোদ্ধারা সমবেদনা জানাতে শুরু করলো। আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু প্রেসক্লাবের সভাপতি ইকবাল হোসেন, সাধারণ সম্পাদক এএইচএম আহসান উল্লাহ, সোহেল রুশদী, রহিম বাদশা, গিয়াসউদ্দিন মিলন এবং প্রথম আলোর জেলা প্রতিনিধি আলম পলাশসহ সবাই সমবেদনা জানালো এবং খোঁজ খবর নিতে থাকে। আমি বাড়ির সমস্যাটির কথা তাদের জানালাম। তারা সবাই প্রশাসনের সাথে কথা বললো। আমার খালাতো ভাই রতন ঢাকা থেকে চাঁদপুরের প্রশাসনকে অনুরোধ জানান। বড় ভাইয়ের বন্ধু ব্রিগেডিয়ার তারিক ও মানিক ভাই চাঁদপুরের সেনা কমান্ডার মেজর খাইরুলকে বিষয়টি অবহিত করেন। আমার বন্ধু পুলিশের ডিসি (ট্রান্সপোর্ট) জোবায়েদুর রহমান বাবু চাঁদপুরের এসপিকে ফোন করে সহযোগিতার অনুরোধ করে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না। একেতো লকডাউন চলছিল তার ওপর রাতের বেলা। রাত ১১টার সময় আবার আমি বাড়িতে ফোন দেই। কাকা জানালেন তাকে এবং আরেক চাচাতো ভাইকে বাড়ির লোকজন অবরুদ্ধ করে রেখেছে এবং শাসিয়ে গেছে যেন বাড়িতে লাশ দাফন করতে না আনে। গ্রামবাসীরা ইতোমধ্যে বাড়িতে প্রবেশের প্রধান সড়কে বড় বড় কাঠের গুঁড়ি ফেলে সড়ক বন্ধ করে দেয় এবং মাঝ রাতে প্রায় এক দেড় হাজার লোক সড়কে অবস্থানগ্রহণ করে। রাতের বেলা আমি আবারও বাড়িতে ফোন দিলে কাকা একই কথা পুনর্ব্যক্ত করলে আমি উত্তেজিত হয়ে কারা বিরোধিতা করছে তাদের নাম জানতে চাই এবং ওনাকে বলি, আপনি কি দেখতে চান এসপি সাহেব নিজে এসে দাফন কাজ সম্পন্ন করে যাবেন? আমি যখন এসব কথা বলছিলাম কাকা তখন মাঝ উঠানে বিরোধিতাকারীদের দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিলেন এবং তিনি ফোনের লাউড স্পিকারে কথা শুনছিলেন। আমার কথা শুনে তারা এবার কিছুটা ভয় পায় এবং পিছু হটতে থাকে। এদিকে আমার পরিবারের সদস্যরা ঝামেলা এড়াতে পৌর মেয়র নাছির মামার পরামর্শে পৌর কবরস্থানে দাফনের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে আমাকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাগ্রহণের পরামর্শ দেয়। আমি বললাম, আমাকে শেষ চেষ্টাটা অন্তত করতে দেন। আমি ব্যর্থ হলেতো পৌর কবরস্থানেই দাফন করতে হবে। আমি আবার প্রশাসনের সহযোগিতা চাইলাম। ইতোমধ্যে পুলিশের একটি দল রাত ১২টার সময় বাড়িতে যায় এবং এলাকাবাসীকে শাসিয়ে আসে যাতে তারা কোনো বিশৃঙ্খলা না করে। এরপর বিরোধিতাকারীদের একটি দল এসে আমার কাকাকে কবর খোঁড়ার অনুমতি দেয়। তবে শর্ত থাকে যে, কবরস্থানের সামনের দিকে আব্বা-আম্মার জন্য নির্ধারিত স্থান বাদ দিয়ে ভিতরের দিকে কবর করতে হবে। আমি কাকাকে বললাম, যেখানেই হোক শুধু কবরস্থানে হলেই হবে। আপনি কাজ চালিয়ে যান।

এরপর রাত দেড়টার দিকে আমরা দুই এম্বুলেন্স যোগে জেলা শহর থেকে মাত্র ৫ কিলোমিটার দূরে গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই। একটিতে আমি আর আমার মায়ের মৃতদেহ, অন্যটিতে ইসলামী আন্দোলনের দল। চারিদিকে সুনসান নীরবতার মধ্য দিয়ে জানাজা শেষ করে দাফন সম্পন্ন করে রাত তিনটায় আবার ফিরে আসি বাসায়। আসার পর সবার সাথে কথা বলে আমি আব্বার বিছানার কাছে যাই। আব্বার চোখে ঘুম নেই, কী যেন বিড় বিড় করে বলে চলেছেন। আমি কিছুক্ষণ অবস্থান করে আব্বার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গোসলের উদ্দেশ্যে চলে আসি। সেহরি শেষে ইতোমধ্যে ফজরের আজান হয়ে গেলে আমি নামাজ শেষ করে বিছানায় শুতে যাব এমন সময় ভাতিজি সামিয়া এসে খবর দিলো, চাচ্চু দাদাও নেই। উপর্যুপরি দুটি ঘটনায় আমি হতবিহ্বল হয়ে পড়ি। কী এক অবিশ্বাস্য মুহূর্ত পার করেছি তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। ছোট বেলায় পাঠ্য পুস্তকে পড়েছিলাম ‘অল্প শোকে কাতর অধিক শোকে পাথর’। এ কথার মর্মার্থ কখনো উপলব্ধি করতে পারিনি। তবে সে মুহূর্তে তা খুব গভীরভাবেই উপলব্ধি করতে পেরেছি। আবারও সেই ইললামী আন্দোলন বাংলাদেশের নেতা-কর্মীদের শরণাপন্ন হলাম এবং তাদের সহায়তায় বাদ জোহর যথারীতি আব্বাকেও মায়ের পাশেই জানাজা শেষে দাফন করে আসলাম। কী অদ্ভুত লাগলো, বাড়ির একটি লোকও শরীক হল না। এমনকি বাড়ির কবরস্থানের পাশে যে মসজিদ সে মসজিদে জোহরের আজানও দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সেদিন কেউ আসেনি, তাই জামাতও হয়নি। জানাজার সময় মসজিদের ইমাম সাহেব পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন, কিন্তু জানাজায় অংশ নিলেন না। তাকে জিজ্ঞসা করলে তিনি শুধু হাসলেন। জানি না তার এ হাসির রহস্য কী ছিল।

জীবন তো চলমান। চলার পথে ছড়িয়ে যায় অজস্র অশ্রু, বেদনার স্মৃতি। যদি বেঁচেই থাকি আরো কিছুটা সময়, তবে অনেক বছর পর সেই সব স্মৃতির সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের মনে পড়ে যাবে, পৃথিবীতে একদিন করোনা এসেছিল, কেড়ে নিয়েছিল অসংখ্য প্রাণ, ফুটিয়েছিল লাখ লাখ বেদনার ফুল। মনে পড়ে যাবে, অদৃশ্য এক শত্রুর সঙ্গে কী ভীষণ লড়াই করেছিলাম আমরা! কী অসীম ছিল তার শক্তি! প্রায় তছনছ করে ফেলেছিল পুরো পৃথিবীকে। কেড়ে নিয়েছিল বিশ্বের বুক থেকে ১৮ লাখেরও বেশি মানুষের প্রাণ। হারিয়ে যাওয়া সেই লাখ লাখ মানুষের ভিড়ে আমারও দুজন আপনজন আছেন, সে কথাও মনে পড়ে যাবে। এখন যেমন প্রতিদিনই মনে পড়ে। আপনজন দুজন আমার পরম প্রিয় বাবা আর স্নেহময়ী আমার মা।

মোঃ আনোয়ার হাবিব কাজল : সম্মানিত সদস্য, চাঁদপুর প্রেসক্লাব; ঊর্ধ্বতন সহকারী পরিচালক (জনসংযোগ), ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়