প্রকাশ : ২৯ আগস্ট ২০২১, ০০:০০
পর্ব-২৪
ছোটবেলায় পড়েছি বিদ্যা বিনয়দান করে। বিনয়ী হলে বন্ধু-বান্ধব হয়। বন্ধু-বান্ধবের সাথে আসে ধন, মান, যশ। এখন আমাদের সমাজে কথিত বিদ্যা মানুষকে বিনয়ী না করে করে তুলেছে অহংকারী। কোনো কোনো ক্ষেত্রে উচ্চাভিলাষী । বিদ্যাদান ও বিদ্যাগ্রহণের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে ছাত্র-শিক্ষকের নিবিড় সম্পর্ক। শিক্ষক ছাত্রদের সামনে যে জ্ঞান-প্রদীপ জ্বালিয়ে দেন তারই আলোতে ছাত্র খুঁজে পায় নতুন জীবনের ঠিকানা। শিক্ষকের অকৃত্রিম ভালোবাসা আর ছাত্রের অপরিসীম শ্রদ্ধায় এই পবিত্র সম্পর্ক অনাবিল সৌন্দর্যে বিকশিত হয় সমাজ। পিতা-মাতার সন্তানকে মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলে শিক্ষক মাতা-পিতার মর্যাদায় আসীন হন। নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক জ্ঞানদানের সাথে ছাত্রের জীবনের বিকাশসাধন করে, ছাত্রের ব্যক্তিত্বেরও জাগরণ ঘটিয়ে থাকেন। অন্যদিকে অধ্যবসায়ী শিক্ষার্থী, শিক্ষকের কাছ থেকে পেতে পারে মনের খোরাক। ছাত্র-শিক্ষকের এই সম্পর্ক আবহমানকাল ধরে চলছে। ছাত্র শিক্ষক সম্পর্কের মধ্যে একটি আন্তরিকতার সুর ও পরম সুখ রয়েছে। একজন শিক্ষক পিতামাতার সমমর্যাদায় আসীন হন তার শিক্ষক সুলভ ভূমিকা রেখে। ছাত্র-শিক্ষকের ভূমিকার ওপর সম্পর্কের প্রকৃতি নির্ভর করে। শিক্ষকের নির্দেশনায় ছাত্ররা শিক্ষার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছার চেষ্টা করে। শিক্ষকের কল্যাণধর্মী আচরণে ছাত্রের জীবন বিকশিত হয়। ছাত্র-শিক্ষকের পরম পবিত্র সম্পর্ক মহত্ত্বের এক অনাবিল সৌন্দর্যের বিকাশ ঘটায়। সম্পর্ক যখন পবিত্র হয় তখন ছাত্রের জীবন হয় সার্থক ও মহিমান্বিত।
অতীতে শিষ্যরা গুরুগৃহে অবস্থান করে বিদ্যার্জনের পাঠ গ্রহণ করতো এবং পাঠ শেষে গুরু জ্ঞান অর্জন করে গুরু দক্ষিণা দিয়ে নিজগৃহে ফিরে আসতো। প্রাচীন ভারতে ও গ্রিসে ছাত্র-শিক্ষকের এরূপ অসংখ্য দৃষ্টান্ত রয়েছে। বর্তমানে বাউল ও সুফী সাধনায় গুরু-শিষ্য সম্পর্কটি অত্যন্ত মর্যাদার সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত। শিক্ষক তাঁর মেধা দিয়ে শিক্ষার্থীর মনে কৌতূহল জাগিয়ে তোলেন, জ্ঞান আহরণের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, কৌতূহল জাগানো এবং কৌতূহল নিবৃত্ত করা শিক্ষকের কাজ। তিনি ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ককে পরস্পর নির্ভর ও সৌহার্দ্যমূলক সম্পর্ক হিসেবে বিচার করেছেন। অথচ আজ ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক অনেকটা তিক্ততায় পর্যবসিত। ছাত্র-শিক্ষকের সেই মধুর সম্পর্ক আজকাল আর খুব একটা দেখা যায় না। সময়ের পরিক্রমায় শিক্ষকের মানসিকতায় ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। এখন ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে দেয়া-নেয়ার পর্যায়ে। বর্তমানে শিক্ষার বহুমুখী বিপণনে ব্যস্ত ছাত্র ও শিক্ষক। এরূপ বাজার-ব্যবস্থায় শিক্ষক বিক্রেতা আর ছাত্র আজ ক্রেতার ভূমিকায় নেমেছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে অভিভাবক। একটা সময় ছিল পিতামাতা সন্তানকে গুরুগৃহে পাঠিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতেন। এখন অনেক সময় শিক্ষক ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।
এখন নামী-দামী শিক্ষকের কাছে জ্ঞানার্জন করতে বেশি টাকা খরচ করতে হচ্ছে । অন্যদিকে যাদের আর্থিক সঙ্গতি কম সে ধরনের অভিভাবকের সন্তানরা এ সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। নামে বেনামে গড়ে উঠেছে নানা ধরনের কোচিং সেন্টার। এদের বাহারি বিজ্ঞাপনে শিক্ষকের প্রকৃত আদর্শ হারিয়েছে। কতিপয় ক্ষেত্রে শিক্ষকতা এখন মুনাফাখোর পেশায় পরিণত হয়েছে। কিছু কিছু শিক্ষক নামধারী বিবেকহীন পরীক্ষার হলে ছাত্রদের দিচ্ছে বাড়তি সুবিধা। অন্যদিকে কতিপয় ছাত্র এবং অভিভাবক শিক্ষককে কেনা গোলামের মতো ভাবছে। সুযোগ সুবিধা না দিলে শিক্ষক ছাত্র দ্বারা লাঞ্ছিত হচ্ছে। কিছু ছাত্র নামধারী সন্ত্রাসী যেমন পবিত্র শিক্ষাঙ্গনকে কলুষিত করছে তেমনি পরম গুরুজন শিক্ষককে অপমান করতেও দ্বিধা করছে না। জাতির জীবনে এই অমানিশার ঘোর চলছে।
বিদ্যাদান এবং গ্রহণের বেলায় ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্কটা এখন আর্থিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান এখন ব্যবসা কেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশে এখন নামীদামী যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে তার সবক’টিই ব্যবসায়িক মনোভাব নিয়ে গড়ে উঠেছে। শিক্ষাকে পণ্য হিসেবে তারা বাজারজাত করছে। এগুলোকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না বলে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বল্লে অত্যুক্তি হবে না । যার ফল পড়ছে সমাজে। এ সমস্ত প্রতিষ্ঠান থেকে যে সকল শিক্ষার্থী বের হয়ে আসে, তাদের বিরাট অংশের মাঝে মানবিক মানুষের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না। নতুন নতুন যে সমস্ত প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে সেগুলোর অধিকাংশই সমাজের প্রয়োজনে নয় বরঞ্চ ব্যক্তি এবং আর্থিক প্রয়োজনে গড়ে উঠেছে। প্রতিষ্ঠান যদি মানবিক না হয় তবে সে প্রতিষ্ঠান থেকে যে শিক্ষার্থীরা বের হবে তাদের কাছ থেকে মানবিকতা আশা করা বোকামি।
একটা সময়ে শিক্ষালয়গুলোতে গুরু-শিষ্যের মধ্যে একটি অনাবিল সম্পর্কের বিকাশ ঘটতো। গুরু শিষ্যকে সর্বোত্তম জ্ঞান দিয়ে গড়ে তুলতো। নিজের বিদ্যা শিষ্যকে দান করে গুরু শিষ্যের মধ্যেই বেঁচে থাকতেন। সেই সময়ে গুরু শুধুমাত্র শিষ্যকে পুঁথিগত বিদ্যাই শেখাতেন না, শিষ্যকে একজন প্রকৃত মানবিক মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে শিষ্যের মাঝে মানবিকতা সঞ্চারিত করতেন। সততার শিক্ষা দিতেন, পরমতসহিষ্ণুতার শিক্ষা দিতেন। গুরুর আত্মতৃপ্তি হতো শিষ্যের মানবিকতা দেখে। শিষ্যের ব্যথায় যে গুরু ব্যথিত হয় না সে গুরুর কাছ থেকে শিষ্য প্রকৃত শিক্ষা পায় না।
অতীতের ছাত্র শিক্ষকের সম্পর্কের অস্তিত্ব এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না। বর্তমান সময়ে আমরা আধুনিক হয়েছি। ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্কেও আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিভিন্ন ধরণের প্রতিষ্ঠান। এখন শিক্ষক শিক্ষার্থী সম্পর্ক আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। বর্তমানে শিক্ষকের কর্তব্যবোধ হয়েছে সংকুচিত এবং শিক্ষার্থীর জানার পরিধি হয়েছে সীমিত। এখন অর্থ দিয়ে বিদ্যা কেনা হয়। অর্থ লোভের কারণে শিক্ষক এখন শিক্ষার্থীর গৃহে ছুটে যান। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রূপ নিয়েছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। শিক্ষকের মানবিকতা লোপ পেয়েছে। অর্থের বিনিময়ে এখন ছাত্র ভর্তি করা হয়। শিক্ষার্থীকে দিতে হয় উচ্চ বেতন। অর্থের প্রতিযোগিতায় শিক্ষা তার সার্বজনীনতা হারিয়েছে। অর্থের কারণে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের স্বাভাবিকতা নষ্ট হয়েছে। অনেক শিক্ষক এখন শ্রদ্ধা পাওয়ার আশা বিসর্জন দিয়ে অর্থ পাওয়ার আশাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। শিক্ষা ব্যবস্থায় যে অনাচার প্রবেশ করেছে তাতে তিক্ত হয়ে উঠছে অভিভাবক, শিক্ষক ও ছাত্র সম্পর্ক।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এমন কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছড়িয়ে আছে, যেগুলোকে মুনাফাখোরি প্রতিষ্ঠান বলা যায়। শিক্ষার্থীদের কল্যাণের চেয়ে তারা শিক্ষার্থীদেরকে তাদের অর্থ লাভের অনুষঙ্গ হিসেবে মনে করে। এতে করে অসচ্ছল পরিবারগুলোর শিক্ষার্থীরা অনেক সময় ঝরে পড়ে। আমি এমন অনেক প্রতিষ্ঠান দেখেছি, যেগুলোর মাঝে মানবিকতার বিন্দুমাত্র লেশ নেই। শিক্ষার্থীর কল্যাণের পরিবর্তে তারা প্রতিষ্ঠানের কল্যাণ কামনা করে। যার প্রভাব পড়ে অসচ্ছল পরিবারের সন্তানদের ওপর।
একজন শিক্ষক হিসেবে আরেকটি বিষয় আমাকে খুব ব্যথিত করে, যা হলো শিক্ষকদের চারিত্রিক দিক ও নৈতিকতা। প্রায়ই যখন সংবাদ মাধ্যমে দেখি, শিক্ষকের নৈতিকতা নিয়ে সংবাদের শিরোনাম করা হয়েছে, তখন লজ্জা পাওয়া ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। এমন কিছু শিক্ষকের জন্যে পুরো শিক্ষক সমাজের মাথা হেঁট হয়ে যায়।
ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের এই ন্যাক্কারজনক অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটানো না গেলে মানবিক মানুষ তৈরি করা কষ্টসাধ্য হবে। ছাত্র-শিক্ষকের যৌথ আয়োজনে শিক্ষাঙ্গনকে সত্যিকারের জ্ঞানচর্চার পাদপীঠ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। শিক্ষাঙ্গনকে সত্যিকারের পড়ালেখার কেন্দ্র হিসেবে রূপ দিতে হবে। শিক্ষককে তার আসল ভূমিকায় ফিরে আসতে হবে। আদর্শ ও নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক তাঁর জ্ঞান শিক্ষার্থীর মাঝে সঞ্চারিত করে নিজেকে দেবতুল্য মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করতে পারেন। একজন শিক্ষকের সবসময় মনোযোগ থাকবে ছাত্রের কল্যাণ কামনায়।
ছাত্র-শিক্ষকের সত্যিকারের সম্পর্ক ফিরিয়ে আনতে সর্বস্তরের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে সমস্ত অবৈধ কার্যকলাপ থেকে মুক্ত রাখতে হবে। আর তখনই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান একটি আদর্শ প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠবে। ছাত্র-শিক্ষকের সুসম্পর্কে জাতি লাভ করবে সুযোগ্য উত্তরাধিকারী। রাষ্ট্রকে এ ব্যাপারে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। ছাত্র-শিক্ষকের সুসস্পর্কের মধ্য দিয়েই নির্মিত হবে ভবিষ্যতের সমৃদ্ধ বাংলাদেশ।