শুক্রবার, ৩১ জানুয়ারি, ২০২৫  |   ২০ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   হাইমচরে মাটি বোঝাই বাল্কহেডসহ আটক ৯
  •   কচুয়ায় কৃষিজমির মাটি বিক্রি করার দায়ে ড্রেজার, ভেকু ও ট্রাক্টর বিকল
  •   কচুয়ায় খেলতে গিয়ে আগুনে ঝলসে গেছে শিশু সামিয়া
  •   কচুয়ায় ধর্ষণের অভিযোগে যুবক শ্রীঘরে
  •   ১ হাজার ২৯৫ কেজি নিষিদ্ধ পলিথিন জব্দ করেছে কোস্ট গার্ড

প্রকাশ : ২৯ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০

মোবাইল ফোন আশীর্বাদ নাকি অভিশাপ
ড. এম মেসবাহউদ্দিন সরকার

পৃথিবীর সকল প্রযুক্তিই মানুষের কল্যাণের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এলেও কখনো কখনো এর অপব্যবহার বয়ে আনে অভিশাপ। ভালো-মন্দ, উপকার-অপকার সবকিছুই নির্ভর করছে কীভাবে এটিকে ব্যবহার করা হয়, তার ওপর। বর্তমান সময়ে সকল নাগরিকের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি হচ্ছে মোবাইল ফোন। এর উপকারিতার কথা বলে শেষ করা যাবে না। দৈনন্দিন জীবনে সব কাজের সঙ্গে মোবাইল ফোন এমনভাবে জড়িয়ে আছে যে, এটি ছাড়া একমুহূর্তও চলা দায়। এর সবচেয়ে বড় সাফল্য হচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্যে, লেনদেনে, পরস্পরের মধ্যে যোগাযোগে এবং সর্বোপরি ইন্টারনেটের কল্যাণে জরুরি তথ্য-উপাত্ত সন্ধানে। এসব ছাড়াও ফেসবুক, টিকটক, ভিডিও গেম, লেখাপড়াসহ নানা কাজে এর ব্যবহার দিন দিন বেড়েই চলেছে। তবে অপ্রয়োজনেও এই ফোন ব্যবহৃত হচ্ছে, যা জনজীবনে কল্যাণের স্থলে অকল্যাণ বয়ে আনে।

দুনিয়াব্যাপী ঘরে-বাইরে, হাটে-বাজারে, বাসে-ট্রেনে সর্বত্র মানুষের দৃষ্টি শুধুই স্মার্টফোনের রঙিন স্ক্রিনে, কিন্ডার গার্টেনের পড়াশোনা, হোম ওয়ার্ক, ডায়রিতে ক্লাসের সিডিউল ইত্যাদি করোনার আগেও হাতে লিখে করানো ও জমা দিতে হতো, করোনা চলে গেলেও এখনো অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এগুলো চলছে অনলাইনে। এমনিতেই শিশুদের মোবাইল আসক্তি থেকে ফেরানো কঠিন। তার ওপর এই চর্চা শিশুদের জীবনকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ছোট শিশুদের খাওয়াতে কিংবা পড়াতে সর্বক্ষণিক মোবাইল স্ক্রিনের সামনে ভিডিও গেম চালিয়ে করতে হয়।

এতে মোবাইল ফোনের রেডিয়েশন অল্প বয়সেই শিশুদের চোখের দৃষ্টি কেড়ে নিচ্ছে। একই অবস্থা বড়দের ক্ষেত্রেও। অনেকে রাতে বিছানায় আলো নিভিয়েও হাতে স্মার্টফোন ব্যবহার করেন। এর বিপদ আরও মারাত্মক। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অন্ধকারে স্মার্টফোনের আলো অন্ধত্ব পর্যন্ত ডেকে আনতে পারে। শুধু তাই নয়, এই অভ্যাস চোখের পাশাপাশি মস্তিষ্কের ওপরও চরম বিরূপ প্রভাব ফেলে। ফলে শরীরের বাকি অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলোও নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

স্মার্টফোনের নীল আলো শরীরে মেলাটোনিন নামের হরমোন উৎপাদনে বিরূপ প্রভাব ফেলে। মোবাইল ফোন থেকে সে নীল আলো ছড়ায়। রুমের লাইট নিভিয়ে দেওয়ার কারণে রাতে সেটি আরও তীক্ষè হয়। মেলাটোনিন মূলত এমন একটি হরমোন, যা রাতেরবেলা নিঃসৃত হয়ে শরীরকে ঘুমিয়ে পড়ার নির্দেশ দেয়। কিন্তু অতিরিক্ত মোবাইল ব্যবহারের কারণে মেলাটোনিনের অভাব দেখা দেয় এবং ঘুমের স্বাভাবিক ব্যত্যয় ঘটায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, স্মার্টফোনের নীল নিঃসরণ দিনের প্রখর আলোতেও আমাদের ফোনের পর্দা স্পষ্টভাবে দেখতে সাহায্য করে। এই নীল আলো ভিজিবল লাইট স্পেকট্রামের অন্তর্ভুক্ত। এর ফলে রাতে ফোন ব্যবহার করলে মস্তিষ্ক এই নীল আলোকরশ্মির কারণে ধাঁধায় পড়ে যায় এবং একে দিনের আলো হিসেবে ধরে নেয়, যা ঘুমের জন্য মোটেও উপযুক্ত নয়।

মোবাইল ফোনের সঠিক ব্যবহার না করলে আরও যেসব ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে তা হলো :

১. স্বাস্থ্যের অবনতি, মোবাইল ফোনের দ্বারা নির্গত ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশনের দীর্ঘায়িত এক্সপোজারে মস্তিষ্কের টিউমার, অনিদ্রা এবং বিভিন্ন স্নায়বিক রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। ঘাড় এবং পিঠে ব্যথাসহ অনেক ধরনের শারীরিক দুর্বলতা দেখা দেয়। শ্রবণশক্তি কমে যায়, মনোসংযোগ কমতে থাকে, নেমোফোবিয়া হয়, ডিপ্রেশনের শিকার হয়, চিন্তাশক্তি হ্রাস পায়।

২. মোবাইল ফোন অধিক ব্যবহারের ফলে পরিবার, বন্ধু-বান্ধব এবং অন্যান্য সামাজিক সম্পর্কের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা দেখা দেয়।

৩. মোবাইল ফোন অতিরিক্ত ব্যবহারে নির্ভরতা এবং আসক্তি তৈরি হতে পারে, যা ব্যক্তিগত সম্পর্ক, কর্মক্ষমতা এবং মানসিক সুস্থতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

৪. ড্রাইভিং করার সময় অথবা রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলার সময় মোবাইল ফোন ব্যবহারে মারাত্মক শারীরিক নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়ে। রাতে ঘুমানোর সময় বিছানার পাশে চার্জরত অবস্থায় মোবাইল বিস্ফোরণ ঘটে। বর্তমানে রাস্তায় চলাচল করার সময় টেক্সট করা বা মোবাইল ফোনে কথা বলার কারণেও সড়ক দুর্ঘটনা বেড়ে চলছে।

৫. সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘন ঘন ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ার করা অথবা অবিশ্বস্ত অ্যাপের মাধ্যমে আর্থিক লেনদেন করার মাধ্যমে ব্যক্তিগত তথ্য হ্যাক হয়ে যেতে পারে, যা গোপনীয়তা ও নিরাপত্তার ঝুঁকি বৃদ্ধি করে।

৬. অনেক সময় ধরে একা একা মোবাইল ফোন ব্যবহার করার ফলে আজকাল বিশেষ করে কিশোর-কিশোরীরা পর্নো আসক্ত হয়ে পড়ছে।

৭. মোবাইল ফোনের প্রতি অধিক আগ্রহ বা আকর্ষণের ফলে অনেকের কাজে ও পড়ালেখায় ব্যাঘাত ঘটে, শিক্ষা ও দক্ষতার অবনতি ঘটে।

৮. অতিরিক্ত নেশা বা সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করা বা গেম খেলার জন্য অনেকেই স্মার্টফোনে বেশি দেখে, কিছুদিন পর পর নতুন নতুন ফিচার ক্রয় করে। ফলে বিপুল আর্থিক ক্ষতি হয়।

তবে একটু সচেতন হলেই এই ক্ষতি থেকে বাঁচার উপায় আছে। যেমন :

১. প্রয়োজন ছাড়া স্মার্টফোন ব্যবহার না করা। রাতে ঘুমানোর আগে ফোন ব্যবহার বন্ধ করা।

২. স্মার্টফোনের ব্যবহারের সময় প্রতি ১০ মিনিট পর পর কয়েকবার চোখের পলক কয়েক সেকেন্ড বন্ধ রাখা।

৩. স্মার্টফোন ব্যবহারের ফাঁকে ২০ মিনিট পর পর ২০ সেকেন্ডের জন্য আশপাশের সবুজ গাছ-পাতার ওপর দৃষ্টি দেওয়া।

৪. অতিরিক্ত আলো বা একেবারে কম আলো- দুটোই চোখের জন্য ক্ষতিকর। তাই আশপাশের পরিবেশের আলো অনুযায়ী ফোনের ব্রাইটনেস সেট করা।

৫. ব্যবহারকালে চোখ ও স্মার্টফোনের পর্দার মাঝে ১৬-১৮ ইঞ্চি দূরত্ব বজায় রাখা।

৬. ডিসপ্লে কালার সঠিকভাবে নির্ধারণ করা এবং স্ক্রিনের ওপর এন্টি গ্লাস প্রটেক্টর ব্যবহার করা।

৭. অধিক হারে গেম খেলা এবং মুভি দেখা থেকে বিরত থাকা।

৮. সোশ্যাল মিডিয়া অযথা স্ক্রোলিং করার অভ্যাস পরিহার করা।

৯. সম্ভব হলে মোবাইল ব্যবহারে একটি টাইমটেবিল তৈরি করা।

১০. মোবাইল ব্যবহারের সঠিক দিকগুলো সম্পর্কে নিজে এবং অপরকে সচেতন করা।

লেখক : অধ্যাপক, তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়