প্রকাশ : ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০
আলঝাইমার হলো মস্তিষ্কের এক ধরনের রোগ। এতে আক্রান্ত ব্যক্তি স্মৃতি শক্তি, মেধা, বিচার ক্ষমতা, যুক্তিসঙ্গত আবেগ, সামাজিক দক্ষতা হারাতে থাকে। এ রোগটি আবিষ্কার করেন জার্মান মানসিক রোগের চিকিৎসক আলঝাইমার। তাঁর নামানুসারে রোগটির নাম আলঝাইমার রাখা হয়েছে। আলঝাইমার রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির মস্তিষ্কের কোষগুলো সংকুচিত হতে থাকে, জট লাগে, ফলক বা অনাকাঙ্ক্ষিত স্তর পড়ে। মস্তিষ্কের যে অংশ আক্রান্ত হবে, রোগের লক্ষণ সেভাবেই প্রকাশ পাবে।
সব বয়সী মানুষের এই রোগ হবার সম্ভাবনা থাকে, তবে ৬৫ বছরের অধিক বয়সী মানুষের মধ্যে বেশি দেখা যায়। পুরুষের চাইতে নারীর বেশি আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা আছে।
উন্নত দেশগুলোতে আলঝাইমার রোগ নিয়ে গবেষণা চলছে। আক্রান্ত ব্যক্তির জীবনমান বজায় রাখতে নানান রকমের কৌশল অবলম্বন করা হচ্ছে। অনিরাময়যোগ্য এ রোগটি একজন মানুষের ব্যক্তি জীবন অসংগঠিত করে দেয়। পাশাপাশি পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রের ওপর আর্থিক ও নৈতিক দায় সৃষ্টি করে। বাংলাদেশে কত লোক আলঝাইমার রোগে আক্রান্ত হয়েছেন তা কেউ বলতে পারবেন না। অনুমান করে একটা সংখ্যা দাঁড় করিয়ে দেয়া হলে সেটা গ্রহণযোগ্য হবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে।
আলঝাইমার রোগের সাধারণত তিনটি পর্যায় আছে। প্রথম পর্যায়ে, এ রোগের সূত্রপাত হয় খুবই ধীরগতিতে। প্রায় অনেকেই প্রথম দিকে বুঝতে পারেন না যে তিনি এই ধরনের একটি রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। শুরুতে ব্যক্তি একটু বেশি উদাসীন হয়ে থাকেন। কোনো কিছুতেই আগ্রহ বোধ করেন না। ব্যক্তির মাঝে কোনো আনন্দ লক্ষ্য করা যায় না। মেজাজটা প্রায় বিগড়ে যায়। খুব বেশি খিটখিটে হয়ে পড়েন। একটুতেই হতাশা প্রকাশ করতে থাকেন। কথা গুছিয়ে বলতে পারেন না, সঠিক শব্দ বা বাক্য ব্যবহারে বিলম্ব করেন। নিজকে নিয়ে বেশি ব্যস্ত হয়ে উঠেন। একই কথা বার বার বলেন। চিন্তা-ভাবনা দ্রুত করতে পারেন না। প্রতিদিনের কাজকর্ম শেষ করতে বিলম্ব হয়। বর্তমানে ঘটে যাওয়া ঘটনা মনে করতে পারেন না। কিন্তু অতীতের ঘটনা স্পষ্ট মনে করতে পারেন। টাকা-পয়সার হিসাব রাখতে পারেন না। প্রায়ই টাকা-পয়সা হারিয়ে ফেলেন। টাকা-পয়সা কেউ নিয়ে গেছে বলে সন্দেহ করার প্রবণতা তৈরি হয়। নিয়মিত ওষুধ-পথ্য সেবন করতে ভুলে যান। নামাজ পড়েছেন কি না মনে করতে পারেন না। শখের জিনিসপত্র কাউকে দিয়ে দেন কিংবা শখের জিনিপত্রের প্রতি আগ্রহ বোধ করেন না। এমন সব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, যা নিজের জন্যে অথবা পরিবারের জন্যে ক্ষতিকর। পরিবার-পরিজনকে অসন্তুষ্ট করে এমন কাজ করেন। ক্রমেই নিস্তেজ হয়ে পড়েন।
দ্বিতীয় পর্যায়ে রোগীর কিছু কিছু সক্ষমতা অক্ষুণ্ণ থাকে। তবে বেশির ভাগই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায়। রোগীর সেন্স যেমন, স্পর্শ শোনার ক্ষমতা, স্নেহের দৃষ্টি, হাসি মুখ, এসব আবেগে সাড়া দেবার ক্ষমতা অক্ষুণ্ণ থাকে ঠিকই। স্থান এবং সময় সম্পর্কে বিভ্রান্তি দেখা দেয়। পরিবারের সদস্য এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধবদের নাম মনে করতে পারেন না। আপনজনদের চিনতে পারে না। নিজের ঘর কোন্টা তা বুঝতে বা চিনতে না পারেন না।
অতীতের কথা মনে করতে পারেন, কিন্তু কিছুক্ষণ আগের ঘটনা ভুলে যান কিংবা মনে করতে পারেন না, রাতের বেলা ঘর থেকে বের হয়ে যান। হাত না ধুয়ে খেতে বসা, খাবার খেতে খেতে হঠাৎ করে খাবার রেখে উঠে যাওয়া, রাতে লাইট না জ্বালিয়ে ঘরে হাঁটতে থাকা, চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে ঘরের বাইরে চলে যাওয়া-এমন লক্ষ্মণও দেখা দেয়।
রোগী বলতে শুরু করেন তাকে কেউ মেরে ফেলতে চায়, তার কাছে জি¦ন-ভূত এসেছিলো। কেউ বলেন, তার আধ্যাত্মিক শক্তি রয়েছে। অনেক আগে মৃত মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজনরা দেখা করতে এসেছেন বলে জানান। আবার কেউ কেউ বলেন, তিনি অনেক যোগ্য কিন্তু তার সঠিক মূল্যায়ন হয়নি, ষড়যন্ত্র করে আটকে রেখেছে। সবাই তার ক্ষতি করবার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অপরিচ্ছন্ন থাকা, ময়লা কাপড়-চোপড় পরা, হতাশা প্রকাশ করা ইত্যাদিও লক্ষ্মণ। এঁরা মাঝে মধ্যে উত্তেজিত হয়ে সহিংস আচরণ করেন।
শেষ পর্যায়ে রোগী নিজে নিজের যত্ন নিতে পারেন না। নিজের মা-বাবা, স্বামী-স্ত্রী, ছেলেমেয়ে, ভাই-বোনকে পর্যন্ত চিনতে পারে না। কথা-বার্তা বোঝার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন। গোসল করা, টয়লেট ব্যবহার, কাপড় পরিধান, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ক্ষেত্রে কারো সাহায্য ছাড়া করতে পারেন না। খাবার চিবিয়ে খেতে পারেন না, মুখে খাবার নিয়ে বসে থাকেন, বেশি খাবার গ্রহণ করেন, খাবার খেয়ে উঠে আবার খেতে চান। দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার্য জিনিসপত্র চিনতে পারেন না। হাঁটাচলা করতে পারেন না। রাতে নানা রকমের সমস্যা তৈরি করেন। কখনো কখনো আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেন, অসংযত আচরণ করেন। এসময় রোগীর সংক্রমণ, জ্বর, ব্যথা-বেদনা, কোষ্ঠকাঠিন্য, রক্তশূন্যতা, পুষ্টিহীনতা, ডিহাইড্রেশন ইত্যাদি দেখা দিতে পারে।
আলঝাইমার রোগের চিকিৎসা আবিষ্কার হয়নি। বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানি নানা রকমের প্রচারণা চালায়। এতে মনে হতে পারে চিকিৎসা অতি নিকটে। অনেক সময় রোগীর আত্মীয়-স্বজনরা প্রতারণার শিকার হন।
আলঝাইমার রোগীকে কীভাবে সেবা দেওয়া যায় সে বিষয়ে আমাদের তেমন কোনো প্রস্তুতি নেই। সাধারণত পরিবারের সদস্য, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশী, গৃহকর্মীরা এই রোগীর সেবা দিয়ে থাকেন। দীঘমেয়াদী সেবা প্রদান কঠিন, ক্লান্তিময়, বিরক্তিকর হতে পারে। তাই সেবাদানকারীকে প্রশিক্ষিত, ধৈর্যশীল-সহনশীল, সংবেদনশীল ও কৌশলী হতে হবে। রোগীর দরকার সযত্ন সেবা, অকৃত্রিম ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা। সেবা-যত্নের জন্যে পর্যায়ক্রমে সার্বক্ষণিক সেবা-কর্মীর প্রয়োজন। রোগীকে ব্যায়াম করানো, পছন্দের কাজ করতে সহায়তা করা, বই পড়ে শোনানো, গান শুনতে দেয়া, পছন্দের খাবার খেতে দেয়া, বেড়াতে নিয়ে যাওয়া, খেলাধুলা করতে সহায়তা করা, শিশুদের সাথে কথা বলতে বা খেলতে দেয়া, বন্ধুদের সাথে নিয়মিত আড্ডার ব্যবস্থা করা, শখের কাজ করতে দেয়া, আপনজনের সাথে দেখা সাক্ষাৎ করিয়ে দেয়া, ঘরে পর্যাপ্ত আলো-বাতাসের ব্যবস্থা করা, হাত-পা ম্যাসেজ করে দেয়া, মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়া, হাসিমুখে সামনে দাঁড়ানো, স্পর্শ করা, কপালে চুমু দেয়া, ডায়েরি লিখতে দেয়া, পুরোনো ডায়েরি পড়তে দেয়া, ছবির অ্যালবাম খুলে দেখানো, আদরের চাহনিতে তাকানো, কোনো ধরনের প্রশ্ন না করা, নিজের পরিচয় আগে দেয়া, একাকী না রাখা এবং সদা সতর্ক থাকা খুবই জরুরি।
আলঝাইমার রোগ নিয়ে সচেতনতা কেনো দরকার? আমাদের সচেতনতা তৈরি হলে রোগী ঠিক সময়ে আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারবে। শুরুতেই রোগীকে সতর্কভাবে সেবা-যত্ন করা সম্ভব হবে। পরিবারের সদস্য, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনরা রোগীকে সহজভাবে গ্রহণ করতে পারবে। রোগী সর্বোচ্চ সেবা-যত্ন ও সহযোগিতা পাবে। পরিবারের সদস্যদের কাউন্সেলিং করে পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্যে যোগ্য করে তোলার সুযোগ পাওয়া যাবে।
পরিবারের আপনজনকে আমরা সর্বোচ্চ সেবা-যত্ন, সম্মান-মর্যাদা, ভালোবাসা-শ্রদ্ধা দিয়ে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সাথে থাকবো এই বোধটুকু তৈরি করতে হবে।
আলঝাইমার রোগের সেবা-যত্ন ও অন্যান্য রোগের চিকিৎসা দিতে বিশেষায়িত আলঝাইমার হাসপাতাল গড়ে তোলার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। এই হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দল নিশ্চিত করবে কারো আলঝাইমার রোগ হয়েছে কি না। অনেকটা বারডেম হাসপাতালের মতো।
২১ সেপ্টেম্বরকে আলঝাইমার দিবস আর পুরো সেপ্টেম্বর মাসকে আলঝাইমার মাস হিসেবে পালন করা হয়। আসুন, আমরা আলঝাইমার রোগ সম্পর্কে সচেতন হই।