বুধবার, ০৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫  |   ২৭ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   হাইমচরে মাটি বোঝাই বাল্কহেডসহ আটক ৯
  •   কচুয়ায় কৃষিজমির মাটি বিক্রি করার দায়ে ড্রেজার, ভেকু ও ট্রাক্টর বিকল
  •   কচুয়ায় খেলতে গিয়ে আগুনে ঝলসে গেছে শিশু সামিয়া
  •   কচুয়ায় ধর্ষণের অভিযোগে যুবক শ্রীঘরে
  •   ১ হাজার ২৯৫ কেজি নিষিদ্ধ পলিথিন জব্দ করেছে কোস্ট গার্ড

প্রকাশ : ১৮ জুলাই ২০২৩, ০০:০০

বেয়াদব ও কিছু কথা
ড. আব্দুস সাত্তার

বেয়াদব শব্দের অর্থ অভদ্র বা উচ্ছৃঙ্খল, আদবহীন, বেহায়া, লজ্জাহীন। অবাধ্য মানুষদের বেয়াদব বলে। যার আদব-কায়দা জানা নেই, যে বড়দের সম্মান করে না, বড়দের মুখের ওপর কথা বলে, যাকে যেটা বলার অধিকার তার থাকে না সেটাও বলে বসে, কথা বলার লাগাম থাকে না--এই ধরনের লোকদের বেয়াদব বলা হয়।

আদব শব্দটি আরবি শব্দ থেকে বাংলা ভাষায় বহুল ব্যবহৃত ও প্রচলিত শব্দ; যার অর্থ হলো : বিনয়, নম্রতা, ভদ্রতা, সভ্যতা, কৃষ্টি, সুশিক্ষা, নৈতিকতা, মানবিকতা, শোভনতা, শিষ্টাচার। আবার আদাব শব্দের অর্থ : নিয়মনীতি, পদ্ধতি ইত্যাদি। আর আদব-কায়দা মানে ভদ্র সমাজের রীতি-পদ্ধতি, ভদ্র ব্যবহার। অন্যভাবে বলা যায়, আদব-কায়দা মানে কাঙ্ক্ষিত শিক্ষা, সভ্যতা ও মার্জিত সংস্কৃতির দ্বারা আত্মগঠনের অনুশীলন করা। আর আমাদের দেশীয় ভাষায় বিনয়, নম্রতা, ভদ্রতা, সভ্যতা, কৃষ্টি, সুশিক্ষা, নৈতিকতা, মানবিকতা, শোভনতা ইত্যাদি গুণাবলি যে ব্যক্তির মধ্যে বিদ্যমান থাকে, তাকে ‘মুয়াদ্দাব’, শালীন, ভদ্র ও সুশিক্ষিত বলে। আর এসব গুণাবলি যার মধ্যে বিদ্যমান নেই, তাকে ‘বেয়াদব’, অশালীন, অভদ্র, অসভ্য বলে।

আল্লাহতায়ালা বলেন, তুমি আদব অন্বেষণ কর। কারণ, আদব হলো বুদ্ধির পরিপূরক, ব্যক্তিত্বের দলিল, নিঃসঙ্গতায় ঘনিষ্ঠ বন্ধু, প্রবাসজীবনের সাথী এবং অভাবের সময়ে সম্পদ। আর আদব বা শিষ্টাচার এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যার দ্বারা ব্যক্তির জীবন পরিশুদ্ধ ও পরিপাটি হয়; আর এ আদব হলো দ্বীন ইসলামের সারবস্তু; সুতরাং মুসলিম ব্যক্তির জন্যে জরুরি হলো আল্লাহতা’আলার সাথে, তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে এবং সাধরণ মানুষসহ সকল সৃষ্টির সাথে আদব রক্ষা করে চলা; আর এ আদবের মাধ্যমেই একজন মুসলিম জানতে পারবে তার খাবার ও পানীয় গ্রহণের সময় তার অবস্থা কেমন হওয়া উচিত; কীভাবে তার সালাম প্রদান, অনুমতি গ্রহণ, বসা, কথা বলা, আনন্দ ও শোক প্রকাশ করা, হাঁচি দেওয়া ও হাই তোলার মত বিবিধ কাজ সম্পন্ন হবে; আর কেমন ব্যবহার হবে তার পিতামাতা, ভাইবোন, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী ও বন্ধু-বান্ধবদের সাথে। এক কথায় এ আদব-কায়দা রক্ষা করে চলার মাধ্যমেই একজন মুসলিম কাঙ্ক্ষিত মানের ভদ্র ও সভ্য মানুষ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে এবং নিজেকে অন্যান্য জাতির চেয়ে ভিন্ন বৈশিষ্ট্যে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হবে; ফলে দ্বীন ইসলামের সৌন্দর্য ছড়িয়ে যাবে সমাজ, রাষ্ট্র ও দুনিয়ার দিক দিগন্তে। তাইতো কেউ কেউ শিক্ষার চেয়ে আদব বা শিষ্টাচারের বিষয়টিকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন : “তোমরা আগে সুসভ্য হও, তারপর জ্ঞান অর্জন কর।” আল-কারাফী তাঁর ‘আল-ফারুক’ গ্রন্থে বলেন : ''ব্যক্তি কোনো প্রকার জ্ঞান দ্বারা মহৎ হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে তার জ্ঞানকে আদব দ্বারা সৌন্দর্যমণ্ডিত করবে”।

মুসলিম ব্যক্তি তার প্রতি আল্লাহ তা’আলার অগণিত নিয়ামতের প্রতি লক্ষ্য করে; আরও লক্ষ্য করে ঐসব নিয়ামতের প্রতি, যেসব নিয়ামত তার মায়ের গর্ভে থাকাকালীন সময় থেকে শুরু করে তার রবের সাথে সাক্ষাৎ (মৃত্যু) করা পর্যন্ত দীর্ঘ সময় ধরে তাকে পরিবেষ্টন করে রেখেছে। ফলে সে তার নিজ মুখে তাঁর যথাযথ প্রশংসা ও গুণকীর্তন করার দ্বারা এবং তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসমূহকে তাঁর আনুগত্যের অধীনস্থ করে দেয়ার মাধ্যমে আল্লাহ তা’আলার শুকরিয়া আদায় করে; আর এটাই হলো তার পক্ষ থেকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার সাথে আদব। কেননা, নিয়ামতের অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা, অনুগ্রহকারীর অনুগ্রহকে অস্বীকার করা, তাকে এবং তার ইহসান ও অবদানকে অবজ্ঞা করাটা কোনো আদব বা শিষ্টাচরের মধ্যে পড়ে না। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেন : “তোমাদের নিকট যেসব নিয়ামত রয়েছে, তা তো আল্লাহর নিকট থেকেই এসেছে। তোমাদের কী হলো যে, তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বের পরোয়া করছ না। অথচ তিনিই তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন পর্যায়ক্রমে। তিনি আরও বলেন, আর তিনি জানেন তোমরা যা গোপন কর এবং তোমরা যা প্রকাশ কর।

কয়েকদিন আগে জুম্মার নামাজ পড়তে গিয়েছিলাম একটি হোটেলে। নিয়মমাফিক ইমাম খুতবা দিলেন। খুতবার পরে তিনি নামাজীদেরকে বললেন যে, যা পারেন আল্লাহর ওয়াস্তে নির্মাণাধীন মসজিদ/ মাদ্রাসার জন্যে সাহায্য করবেন। কথা শেষ না হতেই এক বাংলাদেশী দাঁড়িয়ে চিল্লান দিয়ে উঠে বলতেছে, আজ পাঁচ বছর ধরে টাকা তুলতেছেন! আপনাদের আর কতো টাকা লাগবে? এগুলো বন্ধ করেন এইবার। তখন নরম সুরে ইমাম সাহেব বললেন, আপনি নামাজের পরে আমাদের সাথে কথা বলবেন। আপনাকে বিস্তারিত জানাবো। নামাজের পরে আমি ইমাম সাহেবের কাছে জানতে চাইলাম, সেই ভদ্রলোক এসেছে কিনা। তিনি জানালেন, তিনি আসেন নি। তারপর ইমাম বলতেছিলেন, এই পাঁচ বছরে এই লোক এক পয়সাও দেয় নাই! প্রায়ই তিনি সাথে আরও কয়েকজন আছে এমন করে। মনে হয় যেন তাদের পকেটের পয়সাগুলো অন্যান্য লোক দিয়ে দিতেছে! আমি বললাম, ওনাদেরকে পুলিশে দেন না কেন? ইমাম সাহেব বললেন, দেখি যদি আল্লাহর রাস্তায় ফিরে আসে তাই। আর যদি দেখি আল্লাহর রাস্তায় ফিরে না এসে আরও উচ্ছৃঙ্খল হয় তখন পুলিশের কাছে দেওয়া ছাড়া আর কোনো পথ থাকবে না। আমাদের বড় প্রজেক্ট, তাই সবার কাছে সাহায্য চাই। এই দুনিয়ায় যত মসজিদ মাদ্রাসা হয়েছে সবই সবার সহায়তায় হয়েছে। দেশে শুনতাম বিভিন্ন মসজিদ মাদ্রাসায় সাহায্য সহযোগিতা চাইলেও ইমামদের সাথে এই ধরনের ব্যবহার করে। আর আজ দেখলাম প্রবাসে এসেও ওরা মানুষ হয়নি। আসলে কয়লা ধুইলে তার ময়লা যেমন যায় না, ঠিক এই ধরনের বেয়াদব বা উচ্ছৃঙ্খল লোকগুলো দুনিয়ার যেখানেই যাক না কেন পরিবর্তন হবে না। এক আল্লাহ পারেন পরিবর্তন করতে।

পরিশেষে বলবো যে, কোনো মুসলিম ব্যক্তি কর্তৃক তার প্রতিপালকের নি’য়ামতের জন্য তাঁর শোকরিয়া আদায় করা, তাঁর অবাধ্যতার দিকে ধাবিত হওয়ার সময় তাঁকে লজ্জা পাওয়া, তাঁর কাছে সত্যিকার অর্থে তাওবা করা, তাঁর ওপর ভরসা করা, তাঁর রহমতের প্রত্যাশা করা, তাঁর শাস্তিকে ভয় করা, তাঁর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করার ব্যাপারে এবং তাঁর ইচ্ছামাফিক তাঁর কোনো বান্দার প্রতি শাস্তিমূলক প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের ব্যাপারে তাঁর প্রতি ভালো ধারণা পোষণ করাটাই হলো আল্লাহ তা’আলার সাথে তার আদব রক্ষা করে চলা। আর বান্দা এ আদবের যতটুকু ধারণ ও রক্ষা করে চলবে, ততোটুকু পরিমাণে তার মর্যাদা সমুন্নত হবে, মান উন্নত হবে এবং সম্মান বৃদ্ধি পাবে। ফলে সে আল্লাহর অভিভাবকত্ব ও তা তাঁর তত্ত্বাবধানে থাকা ব্যক্তিবর্গের অন্তর্ভুক্ত হবে এবং তাঁর রহমত ও নি’য়ামত পাওয়ার উপযুক্ত হবে। আর এটাই মুসলিম ব্যক্তির দীর্ঘ জীবনের একমাত্র চাওয়া এবং চূড়ান্ত প্রত্যাশা।

হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে আপনার অভিভাবকত্ব নসিব করুন, আপনি আমাদেরকে আপনার তত্ত্বাবধান থেকে বঞ্চিত করবেন না এবং আমাদেরকে আপনার নিকটতম বান্দাগণের অন্তর্ভুক্ত করুন। হে আল্লাহ! হে জগতসমূহের প্রতিপালক! আপনি ওদেরকে দ্বীনের পথে ফিরিয়ে নিয়ে আসুন। আমাদের আবেদন কবুল করুন। আমিন।

লেখক : ড. আব্দুস সাত্তার, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক, ওয়াশিংটন ডিসি।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়