প্রকাশ : ২৬ জুন ২০২৩, ০০:০০
বৃষ্টি ভেজা রাতে চুন্নু ভাইয়ের চলে যাওয়া
বেশ কয়েক বছর ধরে চুন্নু ভাইয়ের শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। বড় ধরনের অপারেশন পরবর্তী জটিলতা তাঁর চলাফেরায় নিয়ন্ত্রণ করে দিল। আমার সাথে দেখা হলেই অভিযোগ অনুযোগ তুলে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিতেন। কেন এতোদিন পরে দেখা করতে এসেছি এ নিয়ে তাঁর অভিমান আমার মধ্যে অপরাধবোধ তৈরি করতো। গত চল্লিশ বছর ধরে চুন্নু ভাইয়ের সাথে আমার সম্পর্ক অটুট ছিল। তাঁর জেদ, রাগ, তেজ, অভিমান, তীব্র বাক্যবাণে কেউ কেউ আহত হলেও স্নেহ-মমতাণ্ডভালোবাসার কাছে এসব উড়ে যেতো। আমাকে অনেক বার বকেছেন, কিন্তু পরবর্তীতে দেখা হলে মনে থাকতো না। তিনি ব্যক্তিগত জীবনের নানান বিষয় নিয়ে আমার সাথে কথা বলতেন বন্ধুর মতো। ঢাকায় যখনই তিনি আমাকে ডাকতেন তখনই আমি হাজির হতাম। সর্বশেষ যখন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেন, তখন একজন কেয়ার গিভার দেয়ার বিষয়ে রাসেল আমার সাথে কথা বললো। আমি কেয়ার গিভারের ব্যবস্থা করে খোঁজ-খবর রেখেছি। এতো দ্রুত চুন্নু ভাই মরে যাবেন এটা একবারও মনে হয়নি। হাসপাতালে যাবো যাবো করেও যাওয়া হয়নি পারিবারিক জটিলতার কারণে। যখন মৃত্যুর সংবাদ শুনলাম ততক্ষণে চুন্নু ভাইকে হাইমচর নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমি এতোটা আত্মকেন্দ্রিক ছিলাম যে তাঁর স্মরণসভায় পর্যন্ত হাজির হতে পারিনি। পরবর্তীতে তাঁর কবরের পাশে দাঁড়িয়ে ক্ষমা চেয়েছি।
|আরো খবর
কেন চুন্নু ভাইকে স্মরণ করছি? তিনি হাইমচরবাসীকে নদী ভাঙ্গনের হাত থেকে রক্ষা করতে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন। ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে ১০হাজার হাইমচরবাসীর সাথে গণঅনশনে সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন। নদী ভাঙ্গন নিয়ে সচিবালয়ে পানিসম্পদ মন্ত্রীর সাথে বৈঠকে তিনি হাইমচরবাসীর পক্ষে নেতৃত্ব দেন। সরকারের রোষানলে পড়ে ২০ আগস্ট ১৯৮৮ রাতে ঢাকায় পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। পরবর্তীতে সরকার তাঁকে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান পদ থেকে বরখাস্ত করে।
দীর্ঘ সময় জেল খেটে জামিনে মুক্তি পেয়ে হাইমচরে আসলে সর্বস্তরের জনগণ তাঁকে বীরের সম্মানে ভূষিত করে। মানুষের এই ভালোবাসা, সম্মান, মর্যাদা, শ্রদ্ধা পাওয়া ছিল তাঁর জীবনের সবচেয়ে পাওয়া। জীবদ্দশায় এমন সম্মান মর্যাদা খুব মানুষের ভাগ্যে জোটে।
অন্যায়ভাবে চুন্নু ভাইকে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান পদ থেকে বরখাস্ত করা হাইমচরবাসী মেনে নেয়নি। বিপুল ভোটে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান পদে পুনঃনির্বাচিত হয়ে জবাব দিয়েছেন। চুন্নু ভাইয়ের সাথে আমার শত শত স্মৃতি চোখের সামনে ভাসছে। ১৯৮৮ সালের জুন মাসের শেষ দিকে হাইমচরের তরুণদের একটা দল ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি মাথায় নিয়ে হেঁটে হেঁটে চুন্নু ভাইয়ের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা করলো। তিনি বাড়ির সামনের পুকুর পাড়ে ছাতা মাথায় বড়শি ফেলে মাছের অপেক্ষায় বসে আছেন। আমাদের দেখে হেসে অভ্যর্থনা জানালেন। আমরা নদীভাঙ্গন প্রতিরোধ আন্দোলনে তাঁকে ভূমিকা রাখতে অনুরোধ করলাম। তিনি আমাদের বললেন, তোরা আমার চেয়ারম্যানি খোয়ানোর বুদ্ধি দিলি। মানুষের ভিটামাটি রক্ষায় যদি আমার চেয়ারম্যানি যায়, তবে যাক।
তিনি আমাদের সাথে নিয়ে বাড়িতে আসলেন। কাপড়-চোপড় পাল্টে হাইমচর বাজারের উদ্দেশ্যে পায়ে হেঁটে রওয়ানা হলেন। আমরা তাঁকে পাশে পেয়ে সাহসী হয়ে উঠলাম। শ্লোগান ধরলাম, গ্রোয়েন বাঁধ নির্মাণ করো, হাইমচরকে রক্ষা করো। বাজারের কাছাকাছি যেতেই মিছিল বড় হয়ে গেল। শত শত মানুষ মিছিলে যোগ দিয়ে বিশাল মিছিলে পরিণত করলো। বাজারের পূর্ব মাথায় এসে হাজার মানুষের সামনে চুন্নু ভাই বক্তৃতা করলেন। তিনি বললেন, হাইমচর রক্ষায় জেল-জুলুম, নির্যাতন-নিপীড়ন এমনকি চেয়ারম্যানি হারানোকে আমি পরোয়া করি না। জনতা তুমুল করতালি দিয়ে তাঁর বক্তব্য সমর্থন করলো। হাইমচর রক্ষায় অনেকেই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অবদান রেখেছেন। চুন্নু ভাইয়ের অবদান, ত্যাগ, তিতিক্ষা, সংগ্রাম আমাদের চোখের সামনে উজ্জ্বল হয়ে উঠে। জীবিতকালে হাইমচর ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন তাঁকে নদী ভাঙ্গন আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখায় সংবর্ধনার আয়োজন করে।
চুন্নু ভাই শুয়ে আছেন মেঘনার পাড়ে, যে মেঘনা বহু মানুষের বসত ভিটা নিয়ে গেছে।