প্রকাশ : ১৭ নভেম্বর ২০২২, ০০:০০
মানুষ নিজের সম্পর্কে খুবই কম জানে। মানুষের ক্ষমতার গভীরতম উৎস এবং তার পরিপূর্ণতা নিদারুণভাবে অপরিণতই রয়ে গেছে। এই অজানাকে জানার জন্য, অচেনাকে চেনার জন্য এবং না-পাওয়াকে পাওয়ার জন্য সর্বশক্তিমানের অনন্ত-অপরিসীম ক্ষমতার কিঞ্চিত মাত্র মানুষের মাধ্যমে পদার্থের ওপর যে মুহূর্তে পড়েছে ঠিক তখনই জাগতিক উন্নতির অংকুরোদ্গম হয়েছে। বর্তমানের এই বস্তুজাগতিক বিশ্বের বহু ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুর গোপন রহস্য মানুষ কর্তৃক উদ্ঘাটিত হয়েছে, যেমন পদার্থের কণা-অণু-পরমাণু-ইলেকট্রন-প্রোটন-নিউট্রন এবং পজিট্রন ইত্যাদি। শেষোক্তগুলো পরমাণুতে বিস্ফোরণ ঘটায়ে বহু চমকপ্রদ রহস্য মানব গোচরীভূত করা হয়। এবং আদিম বিশ্বকে আণবিক বিশ্ব-পারমাণবিক বিশ্ব-ডিজিটাল বিশ্বের পর নানা বিস্ময়কর আবিষ্কার উপহার দিচ্ছে আধুনিক বিশ্বের মানুষ। যে যন্ত্রটির সাহায্য এবং সত্যটি আবিষ্কৃত হয়েছে যে, পদার্থ কণিকাই প্রাকৃতিক এবং জাগতিক সকল শক্তির আধার তা হলো মানুষের মন। মানুষের মন হলো অতিন্দ্রিয় জ্ঞানের সাধিত্র।
ডাঃ অ্যালেক্সিস ক্যারেল বলেছেন, গণিতের বিমূর্ত চিন্তার সাহায্যে মানুষের মন ক্ষুদাতিক্ষুদ্র অণু পরমাণু থেকে সুদূর আকাশে দীপ্তমান রবিশশী এবং তারকাপুঞ্জ সহ সৌরজগৎকে তৎক্ষণাৎ বুঝে ফেলে। এমনকি মানুষের মনের মণন, চিন্তন, পর্যবেক্ষণ এবং পরীক্ষণের দ্বারা বিশ্লেষণ করে মানব দেহের ক্ষুদ্রতম কোষ জগতেরও নিগূঢ় রহস্য উন্মোচন করে দেয়। কাজেই মানুষের মনের শক্তি বিশ্ব ব্রহ্মা-ের যে কোনো শক্তির সাথে অনুপম।
একদিন মানুষের মনে পরোক্ষভাবে যা কিছু বিক্ষিপ্ত হতো তা-ই একদিন বাস্তবায়িত হলো অণুবীক্ষণ এবং দূরবীক্ষণ যন্ত্রের উদ্ভাবনে। শেষ পর্যন্ত কোনো বস্তু কণাকে চৌদ্দ লক্ষ গুণ বড় করে দেখানো অথবা মহাকাশের সৌরজগৎ এবং তার ছায়া পথ অথবা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তু কণা ইলেকট্রনের আবর্তন ও গতিবিধি পর্যবেক্ষণ বাস্তবে মানুষই রূপায়িত করেছে। স্বাভাবিক আলোকরশ্মির গতিপথের সামনে অস্বচ্ছ বস্তুর ছায়া ফেলতে পারে। মানুষের আবিষ্কার জীবের অশেষ কল্যাণে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। আবার ৩-৫ মিলিমিটার পুরু ধাতব পাতকেও ছেদ করে এ জাতীয় রশ্মি চলে যেতে পারে। মানুষের অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টির ক্ষমতা অনেক উঁচুতে উঠেছে। পৃথিবীর সকল দানবীয় শক্তি সমষ্টির দ্বারাও রোধ করা সম্ভব নয়। মানুষের বোধ শক্তিও তাঁর সীমারেখার শীর্ষ বিন্দুতে পৌঁছেছে। যে অতি মানুষ এলফ্রেড নোবেল মানব কল্যাণে মোট ৩৫৫টি আবিষ্কার করে বিপুল পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করে তা দিয়ে একটি তহবিল গঠন করে প্রতি বছর লভ্যাংশ দিয়ে পদার্থ-রাসয়ন-সাহিত্য- মেডিসিন, অর্থনীতি, ফিজিওলজি এবং শান্তির ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য উৎসর্গ করে গেছেন। এগুলোই নোবেল পুরস্কার নামে খ্যাত। প্রতিটি পুরস্কারের মূল্য ১.৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। কিন্তু এখনও কি এটা মানুষের ক্ষমতার মধ্যে নয় যে, সুবিচার-সৌভ্রাতৃত্ব-সহমর্মিতাণ্ডশান্তি এবং পরমতসহিষ্ণুতা সমৃদ্ধ সুন্দর পৃথিবী তৈরি করা ?
সবই সম্ভব। তবে সদিচ্ছার অভাব। অবস্থাটা হলো ‘বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধবে কে?’ কমলের বোঁটায় কাঁটা দেখেই যদি কমল তোলা থেকে বিরত থাকি তবে সৌন্দর্য পাবো কোথায়? এ ধরায় প্রতিনিয়ত জনসংখ্যা বেড়েই চলেছে, কিন্তু মানুষের সংখ্যা অবিশ্বাস্য হারে হ্রাস পাচ্ছে। এজন্যই বিশ্ব ভ্রাতৃত্ববোধ ও মানবতাবোধের মধ্যে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। বিপন্ন মানবতার এই ক্রান্তিলগ্নে একদল ন্যায়নিষ্ঠ এবং প্রকৃত মানবতাবাদী সু-পুরুষের প্রয়োজন, যাঁরা দেশহিতের মুখোশে শয়তানের বর্বরতাকে লালন করে না। কিংবা বিপন্ন, ক্ষয়িষ্ণু ও মরণশীল মানব গোষ্ঠিকে পারস্পরিক ঘৃণার আদিম বহ্নিশিখার উত্তাপ থেকে পরিত্রাণ করবে। বর্তমানে মানব জাতির প্রধান সংকট গুলো হলো : মানুষ জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে বিরাজমান নরপশুকে ভয় পায়। যুদ্ধবাজ পাশ্চাত্যের বৃহৎশক্তির লোলুপতায় তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের অশনি সংকেতের দামামা বাজায়ে শান্তিময় জনজীবন গুঁড়িয়ে দিতে চায়। সেটি হলো মারণাস্ত্রের উন্মত্ত হর্ষের দাবানল।
এই ডিজিটাল যুগেও যদি মানুষ ধর্ম নিয়ে অযথা বাড়বাড়ি করে, মানবতার বাতাবরণে পাশব বৃত্তির উন্মেষ ঘটায়, শিশুর পুতুল খেলার মত আণবিক যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা করে, তবে এ হবে নিশ্চয়ই ঐ প্রাতঃ স্মরণীয় অতি মানুষগুলোর মানব কল্যাণে রক্ষিত অব্যয় অবদানের প্রতি কুৎসিত ভ্রু-কুটি মাত্র। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব মানুষ। যে মুহূর্তে আমরা মানব গোষ্ঠির মধ্যে নিহিত অনন্ত-অসীম শক্তি উপলব্ধি করতে সক্ষম হবো, সেই মুহূর্তেই সর্বক্ষেত্রে শান্ত ভাবের সূচনা হবে।