প্রকাশ : ১৬ অক্টোবর ২০২২, ০০:০০
এই বিশ্ব ব্রহ্মা- হাঁটিহাঁটি পা-পা করতে করতে প্রায় তেরো শত কোটি বছর পেরিয়ে এলো। সে দেখেছে কত মহাজাগতিক বিবর্তন! আর উইকিপিডিয়া অনুযায়ী ধরিত্রীর বয়স সাড়ে চার শত কোটি বছরেরও কিছু বেশি হবে। এসব অতীত শুধুই কাল-মহাকালের গর্ভে পুঞ্জীভূত অবস্থায় অবচেতন মনে বর্তমানের অথবা ভবিষ্যতের পর্দায় প্রতিভাত হওয়ার অপেক্ষায় উঁকি-ঝুঁকি মারছে।
এর মধ্যে আমরা উপনীত শেষ জমানা মতান্তরে ঘোর কলিকালে। এখানের পরিবেশটা সামাজিকভাবে অসামঞ্জস্যপূর্ণ, পারিবারিক পরিবেশটা কলহপ্রবণ, আর পারিবারিক পরিবেশ তিমিরাচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে পরমত অসহিষ্ণুতায়। দুরারোগ্য ব্যধিগুলোর মধ্যে ক্যানসার সদৃশ এ রোগের কোনোই প্রতিকার নেই। নৈতিকতার আত্মোপলব্ধি হলো এর অনিবার্য নিরাময়।
রবীন্দ্রসাহিত্যে বাংলার অপরূপ কালজয়ী সংস্কৃতির বিশ্ব পরিচিতি, নজরুলের অকৃত্রিম বাংলা প্রীতি এবং ভারত স্বাধীনতার উদ্দীপক সংগীতগুলো আর জীবনানন্দের অনুপম ও অনন্ত কাল অবধি বাংলাকে ভালবাসার নিদারুণ আকুতি বাংলার সার্বিক সৌন্দর্যের পরিচায়ক। এই বাংলার পারিবারিক বিবিধ সৌন্দর্য মণ্ডিত সংস্কৃতি এবং সামাজিক শাশ্বত অটুট বন্ধনের উদ্দাম সংস্কৃতি ও আন্তরিক আতিথেয়তায় বিমোহিত হননি এমন পরিব্রাজক বা আগন্তুক কাউকে এ ধরায় খুঁজে পাওয়া যাবে না নিশ্চিত।
জাতিসংঘের তথ্য মতে, আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে মোট ১৯৫টি স্বাধীন দেশ রয়েছে। নৈসর্গিক আতিশয্যে বাংলাদেশ অদ্বিতীয়। কবির ভাষায় বলতে হয় ‘সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি’ বাংলাদেশ এক অনন্য সৃষ্টি।
কালান্তরে এদেশের সার্বিক পরিস্থিতির জটিলতা, কুটিলতা এবং অবোধ্যতা সাধারণ মানুষকে দিশেহারা করে তুলেছে। দুর্নীতির আঁচড় নেই এমন কোনো স্তর বা দপ্তর আছে বলে কোনো লোক সজ্ঞানে দেখাতে পারবে না। এমনটি কিন্তু এই বাংলার চিরায়ত ঐতিহ্যের পরিপন্থি। যে সমস্ত টিন-এজার (Teen-Ager) হাতে পুস্তকাদি নিয়ে শিক্ষালয়মুখী হবার কথা, তারাই আজ বিপথগামী হয়ে কিশোর-সন্ত্রাসী হিসাবে পরিগণিত। এদের এই অপশক্তির উৎস একটাই, তড়িৎ গতিতে বড় লোক হওয়া-বড় মানুষ হওয়ার প্রয়োজন নেই। কিন্তু ওরা ভুলে গেল, হাজার টাকার নূপুর পায়ে লাগে আর এক টাকার টিপ কপালে থাকে।
প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের বেতন-ভাতাদি দ্বিগুণ বৃদ্ধির সংবাদ যেন জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে ঘৃতাহুতি দেওয়ার সদৃশ। সর্ব স্তরেই এতে বেড়ে গেছে উৎকোচ দেয়া-নেয়ার মহোৎসব। আজ নিঃসংকোচে বলা যায় যে, আমাদের দেশে রাজনৈতিক দুর্নীতির নিয়ন্ত্রণ এবং পরিবর্তনের চালকদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদদে বাংলা এখন মারাত্মক অক্টোপাসে বন্দী।
হঠাৎ করে জাতীয় বিদ্যুৎ গ্রীডে বিভ্রাট, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির সরবরাহ যথাযথ থাকা সত্ত্বেও দ্রব্যমূল্য সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণাধীন। এখন সন্তানের হাতে খুন হচ্ছে বাবা-মা। বাবা-মায়ের হাতে খুন হচ্ছে সন্তান। ভাই খুন করছে ভাইকে। শিক্ষকের হাতে ধর্ষিতা হচ্ছে ছাত্রী। স্বামী-স্ত্রীর পরকীয়ায় সমাজ হচ্ছে কলুষিত। বিচারহীনতা এবং বিচারের দীর্ঘসূত্রিতায় সাধারণ মানুষ আজ কিংকর্তব্যবিমূঢ়। বর্তমান বাংলার পারিবারিক, সামাজিক অপরাধের ভয়াবহ কদর্য রূপ নিশ্চয়ই ব্যথিত এবং লজ্জিত করবে আদি বাংলার চির শান্ত এবং নীল কণ্ঠ রূপকে। কোনো দল বেশিদিন ক্ষমতায় থাকলে দলের ভেতরেই মনুষ্যত্ব বিবর্জিত নামবিহীন গুপ্ত সরকার গঠিত হয়ে যায়। এরাই কিন্তু মোশতাক, মীরজাফর এবং ব্রুটাস। এরাই কিন্তু প্রত্যক্ষভাবে দলীয় প্রধানের স্তুতিতে আকাশ-পাতাল নিনাদিত করে দেন, পরোক্ষভাবে নির্মম চক্রান্তে মেতে উঠেন। অপরাধীরা অজান্তেই অপরাধের চিহ্ন রেখে যায়। যেমন : বঙ্গবন্ধুর মায়ের মৃত্যুতে কুম্ভিরাশ্রু নির্গত হওয়া ব্যক্তিটি মোশতাক আর এরশাদের মায়ের মৃত্যুতে তাহাই করেছেন শাহ মোয়াজ্জেম। এই সব সুযোগ সন্ধানীরা ‘বিষ-কুম্ভ-পয়ঃ মুখম।’ অর্থাৎ বিষ ভর্তি কলসীর মুখে সুপেয় পানি। এই বাংলায় জন্মেছিল বীর সূর্যসেন, বঙ্গ বীর কাদের সিদ্দিকী এবং বীর জগত জ্যোতি দাস। একই প্রসঙ্গে বঙ্গ বেঈমানরা হলো মোশতাক, মেজর ডালিম এবং নূর। এদের প্রেতাত্মারাই অতিদরদী এবং হাইব্রীড আওয়ামীলীগার সেজে বিপথগামী করছে বর্তমান সরকারকে। নয়তো এত উন্নয়নের পাশাপাশি সর্বস্তরে এতো বিপর্যয় ঘটতে পারে না।
এই বাংলার মানুষ সহজ, সরল এবং আবেগপ্রবণ আর বাজারি গুজবে আসক্ত হয়ে আতঙ্কগ্রস্ত হয় সহজেই। দলীয় চক্রান্তকারীরা এ সুযোগেই মিথ্যাকে বিভিন্ন অপচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত করে সত্যকে আড়ালে আবডালে নিয়ে যায়, ফলস্বরূপ সরকার বিরোধী তীব্র এবং নিয়ন্ত্রণাতীত আন্দোলন গড়ে উঠে। তাই সময় থাকতে ‘সাধু সাবধান’।
বিমল কান্তি দাশ : কবি ও প্রবন্ধকার; অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র শিক্ষক, বলাখাল যোগেন্দ্র নারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয় ও কারিগরি কলেজ, বলাখাল, হাজীগঞ্জ, চাঁদপুর।