প্রকাশ : ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০০:০০
আজকের প্রবীণদের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের সময় অল্পবয়সী ছিলেন। সে সময় মানুষের অভাব-অনটন, দুঃখ-দুর্দশা ছিল সীমাহীন। খুব কম সংখ্যক মানুষই কম বয়সে শহর-বন্দর, বড় দালান কোঠা, মোটর গাড়ি, রেল গাড়ি দেখেছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল চরম প্রতিকূল। অসুখণ্ডবিসুখ, বিপদণ্ডআপদ না হলে শহরে সাধারণ মানুষের আগমন ছিল সীমিত। জীবন-জীবিকার জন্য একদল মানুষ এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় গিয়েছে। সেসব মানুষের কাছে গল্প শুনে পাহাড়, বন-জঙ্গল, নদী, ঝর্ণা, হাওর, সাগর দেখার জন্য আকুল হয়েছে। আবার কেউ কেউ বইপত্র পড়ে এসব তথ্য জেনেছে। মানুষের অদম্য কৌতূহল প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য দেখার জন্য উদগ্রীব করে তোলে। মানুষ আর্থিক সংকট আর চরম প্রতিকূল যোগাযোগ ব্যবস্থা উপেক্ষা করে প্রকৃতির কাছে ছুটে গিয়েছে। দিন দিন যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি এবং আর্থিক সামর্থ্য বৃদ্ধি পাওয়ায় মানুষ পর্যটনে আগ্রহী হয়ে উঠছে।
অনেক উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের আয়ের অন্যতম উৎস পর্যটন। সিঙ্গাপুরে জাতীয় আয়ের ৭৫%, তাইওয়ানে ৬৫%, হংকংয়ে ৫৫%, ফিলিপাইনে ৫০%, থাইল্যান্ডে ৩০% পর্যটন থেকে আসে। বাংলাদেশে ২০১৯ সালে ৫ লাখ বিদেশি এসেছে। বাংলাদেশ থেকে ১৩ লাখ মানুষ বিদেশে গেছে, আর ২০ লাখ মানুষ দেশের অভ্যন্তরে ঘুরে বেড়িয়েছে। সারা বিশ্বে ১০কোটি মানুষ প্রত্যক্ষভাবে পর্যটন শিল্পে কর্মরত রয়েছে।
পর্যটন পৃথিবীর একক বৃহত্তম শিল্প হিসেবে স্বীকৃত। আমাদের প্রবীণরা নানা কারণে দেশ-বিদেশের দর্শনীয় স্থান দেখার সুযোগ পাননি। যে সকল প্রবীণের আর্থিক সামর্থ্য আছে তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ধর্মীয় স্থান বা তীর্থস্থান ভ্রমণে আগ্রহী হয়ে থাকেন। জীবনের নানা ক্ষেত্রে লড়াই-সংগ্রাম শেষে প্রবীণ জীবন পাওয়া পরম সৌভাগ্যের। সেই জীবনটা রাঙিয়ে তোলা, উপভোগ করা একান্ত কাম্য হওয়া উচিত। জীবনকে আনন্দময় ও উপভোগ্য করার ক্ষেত্রে পর্যটন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।
আমাদের প্রবীণরা নানান ধরণের অসংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন রকমের বিধি নিষেধের বেড়াজালে আটকে পড়েন। খাবার দাবার, চলাফেরায় সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। অনেকেই বস্তুগত ভোগ করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকেন। শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকার জন্য প্রবীণদের অবশ্যই ঘরের বাইরে যেতে হবে। নিজের দেশটাকে মন ভরে দেখতে হবে। দল বেঁধে বেড়াতে গেলে বেশি আনন্দ হবে। ঘর বন্দী জীবন প্রবীণদের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।
এমনিতেই আমাদের দেশের প্রবীণদের বাইরে বেড়ানোর সুযোগ তুলনামূলকভাবে কম। সুযোগ-সুবিধা বাড়ালে বাইরে বেড়ানোর হার বাড়বে। হোটেল মোটেল গেস্ট হাউসে বিশেষ ছাড়কৃত মূল্যে থাকার সুযোগ দিতে হবে। যানবাহনে আসন সংরক্ষণে অগ্রাধিকার এবং সাশ্রয়ী মূল্যে টিকেট পাওয়ার সুযোগ দিলে বিপুল সংখ্যক প্রবীণকে ভ্রমণে উৎসাহিত করা যাবে। বিশেষ ব্যবস্থায় নৌকা বাইচ, ঘুড়ি উৎসব, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক উৎসব, ম্যাজিক শো, আতশবাজি, কনসার্ট, ফান গেম, নাটক, সিনেমায় নেয়ার ব্যবস্থা থাকলে প্রবীণ চলাচল বাড়বে। সিলেটের চা বাগান, জাফলং, লালাখাল, বিছানাকান্দি, পাংথুমাই ঝর্ণা, রাতারগুল, লাউয়াছড়া আকর্ষণীয় স্থান। পার্বত্য চট্টগ্রাম পুরোটাই একটা পর্যটন কেন্দ্র।
পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার, ইউনস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন, সাত জেলা পরিবেষ্টিত বিশাল হাওর আমাদের মুগ্ধ করে রাখে। আমার কাছে পুরো বাংলাদেশটাকে একটা বড় পর্যটন কেন্দ্র বলে মনে হয়। বাংলাদেশের দেড় কোটি প্রবীণকে পর্যটনমুখী করতে পারলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বড় ধরনের অগ্রগতি সাধিত হবে। জেলা উপজেলায় ডাক বাংলো, সার্কিট হাউসগুলোতে প্রবীণদের জন্যে থাকার সুযোগ করে দেয়া যায় কি না তা বিবেচনা করতে হবে। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো প্রবীণদের সহযোগিতা দেয়ার জন্য একটি কেন্দ্র খুলতে পারে। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সহযোগিতাণ্ডসমর্থন প্রবীণদের আত্মবিশ্বাসী করে তুলবে। পরিবহন চালক, শ্রমিকদের সহযোগিতা চলাচল সহজ করে দিবে। রেস্টুরেন্টগুলো প্রবীণ বান্ধব খাবার দাবারের ব্যবস্থা করে দিলে প্রবীণরা শারীরিকভাবে সুস্থ থাকবে।
যে সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্যটন বিষয়ে পড়াশোনা করার সুযোগ রয়েছে, সেখানকার ছাত্র-ছাত্রীদের দিয়ে ‘সিনিয়র সিটিজেন ট্যুরিজম’ একটি পরীক্ষামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা যেতে পারে। সমাজের বিত্তবান ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানগুলো সুবিধাবঞ্চিত প্রবীণদের পছন্দের জায়গায় বেড়াতে নিয়ে যাওয়া-আসার খরচ বহন করতে পারে। প্রবীণরা কোথাও বেড়াতে গেলে স্থানীয় লোকজনের আন্তরিক সহযোগিতা জরুরি। তাদের সহযোগিতাণ্ডসমর্থন প্রবীণদের ভ্রমণে আগ্রহী করে তুলবে। প্রবীণদের মধ্যে আর্থিক ভাবে সামর্থ্যবানদের সংখ্যা বাড়ছে। অনেকের ছেলেমেয়েরা সামর্থ্যবান। তারা সুবিধাবঞ্চিত প্রবীণদের ভ্রমণে সঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করে মহানুভবতার
পরিচয় দিতে পারেন। প্রবীণ জীবনে নিজের সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করলে দুঃখ-কষ্ট কমবে। প্রকৃতির কাছে যাওয়া একটা বড় সন্তুষ্টি। বিশ্ব পর্যটন দিবস পালন করার সময় প্রবীণবান্ধব ‘পর্যটনে নতুন ভাবনা’ গড়ে তোলার আহ্বান জানাই।