প্রকাশ : ৩১ আগস্ট ২০২২, ০০:০০
অবশেষে মমিন উদ্দিন বিয়ে করতে রাজি হলো। শর্ত একটাই মেয়েটি সুন্দরী হতে হবে। যেনো এক দেখায় চোখ জুড়িয়ে যায়। মমিন চুয়াত্তরে বি.এ. পাস করেছেন। যখন পাসের হার ছিলো স্মরণকালের সর্বনিম্ন। তিনি বন্ধু-বান্ধবদের সাথে অহঙ্কার করে বলতেন, আমি চুয়াত্তরের বি.এ. পাস। কেরানীর চাকরি দিয়ে জীবন শুরু করলেও টাকা রোজগারের লাইন দ্রুত আয়ত্ত করে ফেলেন। বাড়ি-গাড়ি, সহায়-সম্পদ হতে বেশি সময় লাগেনি। এখন বাসনা ঝকঝকে একটা বউ। সুন্দরী বউ খুঁজতে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ভীষণ ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে পাওয়া গেলো কাঙ্ক্ষিত সেই অপরূপ সুন্দরীকে। সুন্দরী মেয়েটি গ্রামের একটি হাই স্কুলে দশম শ্রেণির ছাত্রী। পাত্রপক্ষ মেয়েটির বাবাকে মমিনের ঢাকার বাসায় নিয়ে আসলো। অর্থ-বিত্ত, শান-শওকত দেখে দরিদ্র স্কুল শিক্ষকের মাথা ঘুরে গেলো। পাত্রপক্ষ অনেক পীড়াপীড়ি করেও মেয়ের বাবার থেকে বিয়ের দিন-তারিখ নিতে পারলো না। তিনি মিনমিনে গলায় বললেন, বাড়ি ফিরে সবার কথা বলে জানাবো।
মাস্টার বাড়ি ফিরে স্ত্রীর কাছে পাত্রের সহায়-সম্পদের বিবরণ দিলেন। বর্ণনা শুনে স্ত্রীর চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠলো। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব বিয়ের দিন তারিখ না করে আসায় মাস্টারের ওপর বিরক্ত হয়ে আছেন। মাস্টার মেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়ে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার বানানোর স্বপ্নে বিভোর। একদিন স্কুল ছুটির পর বাড়ি ফেরার পথে মাস্টারের মেয়ে ময়নার ওড়না বখাটেরা দিনে-দুপুরে টান মেরে নিয়ে যায়। সাথে থাকা ছেলে-মেয়েরা ভয়ে কোনো কথা বললো না। ময়না বই বুকে কান্না চেপে বাড়ি ফিরে আসলো।
রাতে মাস্টারের স্ত্রী স্বামীকে বললেন, তোমার চারটে মেয়ে। এদের মুখে ঠিকমতো ভাত দেয়াই তো কঠিন কাজ। ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার তো দূরের কথা। বরং মেয়ে বিয়ে দিয়ে দাও। ধনী জামাইয়ের প্রচেষ্টায় মেয়েদের লেখাপড়া করাতে পারবে এবং ভালো বিয়েও দিতে পারবে। বিয়ে না দিলে গ্রামের বখাটে ছেলেদের যন্ত্রণায় জীবন অতিষ্ঠ করে দিবে।
সবদিক চিন্তা করে মাস্টার মেয়ের বিয়েতে মত দিলেন। কুড়ি বছরের ব্যবধান নিয়ে মমিন ও ময়নার দাম্পত্য জীবন শুরু হয়ে গেলো। বছর ঘুরতে ময়নার কোল জুড়ে ছেলে। দশ বছরে দুই ছেলে দুই মেয়ের মা হয়ে গেলেন। বাড়িতে আয়া-বুয়া-বাবুর্চি-কাজের লোকের কোনো অভাব নেই।
ময়নাকে তদারকি ছাড়া আর কিছু করতে হয় না। রাতে স্বামীর সাথে দেখা হয়। মমিন বাসায় ফিরে সন্তানদের সাথে গল্প-গুজব আর খুনসুটি করে কাটিয়ে দেয়। মাঝে মধ্যে সবাইকে নিয়ে বাইরে খাবার খেতে যায়। বাচ্চারা বাপের জন্যে পাগল। সারা দিনই ফোনে যোগাযোগ করে। মমিন সকালে বাচ্চাদের স্কুলে পৌঁছে দিয়ে অফিসে চলে যায়।
ময়না তার নিঃসঙ্গতার কথা মমিনকে বললো। নিঃসঙ্গতা কাটাতে নতুন করে পড়াশোনা শুরু করার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। মমিন শোনা মাত্রই রাজি হয়ে গেলেন। ময়নার জন্যে বাসায় দুজন নারী শিক্ষক রেখে দিলেন। ছেলে-মেয়েদের সাথে পড়াশোনা নিয়ে কথা হয়। প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে আইএ, বিএ, এমএ পাস করেন। ময়না চার ছেলে-মেয়ে অনেক মেধাবী। ওরা উচ্চশিক্ষা শেষে নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে সম্মানজনক পদে নিয়োজিত রয়েছে। মমিন ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন। শূন্য বাসায় ময়নার বসবাস শুরু হয়ে গেলো। ময়না ভাবলো এবার মমিনকে নিজের মতো করে পাওয়া যাবে। ময়নার শরীর ও মন জেগে উঠেছে, কিন্তু মমিনের শরীর নিস্তেজ হয়ে আছে। অনেক আশা নিয়ে দুজনেই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলেন। কিন্তু ফিরে আসলেন আশাহীন হয়ে। মমিন ধর্মকর্মে বেশি মনোযোগী হয়ে উঠেছেন। নিজ এলাকায় মসজিদণ্ডমাদ্রাসা-এতিমখানা বানিয়েছেন। স্ত্রীকে সাথে নিয়ে হজ ও ওমরাহ পালন করেছেন। বিদেশে অবস্থানরত ছেলে-মেয়েদের কাছে দুজন মিলে বেড়াতে যান। ময়না নিজের জীবন নিয়ে ভীষণ বিরক্ত। কোনো কিছু পাবার জন্যে অপেক্ষা করতে হয় না। মুখ দিয়ে বললেই চলে আসে। যে জিনিস দেশে পাওয়া যায় না, তা ছেলে-মেয়েদের বললে বিদেশ থেকে পাঠিয়ে দেয়। দেশ-বিদেশ ঘুরেছেন, দামী হোটেলে থেকেছেন। নামী-দামী খাবার খেয়েছেন। এতো কিছু পেয়েও মনটা ভালো নেই। অফুরন্ত অবসর কাটাতে বন্ধু-বান্ধবের পরামর্শে ফেসবুকে পুরানো দিনের একটা ছবি দিয়ে হিসাব খুলে দিলেন। তিন মাসের মধ্যেই বন্ধুসংখ্যা পাঁচ হাজার হয়ে গেলো।
ম্যাসেঞ্জারে কল এবং ম্যাসেজ দেখলেই আনফ্রেন্ড করতে থাকেন। উতলা পুরুষের আকুলতা আর নির্লজ্জতা ময়নাকে ভীষণ ব্যথিত করে। বিছানায় মমিন বসে হিসাবের খাতাণ্ডপত্র নিয়ে আর ময়না বসে মোবাইল ফোন নিয়ে। ফেসবুকে একদিন একটা পোস্টে চোখ আটকে গেলো। পোস্টটা খুব মনে ধরেছে। তিনি পোস্ট শেয়ার করার জন্যে ফেসবুক বন্ধুর অনুমতি চাইলেন। অনুমতি পেয়ে পোস্ট শেয়ার করলেন। ফেসবুক প্রোফাইলে গিয়ে দেখলেন বন্ধুর বয়স তেষট্টি বছর।
ময়নার নিজের বয়সও তেষট্টি বছর এবং জন্ম তারিখ একই। নিজের মনটা কৌতূহলী হয়ে উঠলো। ফেসবুক বন্ধুর নাম পারভেজ কামাল।
মমিন পাশে থাকলে ম্যাসেঞ্জারে কথা চালাচালি করে। পাশে না থাকলে ফোনে কথা বলে। কামালের কণ্ঠ, হাসি, কথা বলার ঢং ময়নার কাছে দারুণ সুখকর। কামালের সাথে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কথা হয় শোষিত-বঞ্চিত-নিপীড়িত নারীর জীবনের গল্প নিয়ে। নারীর প্রতি সহিংসতা, অসম্মান, অমর্যাদার কথা উঠলেই ময়না চোখ মুছতে শুরু করে। কামালের জ্ঞানের গভীরতায় ময়না মুগ্ধ হয়ে পড়ে। কামাল একদিন প্রসঙ্গক্রমে বললেন, প্রকৃতি নারীকে দুর্বল করে সৃষ্টি করেছে। সেটা এখন পুরুষের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। এ নিয়ে দুজনের তর্কের কোনো শেষ নেই।
অবাক করা বিষয় হলো, কামাল গত এক বছরে একবারও দেখা করতে কিংবা ভিডিও কলে কথা বলতে আগ্রহ প্রকাশ করেননি। এতো এতো আলোচনা হয় কিন্তু কখনো আলোচনা হয় না দুজনের জীবনের সুখণ্ডদুঃখ নিয়ে।
একদিন সকল সংকোচ ঝেড়ে ফেলে ময়না জিজ্ঞেস করলেন, আপনার স্ত্রী কী করেন?
কামাল : আগে চাকরি করতেন, এখন অসুস্থ এবং চলাচলে অক্ষম।
আপনার স্বামী কী করেন?
ময়না : আগে ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন। এখন সামাজিক কাজে ব্যস্ত এবং তিনি অক্ষম!
কামাল : বিষয়টা বুঝতে পারলাম না।
ময়না : বুঝতে পারলে কী করবেন?