মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল, ২০২৫  |   ৩১ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য
ব্রেকিং নিউজ
  •   চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ইউসুফ গাজী গ্রেফতার

প্রকাশ : ২৭ জুলাই ২০২২, ০০:০০

টাই বিড়ম্বনা
অনলাইন ডেস্ক

আমার ছেলে কুন্তল এসএসসি পরীক্ষা দিলো ২০২১ সালে। তার গ্রুপ সায়েন্স। ডিসেম্বর মাসে রেজাল্ট আউট হলো। সে ‘এ’ গ্রেড পেয়েছে। তার রেজাল্টে আমার মনের ভেতর একটু খচ্ খচ্ করছে। এ প্লাস পেলো না কেনো ছেলে? ওদিকে তার মা অর্থাৎ আমার সুন্দরী স্ত্রী ছেলের পাসের আনন্দে মণিপুরি নৃত্য করছে। যে যেখানে আছে সবাইকে সুসংবাদ দিচ্ছে। আশপাশের বাসায় মিষ্টি বিতরণ করছে। স্ত্রীর সামনে আমিও খুশি খুশি ভাব করছি। কারণ তার সাথে মতবিরোধে আমি কখনো জড়াই না। ভয় পাইতো। যাই হোক, ২০২২ সালের প্রথম দিকেই অনলাইনে আবেদন করলাম কলেজে ভর্তির জন্যে। চাঁদপুর সরকারি কলেজ পেলাম না, পেলাম ড্যাফোডিল কলেজ। এ কলেজটাও আমার পছন্দের। ছাত্ররা চমৎকার ইউনিফর্ম পরে কলেজে যায়। দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। তাছাড়া কলেজটা আমার বাসার কাছেই। ওয়াকিং ডিস্টেন্স। ভর্তি করিয়ে দিলাম। কলেজ থেকেই ইউনিফর্মের কাপড় কিনে আনলাম। প্রিন্সিপাল সাহেব খুবই ভদ্র লোক। তিনি আমাকে বললেন, ‘ইউনিফর্ম পরে কলেজে আসতে হবে। জুতো পরবে, টাই পরবে। এগুলো মেন্ডেটারি।’ আমার ভালো লাগলো। আমার ছেলে স্মার্ট হয়ে কলেজে যাবে। বেশ তো। ড্রেসকো থেকে ইউনিফর্ম বানালাম। টাই কলেজ থেকে কিনেছি, অ্যাপেক্স থেকে জুতো।

কাল কলেজে ক্লাস শুরু। রাতে ছেলে আমাকে বললো, ‘বাবা কী চার্ম ! কাল জীবনে প্রথম কলেজে যাবো। তো বাবা আমাকে একটু টাই পরাটা শিখিয়ে দাওতো। আমার মাথায় বজ্রপাত হলো। এই বস্তু কখনো পরিনি। গলায় কীভাবে বাঁধতে হয় জানি না।’ বললাম ‘বাবা গলায় টাই বাঁধা আমি তো ভুলে গেছি। তোমার মাকে বলো।’ ভুলে গেছি কি, জীবনে টাই পরিনি এ কথা ছেলের কাছে গোপন করলাম। ওর মায়ের কাছে গেলো। ওর মা ঘণ্টাখানিক কসরৎ করে বললো, ‘পারি নারে বাবা’। এখন কী উপায়? বললাম, ‘বাবা টাই না পরেই কলেজে যাও।’ ছেলে চোখ বড় বড় করে বললো ‘বলো কী বাবা! টাই ছাড়াতো কলেজে ঢুকতেই দিবে না।’ টাই পরা শেখাবে কে? গুগলে সার্চ দিয়ে ছেলে টাই পরা শেখার চেষ্টা করলো, তাতেও লাভ হলো না। কী করি এখন। মনে পড়লো আমি যে বিল্ডিংয়ে থাকি সেটার ৪ তলায় এক ভদ্র লোককে দেখি প্রতিদিন অফিসে যায় স্যুটেড-বুটেড হয়ে, গলায় টাই লাগিয়ে। লাজ-লজ্জার মাথা খেয়ে তার বাসার দিকে রওনা দিলাম। ভদ্রলোকের সাথে আমার তেমন সখ্যতা নেই। তাতে কী, জগৎ সংসারের সবার সাথে সখ্যতা থাকতে হবে এমন কোনো কথা নেই। গলায় কাঁটা আটকালে বিড়ালের পা ধরা যায়। কুন্তলকে নিয়ে তার বাসায় গেলাম। হাতে টাই। ভদ্রলোক বাসায়ই ছিলেন। ‘আসুন আসুন’ বলে চিল্লিয়ে উঠলেন। তিনি পাজামা পরে আছেন। আমাকে ও কুন্তলকে বসালেন, চা খাওয়ালেন। তারপর বললেন, ‘কী ব্যাপার ভাই’? আমি সমস্যাটা বললাম। বলার সময় আমার কান গরম হয়ে গেলো। টাই বাঁধতে পারি না, কী লজ্জার কথা। তিনি বললেন, ‘ভাই অফিসে আমি টাই পরে যাই। কিন্তু আমিও টাই পরতে জানি না। আমার টাই বেঁধে দেয় আমার স্ত্রী। হাজার চেষ্টা করেও ওটা রপ্ত করতে পারিনি। এই দেখুন না পাজামা পরে একটা মিলাদে গিয়েছিলাম। বাসায় এসে পাঞ্জাবি খুললাম, কিন্তু পাজামার নেওর খুলতে গিয়ে গিঁট বাঁধিয়ে ফেলেছি। এটা আমার প্রায়শই হয়। এটাও খুলে দেয় আমার স্ত্রী।’ বললাম, ‘তাহলে ভাবীকে একটু ডাকুন’। তিনি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘আপনার ভাবী ছেলে-মেয়েদের নিয়ে বাপের বাড়ি গেছে এক মাসের জন্যে। রান্না-বান্না সব আমি করি। ৫ দিন হয়েছে, আরও পঁচিশ দিন পর আসবে। দেখছেন না পাঁচদিন ধরে টাই পরছি না। আচ্ছা আপনার ভাবী আসুক, ছেলেকে টাই পরা শিখিয়ে দেবে।’ বললাম, ‘এতোদিনে আপনাকেই তো শেখাতে পারলেন না ভাবী, তা আমার ছেলেকে শেখাবে কী করে।’ তিনি হেসে বললেন, ‘আমি ছাত্র হিসেবে তেমন ভালো না, তাই শিখতে পারিনি। ও ঠিকই শিখতে পারবে।’ বিরস বদনে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।

সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে মনে পড়লো আমার এক সাবেক বন্ধুর কথা। শীতকালে কমপ্লিট স্যুট পরে, ব্লেজার পরে থাকে। সে নিশ্চয়ই টাই পরতে পারে। ৫/৬ বছর ধরে কথাবার্তা নেই। দেখি দূর থেকে। তার নম্বরটা আমার কাছে আছে। কল দিলাম। ফোন তুলেই সে বললো, ‘কী দোস্ত, কেমন আছো তুমি। এতো বছর পর কী মনে করে ফোন করেছো?’ তার সাথে আমার তুই তুই সম্পর্ক ছিলো। এখন সে তুমি করে বলছে। বললাম না সাবেক বন্ধু। তুই থেকে তুমি। এটা হচ্ছে উপরের দিকে পতন। এতো দিনের গ্যাপ, তাই প্রথমে পুরানো বন্ধুত্বটা ঝালাই করে নিলাম আং সাং কথা বলে। তার বাসা প্রফেসরপাড়ায়। তারপর মূল কথায় এলাম। ‘দোস্ত তুমিতো টাই পরো, তো আমার ছেলেকে টাই পরা শেখাতে পারবে?’ সে চেঁচিয়ে উঠলো। ‘আরে ধুত্তুরি, এই উপমহাদেশের মানুষ আবার টাই পরবে কেনো? শোনো মহাত্মা গান্ধী ইংরেজদের সব পোশাক আগুনে পুড়িয়েছেন। টাইতো সবার আগে পুড়িয়েছেন। আর তুমি ছেলেকে টাই পরা শেখাতে চাও। নো টাই।’ বললাম, ‘ওর কলেজে টাই পরে যেতে হবে তাই।’ সে বললো, ‘কলেজ পালটাও। অন্য কলেজে ভর্তি করাও, যেখানে টাই পরতে হয় না।’ বললাম, ‘তুমি শেখাবে কি না বলো’। সে এবার নরম কণ্ঠে বললো, ‘দোস্ত, আমি মহাত্মা গান্ধীর মতো নেংটি পরে থাকি না, তা ঠিক। কমপ্লিট স্যুট পরি, ব্লেজার পরি ঠিকই। কিন্তু টাই কখনো পরিনি। কারণ টাই বাঁধতে আমিও পারি না। অনেক চেষ্টা করেও শিখতে পারিনি।’ বললাম, ‘আমি যে দেখতাম তুমি টাই পরতে’। বললাম, ‘তোমার বোধহয় হাইপারটেনশন আছে। এদের সাধারণত ইল্যুশন হয়, অবশেসন হয়। তোমারও তাই হচ্ছে এখন। আমার ড্রেসের কথা মনে পরতেই তোমার মস্তিষ্ক টাইটা বানিয়েছে। খোদার কসম আমি টাই পরতে পারি না।’ বললাম, ‘আচ্ছা’।

নিচতলায় নেমে এসেছি। নিচতলায় আমার ফ্ল্যাট। দিশেহারা অবস্থা। এই বিল্ডিংয়ের দারোয়ান সুমন আমাকে দেখেই এগিয়ে এসে বললো, ‘কী ব্যাপার ভাই, টাই হাতে দৌড়াদৌড়ি করছেন?’ এই ব্যাটা এ বিল্ডিংয়ের সব ফ্ল্যাটের ভাড়াটিয়াকে স্যার ডাকে। আমাকে ডাকে ভাই। সম্ভবত আমার গরিব গরিব চেহারার জন্যে ভাই ডাকে। মেজাজটা আগের থেকেই গরম ছিলো। একে দেখে আরো গরম হলো। তবু তেতো মুখে বললাম, ‘সুমনরে মহা বিপদে আছি, আমি টাই পরতে পারি না, অথচ কুন্তলের কলেজে টাই বাধ্যতামূলক। ওকে টাই পরা শেখানোর জন্যে ৪ তলায় গিয়েছিলাম। উনিও পারেন না’। সুমন বললো, ‘ভাই এটা কোনো ব্যাপার হলো, টাই বান্ধাতো সহজ। যখন আমি ক্লাস টেনে পড়ি তখন স্কুলে টাই বান্ধার একটা কমপিটিশন হইছিলো, হেড স্যার আমারে টাই পরা শিখিয়েছিলেন। কে আগে টাই পরতে পারে এমন প্রতিযোগিতায় আমি সেকেন্ড হইছিলাম। দেন আমার কাছে দেন, কুন্তলরে আমিই টাই বান্ধানো শিখায়া দিতাছি।’

অথৈ সাগরে পরলে মানুষ খড়কুটাও ধরে বাঁচার জন্যে। আমিতো স্টিমার পেয়ে গেছি। বললাম, ‘তুমি টাই বাঁধতে পারো, তা দাও ওকে শিখিয়ে দাও।’ সুমন মহা উল্লাসে কুন্তলকে টাই পরা শেখাচ্ছে। আমার মনটা ভালো হয়ে গেলো। সুমনকে বললাম, ‘সুমন এ বাড়ির সকল ভাড়াটিয়াকে তুমি স্যার ডাকো। কিন্তু আমাকে ডাকো ভাই, কেনো?’ সে মুহূর্তে বললো, ‘আফনের চেহারা হুবহু আমার বড় ভাইয়ের মতো’। বললাম, ও। সুমন বলছে, ‘আমার বড় ভাই মানে সৎ ভাই। চুরির দায়ে জেলে আছে। জীবনে কতোবার যে চুরি করলো আর কতো বার যে জেল খাটলো। বড়ই বজ্জাত। আমার এই ভাইয়ের চেহারার লগে আফনের চেহারার চৌদ্দআনা মিল।’ বলে কী এই ব্যাটা! আমার চেহারা চোরের মতো? আমি চোর? পায়ের রক্ত মাথায় উঠে গেলো। হারামজাদার সাহস কতো। তার মহান চোর ভাইয়ের সাথে আমার চেহারার মিল পেয়েছে। শরীর কাঁপছে রাগে। একটা থাপ্পর মারার জন্যে হাত নিসপিস করছে। মারতেই হবে। ঠিক তখনই আমার ছেলে চিল্লিয়ে উঠলো, ‘বাবা আমি টাই পরা শিখে গেছি। দারোয়ান আঙ্কেল টাই পরা শিখিয়ে দিয়েছে।’ আমার চোখের সামনেই শিখিয়েছে। কিন্তু মেজাজ সপ্তমে চড়ার কারণে আমি কিছুই দেখিনি। ছেলের কথায় মেজাজের পারা নিম্নগামী হলো। নিজেকে চোর চোর লাগছে। তবু টাই পরা শেখাতে পেরে আনন্দ নিয়েই ঘরে ফিরলাম। দরজায় দাঁড়িয়ে সুমনকে বললাম, ‘সুমন ধন্যবাদ’।

ঘরে এসেও মনের ভেতর খচ্ খচ্ করছে। আয়নার সামনে যাই, নিজের চেহারা দেখি। আমার স্ত্রীকে বললাম, ‘বলতো জগতে সবচেয়ে জটিল কাজ কোন্টি?’ সে বললো, ‘কোন্টি’ ? বললাম, ‘টাই বাঁধা। গলায় টাই বাঁধা।’ তারপর মিনমিন করে বললাম, ‘আচ্ছা লক্ষ্মী সোনা, বলতো আমার চেহারায় কি চোর চোর ভাব আছে?’ সে স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো, ‘অনেকটা’।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়