প্রকাশ : ২৭ জুলাই ২০২২, ০০:০০
এই মহা বিশ্বপ্রপঞ্চ তথা The Universe -এর স্রষ্টার সৃষ্টির অদ্বিতীয় হলো মান-হুঁশ সমন্বিত মানুষ। মানুষের ভেতরের অহঙ্কার বলে দেয় সে কত সম্পদের মালিক। সংস্কার বলে দেয় পারিবারিক নিষ্ঠা কেমন। পছন্দ বলে দেয় তাঁর চিন্তা-ভাবনার মৌলিকত্ব। মানুষের স্বভাবটা কেমন তা স্পর্শে প্রমাণিত হয়। তর্কের দ্বারা প্রমাণিত হয় তার জ্ঞানের ভাণ্ডার কেমন। মানুষটা কেমন তা প্রমাণিত হয় মুখের ভাষা দ্বারা। স্বপ্নই প্রমাণ করে মানুষের ভবিষ্যৎটা কেমন হবে।
মানুষের মন হলো জ্ঞান আহরণের একমাত্র সাধিত্র। জ্ঞান আহরণের উপায় হলো কোনো কিছুর ওপর একনিষ্ঠ মনন, চিন্তন, পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষা, বিশ্লেষণ এবং যৌক্তিকতা মেনে নেয়া। যেমন বিজ্ঞানের অনুপুঙ্খ বিচারে যে কোনো মানুষের এক ফোঁটা রক্তে রয়েছে পাঁচ মিলিয়ন লোহিত কণিকা, দশ হাজার শে^ত কণিকা আর পাঁচ লাখ অনুচক্রিকা। যা ক্ষুদ্রাতি-ক্ষুদ্রাণু।
ইসলাম ধর্মের মর্মানুযায়ী শেষ বিচারের দিনকে রোজ হাশরের দিন বলে। সেই দিনে ৭২+১ = ৭৩ কাতার করে যথাক্রমে নেকী এবং বদীদেরকে দাঁড়াতে হবে এবং ‘মিজান’ একজন একজন করে নেকী-বদী নির্ধারণ করবেন। তাহলে একটা জিনিস প্রতিভাত হচ্ছে যে, অদ্বিতীয় বিচারক হচ্ছেন ‘মিজান’, যা চির সত্য। তাহলে জাগতিকভাবে মহাআশেকী হয়ে অপরাধীর বিচার করার ক্ষমতা কতটুকু আছে তা পাঠকের বিবেচ্য।
এই মহা বিশ্বপ্রপঞ্চের মানবকুলের সৃষ্টি যে অভিন্ন উপাদানে সৃষ্ট তা সন্দেহাতীতভাবে অভ্রান্ত। তবে স্থান-কাল-পাত্র এবং সংস্কার ভেদে বিভিন্ন ধর্মী হয়ে থাকে। এ অবণীতে বিভিন্ন ধর্ম বিশ্বাসী রয়েছে। সকলেরই লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য স্রষ্টার সান্নিধ্য লাভ করা। বস্তুনিষ্ঠ পার্থক্য হলো, কেউ সরাসরি প্রার্থনায় সেই একেশ্বরকে পেতে চায়, আবার কেউ বা সসীম হয়ে অসীমকে পাওয়ার অসম্ভবকে দূর করার জন্য প্রতীকী মাধ্যমকে অবলম্বন করে আছে।
আমাদের জীবনের প্রধান ত্রুটি হলো, আমরা এমন এক স্ব-কপোলকল্পিত আদর্শ স্থির করি, যার গন্তব্য কন্টকাকীর্ণ। অথচ পথটি খুবই মোহময় এবং লোভনীয়। তার অনুপুঙ্খ বিবেচনা না করে মাঝখান থেকে আমরা পথহারা, বিভ্রান্ত এবং অসংযত আচরণে প্রমত্ত হয়ে যাই। প্রমত্ত নদী যেমন তার প্রশস্ততা বৃদ্ধির লক্ষ্যে তীরের মানুষকে গৃহহীন করে, তেমনি ধর্মান্ধরাও কুমতলব হাসিলের লক্ষ্যে রোজ হাশরের ‘মিজানের’ বিচারের কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে সমাজে অনাকাঙ্ক্ষিত অরাজকতার সৃষ্টি করে। ফলস্বরূপ লাঞ্ছিতরা দিশেহারা হয়ে দিগি¦দিক জ্ঞানশূন্য হয়ে যায়। সম্পদ হারিয়ে দেশত্যাগে বাধ্য হয়।
স্রষ্টার সৃষ্টি, মহাশূন্য অবলীলাক্রমে হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, কার্বন-ডাই-অক্সাইড ইত্যাদি দ্বারা পরিপূর্ণ। যা জীব জগতের অস্তিত্বের জন্যে অপরিহার্য। সমস্ত মহাশূন্য যদি অক্সিজেন পরিপূর্ণ থাকতো, তবে উদ্ভিদ জগতের অস্তিত্বই থাকতো না। আবার যদি কার্বন-ডাই-অক্সাইডে পরিপূর্ণ থাকতো, তবে প্রাণী জগতের বিলুপ্তি ঘটতো। স্রষ্টার পরিপূর্ণতার তাগিদেই পরস্পর নির্ভরশীল দু’টি উপাদান অপরিহার্য। মানুষ দুই প্রকার : কট্টরপন্থী ও উদারপন্থী। প্রথমোক্তরা চরম অসহিষ্ণু আর শেষোক্তরা পরম সহিষ্ণু।
এই মহাবিশ্বের জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে যত কিছুই রয়েছে, সব কিছুই সৃষ্টি করেছেন বিধাতা। এটা কিন্তু জাগ্রত অবস্থায় উপলব্ধির বিষয়। কিন্তু ‘জাগ্রত-ঘুমন্ত’ যারা তারাই অসহিষ্ণু এবং সব অনাসৃষ্টির নায়ক।
একমাত্র মানুষকে স্রষ্টাপ্রদত্ত মহামূল্যবান একটি সম্পদ ‘মন’ অন্তরের অন্তঃস্থলে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। মানুষের মনে যে বিস্ময়কর অনন্ত শক্তি নিহিত আছে তা বিজ্ঞানী আইনস্টানের E= mc2 থেকে নির্গত শক্তির চাইতে কম নয়। মানুষের সাধ্যের বাইরে কিছু নেই। প্রকৃষ্ট এবং নৈষ্ঠিক মননশীল, সত্যদ্রষ্টা মানুষই পারে চলমান এই অশান্তির নিরসন করতে।
এই মহান বিশ্ব চরাচরের হেন স্থান নেই যেখানে স্রষ্টার পরিব্যাপ্তি নেই। সেই অসীম স্রষ্টাকে লক্ষ্য করে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র্র কুখ্যাত সসীম কোথায় কী বললো না বললো তা অবশ্যই অশেষ নিন্দনীয় বটে। এখানে প্রকৃত ধর্মী হবে ব্যথিত, শাশ্বত ও স্বতঃসিদ্ধ ধর্মী বলবে ‘হও আশ্রিত’। চলমান অঘটনগুলো অনাকাঙ্ক্ষিত।
বিশ্বের ৭৮০ কোটি মানুষের মধ্যে সেই মহান মাবুদ বিরাজমান, ইউনিভার্সের সর্বস্তরে মহান আল্লাহর পরশ বিরাজমান, আমাদের সর্বকর্মের প্রতি মুহূর্তের হিসাব সংরক্ষিত হচ্ছে। আমাদের ধর্মণ্ডকর্ম, চলন-বলন সব কিছুই সেই মহান রাব্বুল আলামিন প্রদত্ত মন থেকে বেরিয়ে আসে। কাজেই কারো ধর্মানুভূতিতে আঘাতের বিচার হাশরের দিনের মহান মিজানের আওতাধীন বলেই দৃঢ় প্রতীতি থাকা শ্রেয়। অন্যথায় মানব ধর্ম আর পাশব ধর্ম একাকার হয়ে যাবে।
বিমল কান্তি দাশ : কবি ও লেখক; অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র শিক্ষক, বলাখাল যোগেন্দ্র নারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয় ও কারিগরি কলেজ, হাজীগঞ্জ, চাঁদপুর।