প্রকাশ : ২৯ জুন ২০২২, ০০:০০
মাতৃ জঠরে মানব সন্তান, ভ্রুণ থেকে পূর্ণাঙ্গ রূপান্তরের জীবন চক্রের ইতিবৃত্তান্ত প্রকাশ করে দিয়েছে বিজ্ঞান। বাহ্যিক ইন্দ্রিয়গুলোর সাথে আমরা পরিচিত কিন্তু অদৃশ্য ইন্দ্রিয় মন, বুদ্ধি, অহংকার এগুলোকে আগলে রেখেছে স্মৃতি কোষ। এরা কিন্তু পরস্পর প্রতিবেশী। বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠিত আবিষ্কার হলো আলোর গতি প্রতি সেকেন্ডে এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল। মানুষের মন হলো চঞ্চলতম ইন্দ্রিয়, যার গতি আলোর গতির চাইতেও বেশি। মানুষের স্মৃতিকোষে সুপ্ত অবস্থায় লুক্কায়িত থাকতে পারে গণনাতীত সংখ্যক স্মৃতি। শৈশব থেকে মানুষের চলনশক্তি থাকা পর্যন্ত পুঞ্জীভূত স্মৃতিগুলো অবচেতন মনের সহায়তায় যথাস্থানে জমতে থাকে। আবার অবচেতন মনের শৈথিল্যে সুপ্ত অবস্থায় থাকা স্মৃতিগুলো পর্দায় বেরিয়ে এসে আমাদেরকে স্বপ্ন দেখায়। এমন অদ্ভূতস্বপ্নও আমাদেরকে দেখায়, যা আমাদের স্মৃতির অতীত।
অবসরে বসে মানুষ যখন অতি পুরাতন স্মৃতি রোমন্থন করে তখন মন অতি দ্রুততম গতিতে মনের উদ্যোগে স্মৃতির পর্দায় দৃশ্যমান করে মানুষকে পুলকিত এবং আনমনা করে দেয়। পূর্বে ঘটে যাওয়া বেদনাক্লিষ্ট স্মৃতির রোমন্থনে মানুষ কিন্তু মুহূর্তের জন্য হলেও পূর্বানুরূপ বেদনাহত হয়ে যায়। সময় এমনই চলমান যা কারো জন্যই অপেক্ষা করে না। কিন্তু ক্ষণিকের জন্য হলেও অবচেতন মনের স্মৃতির রোমন্থন, হারানো সময় স্মৃতিতে এসে মানুষকে পুলকিত অথবা ব্যথিত করে।
মন, বুদ্ধি এবং অহংকার পরস্পর নিকটতম প্রতিবেশী। মনের চঞ্চলতার কারণে মানুষ সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে এবং কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায়। তখন মানুষ অমানবিক সিদ্ধান্তে আপ্লুত হয়ে যায়। ঠিক সেই মুহূর্তে মনের প্রতিবেশী বুদ্ধির ভাল প্রভাবে কুবুদ্ধি পরিহারে মানুষ উৎসাহিত হয়ে যায়।
তৃতীয় অদৃশ্য ইন্দ্রিয় অহংকার মানুষকে নিশ্চিত ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। এই অহংকার রূপ, ঐশ্বর্য, বিক্রম এবং বৃত্তাতিক্রান্ত রাজ্যেরও হতে পারে। সব অহংকারই পতনের মূল। এখানে অন্য একটি প্রসঙ্গ তোলা বাহুল্য হবে না। আগুন হলো মানব সভ্যতার A great grand father. তারপরের গুলো হলো Miracle of Modern adventure. যেমন যুগের ‘ডিজিটালাইজেশন’। এক সময় আবিষ্কার ছিল ‘All transister’ অর্থাৎ সমস্ত বিশ্বের বেতার বার্তা গ্রাহক যন্ত্র। আর আজকের আবিষ্কার হলো মানুষের দৈনন্দিন জীবনের জন্য অপরিহার্য প্রয়োজনগুলো মিটায় যে মোবাইল। সবইতো হয়ে গেল, বাকি অসম্ভবগুলো মানুষের জীবন দান, রিজিক দান। চঞ্চল মনের নিয়ন্ত্রণে থাকা ষড়রিপু যেমন কাম, লোভ, ক্রোধ, মোহ, মাত , মাতশর্য। এ গুলো কিন্তু স্ব-গুণে গুণান্বিত হয়েই নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়।
বিজ্ঞানের আশীর্বাদ স্বরূপ মোবাইল বিদ্যুৎ গতিতে সমগ্র বিশ্বে যেমন কোন সংবাদ প্রচার করে দেয় তেমনি বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব চোখের পলকে ধ্বংস করে দিয়েছিল জাপানের হিরোশিমা-নাগাসাকিকে।
আজ-কাল বয়স্ক ছেলে-মেয়েরা মোবাইলে পরস্পরকে অবলোকন করে মোবাইলেই বিয়ে করে ফেলে। সামাজিক রীতি-নীতি বা আচার-অনুষ্ঠানের কোনো তোয়াক্কাই করে না। ফলে অনাকাঙ্ক্ষিত বিবাহ-বিচ্ছেদ এবং আত্মহত্যা মহামারী রূপে দেখা দিয়েছে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, আইনস্টাইনের আণবিক তত্ত্ব চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রভূত উন্নতি সাধন করেছে, যা জাতি-ধর্ম-বর্ণ বিচারে আসে না।
আজকাল অনেক পরিবারে যে অনভিপ্রেত দৃশ্য দেখা যায়, যা আদৌ কাম্য নয়। বরং এই বাংলার জন্য অপসংস্কৃতি। মা তার বয়স্ক সন্তানদেরকে অত্যাধুনিক মোবাইল আসক্তিতে যেন সময় নষ্ট না হয় তজ্জন্যে তাদেরকে খাওয়ায়ে দিতে হয়। এ দৃশ্য কিন্তু নিকট ভবিষ্যতে পারিবারিক অশান্তির অশনি সংকেত। সন্তানের প্রতি পিতা মাতার স্নেহ স্রষ্টা প্রদত্ত। অপত্য স্নেহ কিন্তু অবিজ্ঞজনোচিত।
বিজ্ঞানের আশীর্বাদগুলো মানব সভ্যতাকে স্বচ্ছ সলিলে অবগাহন করায়, বিজ্ঞানের অভিশাপ গুলো মানব সভ্যতাকে পঙ্কিল সলিলে নিমজ্জিত করায় । মোবাইলের বিচ্ছুরিত ভায়োলেট রশ্মি মানব চক্ষুকে পরিণামে আঘাত করে বিধায় ছোট-বড় নির্বিশেষে এর ব্যবহার অত্যন্ত সীমিত করা উচিত।
আদি যুগে মানব সন্তানের নাম ছিল ‘অমৃতস্য পুত্রাঃ’। মধ্যযুগের নামান্তর হলো ‘মানুষ’, আধুনিক যুগের নামাকরণ হলো ‘অতৃপ্ত জীব’। মায়েদের মাতৃত্ব ইচ্ছা অত্যন্ত সীমিত। এ ক্ষেত্রে পিতাণ্ডমাতার সাথে সন্তানের অবাধ্যতার কারকতা ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হয়। ক্রমাগত এ আচরণ সেই সন্তানকে বেপরোয়া স্বেচ্ছাচারিতায় অভ্যস্ত করে। অসহায় মা-বাবা এ সমস্যা প্রতিকারে অক্ষম। বিদগ্ধ মনের তাড়নায় এ অনাকাঙ্ক্ষিত জীবন থেকে তারা মুক্তি চাচ্ছে। পরিবারের সন্তানই হলো ফুলের বাগান। সেই বাগানে বিভিন্ন প্রকার ফুলের সমারোহ থাকাটাই স্বাভাবিক। বাগানের একটি বা দুটি ফুলের সৌরভই জগতের প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিত্বের প্রতিভূ। প্রাথমিক জ্ঞানাদর্শ সুন্দর মনের জন্ম দেয়, সুন্দরমন আদর্শ মানুষ সৃষ্টি করে, আর আদর্শ মানুষ সুন্দর সমাজের প্রতিভূ। মানবরূপী অতৃপ্ত জীবগুলো সকল সামাজিক অশান্তির নিকৃষ্ট নায়ক, আর মানবতার মহাশত্রু।
বিমল কান্তি দাশ : কবি ও লেখক; অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র শিক্ষক, বলাখাল যোগেন্দ্র নারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয় ও কারিগরি কলেজ, হাজীগঞ্জ, চাঁদপুর।