প্রকাশ : ২৮ জুন ২০২২, ০০:০০
গত রোববার রাত দশটার দিকে ঢাকায় আমাদের প্রিয় চুন্নু ভাইয়ের মৃত্যু হয়। তাঁর সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা ১৯৮৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে। একদা একই রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে থাকলেও পরবর্তীতে আমরা বিপরীত মেরুতে অবস্থান করি। তিনি এক সময় হাইমচর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে পরাজিত হয়ে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হলেন। সকল ভবিষ্যৎ বাণীকে উড়িয়ে দিয়ে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হন। স্থানীয় নানান ইস্যুতে মতপার্থক্য থাকলেও তিনি আমাকে অনেক পছন্দ করতেন। দিনের কোনো একটি সময়ে আমাদের দেখা হতো। দেখা না হলে আমাকে দেখা করতে খবর পাঠাতেন। দেখা হলে প্রথম প্রশ্ন থাকতো, ভাত খেয়েছো? কী খাবে এখন?
চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আমার দলের অবস্থান জানতে চাইতেন। উন্নয়ন, দুর্নীতি, সুশাসন, স্বজন প্রীতি নিয়ে কথা উঠলেই মতাদর্শগত পার্থক্য থাকার কারণে বিতর্ক সৃষ্টি হতে বেশি সময় লাগতো না। এসব বিতর্কে আশপাশের লোকজন জুটে যেত। বিতর্ক শেষ হতো আমাকে তাঁর মোটরসাইকেলের পিছনে বসিয়ে নিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে।
স্বাধীনচেতা চড়া মেজাজের চুন্নু ভাইয়ের ক্রাইসিস ম্যানেজার হিসেবে সফলতা ছিলো কম। নতুন উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান হবার পর বিভিন্ন অংশীজনের সাথে মতবিরোধ তীব্র হলো। ছয় চেয়ারম্যান তাঁর বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব পাস করে। চুন্নু ভাই একটা লাল রঙের মোটরসাইকেল চালাতেন। প্রায়ই আমি তাঁর সহযাত্রী হতাম।
আমি পিছনে বসলে ধুলায় গা ভরে যেত, তাই যেতে চাইতাম না। তিনি আমাকে ভরসা দিতেন অতি দ্রুত জীপ গাড়ি পাবেন। শেষ পর্যন্ত পেয়ে গেলেন জীপ। নতুন জীপে করে হাইমচর বাজার ঘুরে জনসাধারণের সাথে কথা বললেন। আমরা কয়েকজন জীপের পিছনে বসার সুযোগ পেলাম। হলধর বাঙালি চুন্নু ভাইকে গরম রসগোল্লা খেতে দিলেন। চুন্নু ভাই হাইমচরের নদী ভাঙ্গন নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়লেন। সরকারের ওপর মহলে যোগাযোগ করে চরম হতাশার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন। ভাঙ্গন তীব্র হলে আমরা মিছিল-মিটিং করে নদী ভাঙ্গনের হাত থেকে হাইমচরকে রক্ষা করার দাবি জানাই। আমরা এলাকার যুবকদের সাথে মতবিনিময় সভার আয়োজন করি। সেখানে সিদ্ধান্ত হয় চুন্নু ভাইকে আন্দোলনের সাথে যুক্ত করতে হবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরদিন গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি মাথায় নিয়ে চুন্নু ভাইয়ের বাড়িতে হাজির হলাম। আমাদের সব কথা শুনে তিনি বললেন, তোমরা আমার চেয়ারম্যানি হারানোর লাইনে নামাতে চাও। যে মানুষ আমাকে নির্বাচিত করেছে সেই মানুষের অধিকার আদায়ে আমি সামনের সারিতে থাকবো, যা হবার তাই হবে!
আমাদের সাথে নিয়ে তিনি পায়ে হেঁটে হাইমচর বাজারে আসলেন। বাজারে ঢোকার সময় শ্লোগান উঠলো, গ্রোয়েন বাঁধ নির্মাণ কর, হাইমচরকে রক্ষা কর। মুহূর্তে শ্লোগান দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়লো। শত শত মানুষ চুন্নু ভাইয়ের নেতৃত্বে মিছিলে সামিল হয়ে গেল। পূর্ব বাজারে একটি চেয়ারে দাঁড়িয়ে তিনি তাঁর বক্তৃতা দিলেন। তিনি জনগণের আন্দোলন-সংগ্রামে লড়াকু ভূমিকা পালনের অঙ্গীকার করলেন এবং সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করার শপথ নিলেন। জনতা তুমুল করতালি আর গগণবিদারী চিৎকার করে জানিয়ে দিলো, তাঁরাও শেষ পর্যন্ত চুন্নু মিয়ার সাথে থাকবে।
তারপর সভা-সমাবেশ, মিছিল-মিটিং, সংবাদ সম্মেলন, গণকান্না, গণসংযোগ শেষে হাইমচরের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে ইস্পাত কঠিন ঐক্য তৈরি হলো দল-মত নির্বিশেষে।
সেই সময় দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার গোলাম কিবরিয়া জীবন, সংবাদের অজিত কুমার মুকুল, সাপ্তাহিক চাঁদপুরের কাজী শাহাদাত ভাঙ্গন কবলিত এলাকায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সফর করেন। পরদিন ইত্তেফাক ও সংবাদে বড় করে সংবাদ ছাপা হতো। সাপ্তাহিক চাঁদপুর প্রতি সপ্তাহে অর্ধেক পৃষ্ঠা জুড়ে হাইমচরের নদী ভাঙ্গন এলাকার দুঃখণ্ডদুর্দশার খবর ছাপতো।
জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ হওয়ায় সরকার বিষয়টি গুরুত্ব দেয়া শুরু করে। মন্ত্রীরা ভাঙ্গন কবলিত এলাকা পরিদর্শন করেন।
উপায়হীন হয়ে দশ হাজার হাইমচরবাসী ২০ আগস্ট ১৯৮৮ সালে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে গণঅনশনে অংশ গ্রহণ করে। সেদিন সকল রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় নেতারা হাইমচরবাসীর দাবির প্রতি একাত্মতা ঘোষণা করে। রাতে পুলিশ উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কায়কোবাদ চুন্নুকে গ্রেফতার করে এবং পরবর্তীতে সরকার তাকে চেয়ারম্যান পদ থেকে বরখাস্ত করে।
হাইমচরবাসী সরকারের এমন সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। পরবর্তী উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে জনগণ চুন্নু ভাইকে বিজয়ী করে তাদের ওয়াদা পালন করেছে। তিনি মানুষের ভালোবাসা যেমন পেয়েছেন, তেমনি সমালোচিতও ছিলেন। দীর্ঘ সময় ধরে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। নদী ভাঙ্গন আন্দোলনে যুক্ত থাকা আমেরিকা প্রবাসী শাহাদাত ভাই হাইমচর ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন থেকে হাইমচরে ২০১৯ সালে চুন্নু ভাইয়ের জন্যে সংবর্ধনার আয়োজন করেছিলেন। জীবিত থাকাকালীন এটাই ছিলো নদী ভাঙ্গন প্রতিরোধে আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি। চুন্নু ভাই ধোয়া তুলসী পাতা ছিলেন কিনা সে বিষয়ে বিতর্ক থাকলেও তিনি যে তুলসী পাতা ছিলেন সে বিষয়ে কারো কোনো আপত্তি নেই।
যতদিন নদী ভাঙ্গন নিয়ে মানুষ কথা বলবে ততদিনই চুন্নু ভাইয়ের কথা মানুষের মনে পড়বে। মানুষ শুধু দাতাকে স্মরণ করে, গ্রহীতাকে স্মরণ করে না । চুন্নু ভাই মানুষের কল্যাণে জেল হাজতে কাটিয়েছেন এবং সাধের চেয়ারম্যানশীপ হারিয়েছেন, সে জন্যে হাইমচরবাসীর কাছে তিনি একজন বীর। বীরের মৃত্যু হয় না, বীর বেঁচে থাকেন মানুষের মনের মধ্যে।
চুন্নু ভাই আপনাকে অনেক মিস করবো।