প্রকাশ : ১৯ জুন ২০২২, ০০:০০
পদ্মা নদী বাংলাদেশের প্রধান নদী। পদ্মা হিমালয় (হিমালয়ের গঙ্গোত্রী হিমবাহ) থেকে উৎপন্ন গঙ্গা (ভাগীরথী গঙ্গা) নদীর প্রধান শাখা নদী। বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ শহর রাজশাহী পদ্মা নদীর উত্তর তীরে অবস্থিত। পদ্মার সর্বোচ্চ গভীরতা ১৫৭১ ফুট এবং গড় গভীরতা ৯৬৮ ফুট। পদ্মা নদীটি ১২০ কিমি দীর্ঘ এবং ৪ থেকে ১০ কি.মি. প্রশস্ত এবং নদীটির প্রকৃতি সর্পিলাকার। শোনা যায়, পদ্মা নদীর আগের নাম ছিল কীর্তিনাশা নদী। পদ্মা নদীর প্রধান উপনদী মহানদী এবং পুনর্ভবা। পদ্মার বিভিন্ন শাখা নদীর মধ্যে গড়াই, বড়াল আড়িয়াল খাঁ, কুমার, মাথাভাঙ্গা ইত্যাদি। পদ্মা নদী মূলত গঙ্গার নিম্ন স্রোতধারার নাম। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গোয়ালন্দ-চাঁদপুর স্টিমার চলাচল পথের অধিকাংশই এই নদী জুড়ে। শোনা যায়, হিমালয়ের গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে উৎপন্ন গঙ্গা নদী রাজশাহী জেলা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে এবং এখান থেকেই নদীটি পদ্মা নাম ধারণ করেছে। অপরদিকে গঙ্গা, ভাগীরথী নামে ভারতের হুগলীর দিকে প্রবাহিত হয়েছে। আরও জানা যায়, গোয়ালন্দে যমুনা নদীর সাথে মিলিত হয়ে মিলিত প্রবাহ পদ্মা নামে পূর্ব দিকে চাঁদপুর জেলায় মেঘনা নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। সবশেষে পদ্মা-মেঘনা মিলিত প্রবাহ দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরে মিলিত হয়।
সেই পদ্মা নদীতে বহু প্রতীক্ষিত পদ্মা সেতু। পদ্মা সেতু বাংলাদেশের পদ্মা নদীর ওপর নির্মিত একটি বহুমুখী সড়ক ও রেল সেতু। প্রমত্তা ও খরস্রোতা পদ্মা নদী। তার উপর সেতু। এক দশক আগেও পদ্মা নদীতে ব্রিজ তৈরি স্বপ্ন ছিল। বহু প্রতীক্ষিত সেই স্বপ্ন জাতির পূরণ হতে যাচ্ছে। ২৫শে জুন উদ্বোধন হতে যাচ্ছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। পদ্মা সেতু পদ্মা নদীর ওপর বহু আকাক্ষিত বহুমুখী সড়ক ও রেল সেতু। দুই স্তর বিশিষ্ট স্টীল ও কংক্রিট নির্মিত ট্রাস, এই ব্রিজটির উপরে থাকবে চার লেনের সড়ক পথ এবং নিচের স্তরে থাকবে একটি একক রেল পথ। পদ্মা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা নদীর অববাহিকায় ৪২টি পিলার, ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের ৪১টি স্প্যানের মাধ্যমে মূল অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে।
পদ্মা সেতুতে যে পাথর ব্যবহৃত হয়েছে তার এক একটির ওজন এক টন। পাথর ভারতের ঝাড়খণ্ড রাজ্য থেকে আমদানি করা হয়েছে। সেতুর পাইলিংয়ে ১২২ মিটার গভীরে স্টীলের পাইল বসানো হয়েছে। এইসব পাইল তিন মিটার ব্যাসার্ধের। বিশ্বের এখনও পর্যন্ত কোনো সেতুর জন্য এত গভীরে পাইলিং হয়নি। এবার আসছি ভূমিকম্পের বিয়ারিংয়ে। পদ্মা সেতুতে ফিকশন পেন্ডুলাম বিয়ারিং লাগানো হয়েছে। যার সক্ষমতা ১০,০০০ টন। এখনও বিশ্বের কোনো সেতুতে এত ক্ষমতার বিয়ারিং লাগানো হয়নি। রিখটার স্কেলে ৯ মাত্রার ভূমিকম্পেও টিকে থাকতে পারবে এই পদ্মা সেতু। নদী শাসনে চীনের ঠিকাদার সিনেহাইড্রো কর্পোরেশনের সঙ্গে ১১০কোটি মার্কিন ডলার চুক্তি হয়েছে। এর আগে নদীশাসনে এককভাবে এত বড় দরপত্র বিশে^ আর হয়নি। নদীশাসনের আর একটা রেকর্ড হলো, ১৪ কিলোমিটার (১.৬ কিমি মাওয়া প্রান্তে ও ১২.৪ কিমি জাজিরা প্রান্তে, এলাকা নদীশাসনের আওতায় আনা হয়েছে। পদ্মা সেতু প্রকল্প তিন জেলায় বিস্তৃত। মুন্সিগঞ্জের মাওয়া, শরীয়তপুরের জাজিরা এবং মাদারীপুরের শিবচর। পদ্মা সেতুতে পাইলিংয়ে অতি মিহি সিমেন্ট ব্যবহার করা হয়েছে। এই সিমেন্ট অস্ট্রেলিয়া থেকে আনা হয়েছে। এই সেতুটির নকশাকার হচ্ছে এ-ই-সি-ও-এম এবং নির্মাণকারী সংস্থা হচ্ছে চীন মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন কোম্পানী লিঃ। ব্রিজটির নির্মাণ শুরু হয় ২০১৪ সালের নভেম্বরে এবং নির্মাণ শেষ হয় ২০২২ সালের জুন মাসে। আনুমানিক নির্মাণ ব্যয় প্রায় ৩০,৭৯৩ কোটি ৩৯ লক্ষ টাকা। সেতুটির অন্যান্য বিশেষত্ব হচ্ছে : পদ্মা সেতুর দৈর্ঘ্য ৬.১৫ কিলোমিটার। ডাঙ্গার অংশসহ সেতুটির মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ৯ কিলোমিটার। দ্বিতল পদ্মা সেতুর এক অংশ থাকবে মুন্সিগঞ্জের মাওয়ায়, আর এক অংশ শরীয়তপুরের জাজিরায়। পদ্মা সেতুতে সিসি ক্যামেরা থাকছে। সেতুতে সাধারণ আলোর ব্যবস্থা ছাড়াও আর্কিটেকচার লাইটিং থাকছে। বিশেষ বিশেষ দিনে বা বিশেষ বিশেষ সময়ে লাইটিংয়ের মাধ্যমে শোভা বর্ধন করা হবে। নদীর জল থেকে পদ্মা সেতুর উচ্চতা ১৮ মিটার। সুতরাং নৌযান চলাচলে সমস্যা থাকবে না। পদ্মার মতো স্রোতস্বিনী এমন নদীর উপর বিশ্বে সেতু হয়েছে মাত্র একটি, যেটা আমাজন নদীতে।
এবার দেখা যাক, অর্থনৈতিক দিক দিয়ে পদ্মা সেতুর গুরুত্ব কতখানি? পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প মাওয়া-জাজিরা পয়েন্ট দিয়ে নির্দিষ্ট পথের মাধ্যমে দেশের কেন্দ্রের সাথে দক্ষিণ-পশ্চিম অংশের সরাসরি সংযোগ তৈরি করবে। এই সেতুটি শুধু দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নয়, পুরো বাংলাদেশের অর্থনীতি বদলে দেবে। এই সেতু দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যোগাযোগ, বাণিজ্য, পর্যটনসহ অনেক ক্ষেত্রেই উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে চলেছে। সব মিলিয়ে এই সেতু জনগণের স্বপ্নের সেতু হয়ে উঠবে। এই সেতু অপেক্ষাকৃত অনুন্নত অঞ্চলের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও শিল্প বিকাশে উল্লেখযোগ্যভাবে অবদান রাখবে। সেতুটির ফলে প্রত্যক্ষভাবে প্রায় ৪৪০০০ বর্গ কি. মি. বা বাংলাদেশের মোট এলাকার ২৯% অঞ্চল জুড়ে ৩ কোটিরও অধিক মানুষ উপকৃত হবে। ফলে প্রকল্পটি দেশের পরিবহন নেটওয়ার্ক এবং আঞ্চলিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের একটা গুরুত্বপূর্ণ সমন্বিত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। বাংলাদেশের কৃষি ব্যবস্থাতে অনেক উন্নতি ঘটবে। বিশেষ করে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কৃষি ব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি ঘটবে। এমনিতেই দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল কৃষিতে উন্নত। বেনাপোলের সঙ্গে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গার সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত থেকে উন্নততর হবে। অনেকের ধারণা, পুরো দেশের অর্থনীতিতে এর প্রভাব পড়বে। কৃষি, শিল্প, অর্থনীতি, শিক্ষা, বাণিজ্য সব ক্ষেত্রেই পদ্মা সেতুর প্রভাব অনিবার্য। পদ্মা সেতুর ফলে পর্যটন শিল্পে নতুন মাত্রা যোগ হচ্ছে। পর্যটন ব্যবস্থা উন্নত হলে হোটেল-রেস্তোরাঁ আরও বাড়বে।
এবার আসা যাক পদ্মা সেতুর কারণে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের জায়গাগুলোতে। উপরে যথারীতি বর্ণিত যে, বেনাপোল থেকে বাংলাদেশের সমস্ত জায়গার যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি ঘটবে। ফলে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার যে আরও উন্নতি ঘটবে চোখ বুঁজে সেটা অনুধাবন করা যায়। ভারত-বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও মধুর হবে। ভারত থেকে অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্য যেমন পিয়াঁজ ইত্যাদি আমদানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অনেক সুবিধা হবে। আগে যাতায়াতের খরচ ছিল অনেক, তেমনি দ্রব্যসামগ্রী পৌঁছাতে সময় লাগতো। পদ্মা সেতুর জন্য সড়ক ও রেলপথে ভারত থেকে বাংলাদেশের যে কোনো জায়গায় অনায়াসে পৌঁছানো যাবে এবং সেটা কম খরচে ও কম সময়ে। এই সুবিধাগুলো বাংলাদেশের কাছে একটা বড় পাওনা। তা ছাড়া পর্যটন শিল্পেও ভারতের সঙ্গে একটা সুসম্পর্ক গড়ে ওঠার প্রবণতা বাড়বে বৈ কমবে না। ফরিদপুর, মাদারীপুর, ঢাকা যেতে এখন দুঃশ্চিন্তায় মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়তে হবে না। সমস্ত দিক মাথায় রেখে এটা বলা যায়, পদ্মা সেতুর কারণে ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী বন্ধন আরও সুদৃঢ় হবে।
পদ্মা সেতু হচ্ছে বাংলাদেশের স্বপ্ন, সাহস ও সক্ষমতার প্রতীক। পদ্মা সেতু হচ্ছে বাংলাদেশের অহংকারের প্রতীক। পদ্মা সেতুর মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিকাঠামো আরও উন্নত হোক এবং বাংলাদেশের মানুষের সামাজিক, অর্থনৈতিক অবস্থার আরও উন্নতি ঘটুক। সমানভাবে এটাও আশা রাখছি, পদ্মা সেতুর জন্য ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক আরও মজবুত হোক এবং বাণিজ্যিক সম্পর্কের বহুত উন্নতি ঘটুক।
দিলীপ রায় : লেখক, কলামিস্ট, কলকাতা (+৯১ ৯৪৩৩৪৬২৮৫৪) ।