প্রকাশ : ০৯ জুন ২০২২, ০০:০০
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
॥ আট ॥
সাহিত্য একাডেমী, চাঁদপুর-এর সভাপতি হিসেবে চাঁদপুরের অষ্টাদশ জেলা প্রশাসক মোঃ আব্দুস সবুর মন্ডলের কর্মকালে (০২.০৭.২০১৫ খ্রিঃ থেকে ০৫.০৩.২০১৮ খ্রিঃ) ২০১৭ সালের ৬ মে চাঁদপুর জেলা শিল্পকলা একাডেমী মিলনায়তনে যখন ‘চাঁদপুর সাহিত্য সম্মেলন ২০১৭’ অনুষ্ঠিত হয়, তখন ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে সম্মেলনের প্রধান অতিথি বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক ড. শামসুজ্জামান খান তাঁর বক্তব্যে এ সম্মেলনের মানকে জাতীয় মান এবং চাঁদপুর হবে সাহিত্যের রাজধানী-এমন মন্তব্য করলে ব্যাপক হৈ চৈ পড়ে যায়। চাঁদপুরের ইতিহাসে এমন সাহিত্য সম্মেলন এটাই প্রথম হওয়ায় এবং এতে বিপুল সংখ্যক কবি-সাহিত্যিকের উপস্থিতি ঘটায় সুধী-বোদ্ধা মহলে সেটি বিশেষ আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। এতে ঈর্ষান্বিত হয় একটি মহল। এরা ছিদ্রান্বেষণ করে জানতে পারলো, সাহিত্য একাডেমী, চাঁদপুর-এর যে নির্বাহী পরিষদ সাহিত্য সম্মেলনের নামে বিপুল কর্মযজ্ঞ করলো, সেটি মোয়াদোত্তীর্ণ। তারা বেনামে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বরাবরে লিখিত অভিযোগ করে বসলো- টিআইবির সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি পদে থেকেও কাজী শাহাদাত অনৈতিকভাবে সাহিত্য একাডেমীর মহাপরিচালক পদটি মোয়াদোত্তীর্ণ সময়েও জোর করে দখল করে আছেন।
আর যায় কোথায়?
জেলা প্রশাসক আব্দুস সবুর মন্ডলের বিদায়ের পর ২০১৮ সালে তাঁর স্থলাভিষিক্ত মোঃ মাজেদুর রহমান খান সাহিত্য একাডেমীর সভাপতি থাকাকালীন টিআইবি থেকে তিন সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত দল চাঁদপুরে আসলো। তারা তিনদিন ধরে তদন্ত করে যেটা পেলো, সেটা হচ্ছে : কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ ঠিকই, তবে মহাপরিচালকসহ অন্যান্য পদ কেউ জোর করে দখল করে রাখেন নি। জেলা প্রশাসকগণ তাঁদের বহুবিধ কাজের ব্যস্ততায় সময় দিতে পরেন নি বলে সাধারণ সভা করা সম্ভব হয়নি এবং সেজন্যে নূতন কমিটিও গঠিত হয়নি। অগ্যতা বিদ্যমান কমিটি তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এমন তদন্তের পর সাধারণ সভা করার তাগিদ অনুভূত হলেও করোনার প্রকোপে সেটা করা আর সম্ভব হয়নি।
১৯তম জেলা প্রশাসক মোঃ মাজেদুর রহমান খানের বিদায়ের পর ২০২১ সালের ৩ জানুয়ারি ২০তম জেলা প্রশাসক হিসেবে অঞ্জনা খান মজলিশ যোগদানের কিছুদিনের মধ্যে করোনার প্রকোপ বাড়ে। করোনা কমে আসলে মহাপরিচালক আগস্ট মাসে জেলা প্রশাসকের সাথে দেখা করেন এবং পদত্যাগের ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। তখন জেলা প্রশাসক নির্বাহী পরিষদের সভা ডাকার কথা বলেন এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠান করার তাগিদ দেন। সেমতে ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২১ তারিখে সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সভায় মহাপরিচালক বলেন যে, সাহিত্য একাডেমীর নির্বাহী কমিটি ২০১৩ সালে গঠন করা হয়। যার ০২ বছর মেয়াদ ২০১৫ সালে উত্তীর্ণ হয়। বিভিন্ন কারণে নির্বাহী কমিটির সভা এবং সাধারণ সভা আয়োজন করা যায় নি। তিনি নতুন নির্বাহী কমিটি গঠনের সিদ্ধান্তের প্রস্তাব করেন। সভাপতি (জেলা প্রশাসক) বলেন, একাডেমীর গঠনতন্ত্র সংশোধনপূর্বক পরবর্তী নির্বাহী কমিটি গঠন করা হবে। নতুন নির্বাহী কমিটি গঠনের পূর্ব পর্যন্ত বর্তমান কমিটিকে দায়িত্বপালনের আহ্বান জানান। এছাড়া তিনি একাডেমীর গঠনতন্ত্র সংশোধনের জন্যে একটি কমিটি গঠনের প্রস্তাব করেন, যেটি সিদ্ধান্ত আকারে গৃহীত হয়। এ কমিটিতে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক)কে আহ্বায়ক ও কাজী শাহাদাতকে সদস্য সচিব এবং চাঁদপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, সহকারী কমিশনার (শিক্ষা ও আইসিটি), অধ্যক্ষ জালাল চৌধুরী ও ডাঃ পীযূষ কান্তি বড়ুয়াকে সদস্য হিসেবে রাখা হয়। এ সংক্রান্ত কার্যবিবরণী যথাসময়ে একাডেমীর অফিস সহকারী মাসুদ দেওয়ান উক্ত কমিটির আহ্বায়কসহ অন্য সকলকে এবং একাডেমীর নির্বাহী পরিষদের সকল সদস্যকে পৌঁছে দেন।
৩০ সেপ্টেম্বরের নির্বাহী পরিষদের সভায় সভাপতি হিসেবে অঞ্জনা খান মজলিশ তাঁর বক্তব্যে বলেন, আমি আশা করি, সাহিত্য একাডেমী চাঁদপুর জেলার সাহিত্য এবং সাহিত্যিকদের উন্নয়নে এখন থেকে আরো বেশি ভূমিকা রাখবে। কবি সাহিত্যিকদের চারণকেন্দ্র হিসেবে সাহিত্য একাডেমী পরিচিতি লাভ করবে। তিনি বলেন, এই একাডেমীকে গতিশীল করতে সম্ভাব্য সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
নির্বাহী পরিষদের সভার পরদিন ১ অক্টোবর ২০২১ বিকেলে চাঁদপুর রোটারী ভবনে ডাঃ নুরুর রহমান কনফারেন্স হলে মুজিব শতবর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী স্মারক ‘সুবর্ণ-শতকে’র পাঠ পর্যালোচনা অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপ্রধানের বক্তব্যে জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ বলেন, “ ‘সুবর্ণ-শতক’ স্মারক গ্রন্থটি একটি মাইল ফলক হয়ে থাকবে। এই গ্রন্থটিতে আঃ গাফ্ফার চৌধুরী, সেলিনা হোসেন, শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনিসহ অনেক প্রতিথযশা লেখকের মানসম্পন্ন লেখা গল্প, প্রবন্ধ, কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। স্মারক গ্রন্থটি প্রকাশ করতে গিয়ে সাহিত্য একাডেমী চাঁদপুরের মহাপরিচালক কাজী শাহাদাত, সম্পাদক ডাঃ পীযুষ বড়ুয়া ও ফরিদ হাসান যথেষ্ট পরিশ্রম করেছেন। তাঁদেকে ধন্যবাদ জানাই। এই প্রকাশনার মধ্যেই আমাদের সন্তুষ্ট থাকলে হবে না। আমাদেরকে আরো কাজ করতে হবে। চাঁদপুর সাহিত্য একাডেমীকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। আগ্রহী লেখকদের উৎসাহ দিতে হবে। করোনার কারণে আমরা অনেক পিছিয়ে গিয়েছি। এ সময় আমি চেষ্টা করেছি শিল্পী, কলাকুশলী, সাংবাদিক, লেখকদের পাশে থাকতে এবং তাদেরকে সাধ্যমত সহযোগিতাও প্রদান করেছি। চাঁদপুরের শিল্প সাহিত্যকে এগিয়ে নিয়ে যেতে আমি কাজ করব। এজন্য আপনাদের সহযোগিতার প্রয়োজন রয়েছে। আজ প্রধান অতিথি ও আলোচকবৃন্দ শুধুমাত্র ‘সুবর্ণ-শতক’-এর উদ্বোধনের জন্য চাঁদপুরে ছুটে এসেছেন। তাতেই বোঝা যায় তাঁরা চাঁদপুরকে কতটা ভালোবাসেন।”
২৪ নভেম্বর ২০২১ তারিখে সাহিত্য একাডেমী মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয় নবান্ন উৎসব। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ বলেন, ‘নবান্ন উৎসব বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। এ প্রজন্মের অনেকেই নবান্ন উৎসব সম্পর্কে জানে না। তারা অন্য দেশের সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহী। এটি সমাজের নেতিবাচক পরিবর্তন। আমাদেরকে এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে। তাদেরকে বাঙালি সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে। তিনি বলেন, আমরা আমাদের সন্তানদের সময় দিতে পারছি না। ফলে তারা এখন ইন্টারনেটের জগতে বুঁদ হয়ে থাকে। এর পরিণতি ভালো হবে না। তারা দেশকে ভালোবাসবে না। এ থেকে উত্তরণের জন্যে আমাদের সন্তানদের সময় দিতে হবে। তাদেরকে মানবিকবোধসম্পন্ন ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। সন্তানদের মাটির কাছাকাছি, সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের সাথে সম্পৃক্ত করতে হবে। তাহলে সমাজে বড় ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তন হবে।
তিনি বলেন, সাহিত্য একাডেমী আরো সক্রিয় হোক। লেখকদের পদচারণায় সরব হোক। সাহিত্যের মধ্যে থাকলে প্রজন্মের মধ্যে ইতিবাচক পরিবর্তন হবে। সাহিত্য একাডেমী এমন কাজগুলো নিয়মিত করবে। এমন কার্যক্রমে আমার সহযোগিতা সবসময়ই থাকবে। নবান্ন উৎসবের মাধ্যমে প্রজন্ম আমাদের সংস্কৃতি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করতে পারবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
তিনি সাহিত্য একাডেমীর একটি মাসিক সাহিত্য আসরেও অংশগ্রহণ করেন। তাঁর অভিপ্রায়ে ডিসেম্বর পর্যন্ত চলে ব্যাপক কার্যক্রম। যে কার্যক্রম সাহিত্য একাডেমীর ইতিহাসে অত্যল্প সময়ে অনেক বেশি কার্যক্রম বলে বিবেচিত। তারপর গেল মার্চ ২০২২ সালে সাহিত্য একাডেমীর ভবন সংস্কারে ও উন্নয়নে তিনি অনুদান প্রদান করেন। যে অনুদানের অর্থে এখনও কাজ চলমান।
মে ২০২২ সালের শেষ দিকে চাঁদপুর থেকে নেত্রকোনায় বদলির আদেশ পান অঞ্জনা খান মজলিশ। তিনি সাহিত্য একাডেমীর মহাপরিচালকের নিকট সর্বশেষ (৩০/৯/২০২১) নির্বাহী পরিষদ সভার কার্যবিবরণী ও গঠনতন্ত্র তলব করেন। সেমতে অফিস সহকারী সেটি পৌঁছে দেন। তিনি মহাপরিচালককে নির্বাহী পরিষদের সভা আহ্বানের জন্যে নির্দেশ বা অনুরোধ করেন নি। ২৩ মে সন্ধ্যা ৭টার পর তাঁর কার্যালয়ের সহকারী কমিশনার দেবযানী কর মহাপরিচালকসহ নির্বাহী পরিষদের সদস্যদের ফোন করে জানালেন, কাল (২৪ মে) সকাল সাড়ে ১০টায় জেলা প্রশাসক মহোদয়ের অফিস কক্ষে সাহিত্য একাডেমীর নির্বাহী পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত হবে এবং যথাসময়ে আমাদের বাহক আপনাকে এ সংক্রান্ত নোটিশ পৌঁছে দেবে। তারপর সন্ধ্যা ৭টা ৪৭ মিনিটে মহাপরিচালক এ নোটিশ গ্রহণ করেন, ততক্ষণে স্বাক্ষর শীটে তাঁর পূর্বে কেবল ডাঃ পীযূষ কান্তি বড়ুয়া ও ইকবাল হোসেন পাটওয়ারীর স্বাক্ষর দেখতে পাওয়া যায়। বাহক এ পত্রটি যাদেরকে রাতে পৌঁছাতে পারেন নি, তাদেরকেহ সকালে সভাটির অল্প কিছু সময় পূর্বে পৌঁছিয়েছেন। এ নোটিসে লেখা ছিলো, আগামী ২৪.০৫.২০২২ তারিখ মঙ্গলবার সকাল ১০:৩০টায় জেলা প্রশাসকের অফিস কক্ষে জেলা প্রশাসক, চাঁদপুর মহোদয়ের সভাপতিত্বে সাহিত্য একাডেমী, চাঁদপুর-এর নির্বাহী কমিটির এক সভা অনুষ্ঠিত হবে। উক্ত সভায় যথাসময়ে উপস্থিত থাকার জন্যে নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।-দেবযানী কর, সহকারী কমিশনার, গোপনীয় শাখা।
এ সভার উক্ত নোটিসে কোনো এজেন্ডা ছিলো না। ১৫ ঘন্টা পূর্বে জারিকৃত এজেন্ডাবিহীন নোটিস নিয়ে মহাপরিচালক আপত্তি জানালেও জেলা প্রশাসক বলেন, এটি লিখা হয়েছে ২৪ ঘন্টার পূর্বেই, আপনি হয়তো পরে পেয়েছেন। তারপর মহাপরিচালক ও অন্য সদস্যদের প্রতিবাদ সত্ত্বেও বহিরাগত দু ব্যক্তি ও একাডেমীর সবচে’ নিষ্ক্রিয় কনিষ্ঠ এক পরিচালকের সমর্থনে ও মিথ্যাচারের আলোকে জেলা প্রশাসক সাহিত্য একাডেমীকে আদর্শ বিচ্যুত, অচল ও আর্থিক সঙ্কটাপন্ন (যদিও ১১ লক্ষাধিক টাকা স্থায়ী তহবিল রয়েছে) সংগঠন হিসেবে আখ্যায়িত করতে গঠনতন্ত্রের বিভিন্ন ধারা উল্লেখ করে একনাগাড়ে বলতে থাকেন। তিনি ‘একাডেমীকে পুনরুজ্জীবিত করে এর আদর্শ ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের লক্ষ্যে’ বিদ্যমান নির্বাহী পরিষদকে অবলুপ্ত করার প্রস্তাব করেন এবং নির্বাহী পরিষদের সদস্যদের অনুপস্থিতিতে ১১ সদস্য বিশিষ্ট এডহক কমিটি গঠন করে তার কার্যবিবরণী লিখে ২৫ মে ২০২২ তারিখে মহাপরিচালকসহ নির্বাহী পরিষদের অন্য সকলকে পৌঁছানোর আগেই তাঁর অফিস থেকে চাঁদপুরের কিছু প্রিন্টিং ও অনলাইন পত্রিকাকে সরবরাহ করা হয়। যেটির ভিত্তিতে কার্যবিবরণীর স্ক্যান কপিসহ একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়।
এতে বিনা বেতন/সম্মানী, যাতায়াত ভাতা, ফোন বিল ছাড়া নয় বছরের অধিক সময় ধরে দায়িত্ব পালনকারী মহাপরিচালকসহ নির্বাহী পরিষদের সক্রিয় সদস্য এবং সদস্য না হয়েও সক্রিয় সহযোগিতা প্রদানকারী লেখক সমাজ বিস্ময়ের ঘোরে আবর্তিত হন। শুধু কি তা-ই, এডহক কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পাওয়া এক ব্যক্তি ও তার সমমনা ক’জন মামলার হুমকিসহ নানা অপবাদে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার ফ্রেন্ডদের সাথে তুমুল বিতর্কে লিপ্ত হন, যেটি এখনও অব্যাহত আছে।
কী কারণে সদ্য বিদায়ী জেলা প্রশাসক এতোটা খেপে গেলেন, সেটি মহাপরিচালকসহ নির্বাহী পরিষদের অধিকাংশজন এখনও বুঝে উঠতে পারেন নি।
এ ব্যাপারে নবাগত জেলা প্রশাসক কামরুল হাসান চাঁদপুরে যোগদানের পরদিন ২ জুন ২০২২ তারিখে মহাপরিচালক তাঁর নিকট একটি পত্র লিখেন, যাতে বিষয়টি পুনর্বিবেচনার আবেদন করেন। ‘অগঠনতান্ত্রিক উপায়ে গঠিত এডহক কমিটির নিকট দায়িত্ব হস্তান্তরে অনীহা এবং গঠনতন্ত্রের আলোকে বৈধ প্রক্রিয়ায় এডহক কমিটি গঠনের আবেদন’ শিরোনামে তিনি লিখেন, শ্রদ্ধেয় মহোদয়, আমি নিম্নস্বাক্ষরকারী সাহিত্য একাডেমী, চাঁদপুর-এর মহাপরিচালক পদে ২০১৩ সালের ২৪ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত বার্ষিক সাধারণ সভায় নির্বাচিত হয়ে ৯ বছর ৪ মাস ধরে দায়িত্ব পালন করে আসছি। ১৯৮৬ সালের ৬ জুলাই প্রতিষ্ঠিত সাহিত্য একাডেমীতে আমার পূর্বে অর্থাৎ সাড়ে ২৬ বছরে কোনো বেসরকারি লোক নির্বাচিত হয়ে মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেননি। চাঁদপুর সরকারি কলেজের ইংরেজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান (সহযোগী অধ্যাপক) খুরশেদুল ইসলাম ছিলেন এই একাডেমীর প্রথম মহাপরিচালক। তিনি এ পদে দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব পালনকালে চাঁদপুর সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ পদে বদলি হন এবং এ কলেজ থেকে চৌমুহনী সরকারি কলেজে বদলি হয়ে গেলে সৃষ্ট শূন্য পদে চাঁদপুর সদর উপজেলার ইউএনওগণ পদাধিকার বলে একের পর এক দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। যদিও গঠনতন্ত্রের ১৯ ধারায় সুস্পষ্টভাবে লিখিত আছে, মহাপরিচালক পদটি নির্বাচিত পদ। দুঃখের বিষয় হলো, ২-১ জন ইউএনও ছাড়া অন্য কোনো ইউএনও অবৈতনিক মহাপরিচালক পদটিতে দায়িত্ব পালনে পরোক্ষভাবে অনিচ্ছুক ছিলেন এবং সেহেতু নিষ্ক্রিয়তা প্রদর্শন করেন।
আমি মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর আর্থিক সঙ্কট ও নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আপনার পূর্বসূরি চারজন জেলা প্রশাসকের সাথে যোগাযোগ রক্ষাক্রমে তাঁদেরকে একাডেমীর সভাপতি হিসেবে সম্ভাব্য সহযোগিতার আহ্বান জানালে তাঁরা সেটি আন্তরিকতার সাথে করেন। যার ফলে একাডেমীকে আমার দায়িত্বগ্রহণের পূর্ববর্তী ২৬ বছরের তুলনায় অনেক বেশি সক্রিয় করার আন্তরিক প্রয়াস চালিয়েছি। সফলও হয়েছি। কিন্তু জেলা প্রশাসকগণের বহুবিধ ব্যস্ততায় তাঁরা প্রতি দু মাস অন্তর অন্তর নির্বাহী পরিষদের সভা এবং বছর শেষে বার্ষিক সাধারণ সভা তথা সাধারণ পরিষদের সভার জন্যে সময় দিতে পারেননি। তাঁরা বলেছেন, ছোট্ট ও অলাভজনক প্রতিষ্ঠানে এতো সভা করার চেয়ে সাহিত্য-সংক্রান্ত কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়াই উত্তম। তারপরও সদ্যবিদায়ী জেলা প্রশাসকের নিকট সময় চাইলে তিনি গত ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২১ তারিখে নির্বাহী পরিষদের সভা আহ্বানের অনুমোদন দেন। সেমতে সভাটি অনুষ্ঠিত হয়, যাতে দুটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। একটি সিদ্ধান্ত মতে জেলা প্রশাসক-প্রদত্ত এক লাখ টাকা অনুদানে সাহিত্য একাডেমীর সংস্কার কাজ চলমান। আর অপর সিদ্ধান্তে গঠনতন্ত্র সংশোধন করে হালনাগাদকরণের জন্যে গঠিত কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) জনাব ইমতিয়াজ হোসেন ও মহাপরিচালক কাজী শাহাদাতকে সদস্য সচিব করে ছয় সদস্যের সমন্বয়ে দায়িত্ব দেয়া হয়। কিন্তু তিনি (ইমতিয়াজ হোসেন) দাপ্তরিক কাজের ব্যস্ততায় কমিটির সকলকে নিয়ে বসার সুযোগ পাননি।
আমি মেয়াদোত্তীর্ণ নির্বাহী পরিষদের মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালনে অস্বস্তিবোধ করায় সদ্যবিদায়ী জেলা প্রশাসকের সাথে উপরোক্ত সভাটির পূর্বে (আগস্ট মাসে) দেখা করে পদত্যাগ করার ইচ্ছা ব্যক্ত করি। এছাড়া উক্ত সভায় নতুন নির্বাহী পরিষদ গঠনের জন্যে প্রস্তাব করি। তখন সভার সভাপতি হিসেবে সদ্যবিদায়ী জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ বলেন, “একাডেমীর গঠনতন্ত্র সংশোধনপূর্বক পরবর্তী নির্বাহী কমিটি গঠন করা হবে”। তিনি নতুন নির্বাহী কমিটি গঠনের পূর্ব পর্যন্ত বর্তমান কমিটিকে দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানান। এমন আহ্বানের মধ্যেই তিনি গত ২৪ মে ২০২২ সকাল সাড়ে ১০টায় মাত্র ১৫ ঘণ্টার নোটিসে একটি এজেন্ডাবিহীন সভা আহ্বান করেন। গঠনতন্ত্রে সভাপতিকে ৩০ অনুচ্ছেদের ৩-চ ধারা মোতাবেক ২৪ ঘণ্টার বিজ্ঞপ্তিতে ‘জরুরি সভা’ আহ্বানের ক্ষমতা প্রদান করা হলেও তিনি ১৫ ঘণ্টায় এজেন্ডাবিহীন অস্বাভাবিক সভা ডেকে এবং সে সভায় নির্বাহী পরিষদের সদস্য ব্যতীত দুজন (শাহাদাত হোসেন শান্ত ও জাহাঙ্গীর হোসেন)কে অতিরিক্ত উপস্থিত রেখে মহাপরিচালক হিসেবে সাহিত্য একাডেমীর সক্রিয়তা সম্পর্কে আমার যৌক্তিক বক্তব্য উপস্থাপনের সুযোগ চাইলেও সেটি না শুনে, তিনি সাহিত্য একাডেমীতে কোনোরূপ জরুরি অবস্থা সৃষ্টি না হওয়া সত্ত্বেও নির্বাহী পরিষদকে আকস্মিকভাবে অবলুপ্ত ঘোষণা করে অন্তর্বর্তীকালীন একটি এডহক কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। এক্ষেত্রে তিনি গঠনতন্ত্রের ২৪ (জ) ধারা অবলম্বন না করে গঠনতন্ত্রের সর্বশেষ ‘বিলুপ্তি’ ধারাটি অবলম্বন করে ১১ সদস্যবিশিষ্ট এডহক কমিটি গঠন করেন। যে ধারাতে উল্লেখ আছে, ‘একাডেমীর চরম আর্থিক দুরবস্থা, সদস্যগণের অসহযোগিতা, একাডেমীর আদর্শ ও উদ্দেশ্যে হইতে বিচ্যুত হওয়া অথবা অন্য কোনো কারণে চরম অচলাবস্থার সৃষ্টি হইলে এবং নির্বাহী ও সাধারণ পরিষদের পর পর আহুত কয়েকটি সভায় ‘কোরাম’ না হইলে সভাপতি বিশেষ ক্ষমতা বলে নির্বাহী ও সাধারণ পরিষদ বিলুপ্ত ঘোষণা করিবেন। এবং ১১ (এগার) সদস্যবিশিষ্ট একটি অন্তর্বর্তীকালীন কমিটি গঠন করিয়া একাডেমীকে পুনরুজ্জীবিত করিবার প্রচেষ্টা চালাইবেন। উল্লেখিত কমিটি গঠন করিবার তিন মাসের মধ্যে একাডেমীকে পুনরুজ্জীবিত করা সম্ভবপর না হইলে সভাপতি পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করিয়া একাডেমীকে বিলুপ্ত ঘোষণা করিবার প্রক্রিয়া নির্ধারণ করিবেন এবং কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী একাডেমীকে বিলুপ্ত ঘোষণা করিবেন।’
আপনি চাঁদপুরের নবনিযুক্ত জেলা প্রশাসক হিসেবে গত ১ জুন ২০২২ তারিখে যোগদান করেছেন। সেদিন থেকেই চাঁদপুরের অধিকাংশ স্থানীয় পত্রিকায় সাহিত্য একাডেমী চাঁদপুর সম্পর্কে যে ধারাবাহিক প্রতিবেদন ছাপা হচ্ছে এবং এ একাডেমীর সক্রিয়তা সংক্রান্ত যে প্রামাণ্য বিষয়সমূহ আমাদের কাছে রয়েছে, সে আলোকে নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, সদ্যবিদায়ী জেলা প্রশাসক সাহিত্য একাডেমী, চাঁদপুরের সভাপতি হিসেবে সভা আহ্বান থেকে শুরু করে নির্বাহী পরিষদ বিলুপ্ত করা ও এডহক কমিটি গঠনের কাজটি গঠনতন্ত্র লঙ্ঘন করেই করেছেন। যে এডহক কমিটি গঠন করেছেন তাতে চাঁদপুর প্রেসক্লাবসহ চাঁদপুরের সক্রিয় সাহিত্য সংগঠনগুলোর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করেননি। শুধু তা-ই নয়, সাহিত্য একাডেমীর সাধারণ সদস্যও নন এমন ব্যক্তিকে সদস্য সচিব এবং নির্বাহী পরিষদের সবচে' নিষ্ক্রিয় দুজনকে উক্ত এডহক কমিটির সদস্য করা হয়েছে। তিনি একাডেমীর ২১জন আজীবন সদস্যের কোনো প্রতিনিধিও এ কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করেন নি। তিনি সম্ভবত চাঁদপুর থেকে নেত্রকোনায় বদলির আদেশ পেয়ে তড়িঘড়ি করতে গিয়ে এমনটি করেছেন বলে আমাদের বদ্ধমূল ধারণা।
আমি মহাপরিচালক হিসেবে গত ২৯ মে ২০০২ তারিখে উক্ত সভার রেজুলেশন গ্রহণ করেছি এবং এডহক কমিটির আহ্বায়কের দায়িত্ব হস্তান্তর সংক্রান্ত পত্র পেয়েছি। এ পত্রের আলোকে আগামী ৪ জুন ২০২২ তারিখের মধ্যে আমার দায়িত্ব হস্তান্তর ও সকল হিসাব বুঝিয়ে দেয়ার কথা। আমি মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটির মহাপরিচালক হিসেবে আপনি চাইলে পদত্যাগপত্র দিয়ে আপনার যে কোনো প্রতিনিধির নিকট দায়িত্ব হস্তান্তর করতে রাজি আছি। কিন্তু গঠনতন্ত্রের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন করে গঠিত এডহক কমিটির নিকট দায়িত্ব হস্তান্তর করতে অনিচ্ছুক।
এমতাবস্থায় আপনাকে গঠনতন্ত্র মোতাবেক নির্বাহী পরিষদের সভা আহ্বান করত আমিসহ অন্য সদস্যদের সুস্পষ্ট ও যৌক্তিক বক্তব্য শুনে এবং ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২১ তারিখে অনুষ্ঠিত নির্বাহী পরিষদের কার্যবিবরণী পর্যালোচনা করে ন্যায়ানুগ ব্যবস্থাগ্রহণের জন্যে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাচ্ছি। বলা দরকার, ইউএনওগণ যখন একাডেমীর মহাপরিচালক ছিলেন, তখনও গঠনতন্ত্র মোতাবেক নির্বাহী ও সাধারণ পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত হয়নি এবং তখনও মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি বছরের পরে বছর কাজ করেছে।
মহাপরিচালক হিসেবে আমার এমন পত্রের পর ইতিবাচক বা নেতিবাচক যে সাড়াই পাই, আমি যথার্থ সিদ্ধান্তই নেবো, যেটি সাহিত্য একাডেমীর জন্যে কল্যাণ বয়ে আনবে। তার পূর্বে আট কিস্তিতে সাহিত্য একাডেমী, চাঁদপুর সম্পর্কে চাঁদপুরবাসীকে জানানোর চেষ্টা করলাম। আশা করি মানুষের কিছুটা হলেও ভুল ভাঙ্গবে এবং অপবাদের সত্যতাণ্ডঅসত্যতা নির্ণীত হবে। আমি সবশেষে হলফ করে বলতে পারি, নানা কারণে ২ বছরের পরিবর্তে সাহিত্য একাডেমীর নির্বাচিত নির্বাহী পরিষদ মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে ৯ বছরের অধিক সময় দায়িত্ব পালন করলেও ব্যাপক কর্মযজ্ঞে আত্মশ্লাঘাতেই ভুগবে। কারণ, এই পরিষদ পূর্ববর্তী অনির্বাচিত (মনোনীত) পরিষদের ২৬ বছরের চেয়ে অন্তত দ্বিগুণ কাজ করতে সক্ষম হয়েছে। যে দেশে রাজনৈতিক/ অরাজনৈতিক নানা সংগঠন/প্রতিষ্ঠানের তিন মাস/ছয়মাস মেয়াদী আহ্বায়ক/ এডহক কমিটি বছরের পর বছর পার করে, এমনকি যুগোত্তীর্ণও হয়, সেদেশে সম্পূর্ণ বিনা পারিশ্রমিকে সাহিত্য সংগঠনের জন্যে বিপুল কাজ করে সাহিত্য চর্চায় চাঁদপুরকে ন্যূনতম এগিয়ে নিতে পারার জন্যে নির্বাচিত পরিষদের প্রয়াস গ্লানির নয়, গৌরবের। মেয়াদোত্তীর্ণ সময়ে দায়িত্ব পালন করলেও সাহিত্য একাডেমীর নির্বাচিত নির্বাহী পরিষদের বিরুদ্ধে দায়িত্বপালনকালে কানো ধরনের অনাস্থা, তলবী সভার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি। সভাপতি হিসেবে জেলা প্রশাসক পাননি কোনো লিখিত অভিযোগ। এটার জন্যে শোকরিয়া মহান আল্লাহর দরবারে। (সমাপ্ত)