রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২০ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ২৯ মে ২০২২, ০০:০০

বিশ্ব অর্থনীতিতে মার্কিন ডলারের ভবিষ্যৎ
অনলাইন ডেস্ক

প্রায় আট দশকের মত সময় চলছে আন্তর্জাতিক রিজার্ভ কারেন্সি হিসেবে ডলার একচেটিয়া রাজত্ব করছে। জ্বালানি তেলের লেনদেনে ডলার ব্যবহারের মাধ্যমে সেই একচেটিয়াত্ব সর্বোচ্চ উচ্চতায় উঠে। বহুকাল ডলার আর নিশ্চয়তা সমার্থক ছিলো। এসবই বিভিন্ন দেশকে ডলারে রিজার্ভ রাখতে উৎসাহ বা আগ্রহ জুগিয়েছে। ডলারের এই অর্থনৈতিক আভিজাত্যের রাজনৈতিক ফল ভোগ করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির শাসকেরা বহুবার এ সুবিধাকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে ভিন্নমতালম্বী রাষ্ট্র ও সরকারের বিরুদ্ধে। এসব আক্রমণে বিভিন্ন সময় তারা সহযোগী করে নিয়েছিল ‘পাউন্ড এবং ইউরো’কে। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে ডলারকে ক্রমাগত মারণাস্ত্র হিসেবে ব্যবহারে অনেক দেশ এখন ত্যক্ত-বিরক্ত। যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে আফগানিস্তান ও কয়েকটি দেশ (বর্তমানে রাশিয়া) সবার ডলার-রিজার্ভ ইচ্ছেমতো আটকে দিচ্ছে, তাতে মধ্যপন্থী দেশগুলোর ভেতরও ভয় ঢুকেছে। পুতিনের সাবেক উপদেষ্টা সার্গেই গ্লাজিয়েভ-এর ভাষায়, ডলার এখন এক বিষাক্ত মুদ্রার নাম। এ রকম ভীতিকে কাজে লাগিয়েই ডলার আধিপত্যের বিরুদ্ধে পাল্টা প্রতিরোধ গড়তে চায় রাশিয়া।

কিন্তু বৈশি^ক মুদ্রা ও বাণিজ্য ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রিত হয় ডলার দ্বারা। ডলার বিশ্বমুদ্রা ব্যবস্থার প্রধান বিনিময় মাধ্যম। তাহলে ডলার কিভাবে বিশ্বমুদ্রায় পরিণত হলো এবং তার বিরুদ্ধে এখনকার প্রধান বৈশি^ক দ্বন্দ্ব ঠিক কোথায় তা বুঝতে হলে বিশ্বমুদ্রা হিসেবে ডলারের একচেটিয়া আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রক ভূমিকা বুঝা দরকার।

বহু বছর ধরে পৃথিবীতে স্বর্ণের মানের ওপর নির্ধারিত হতো অর্থনীতি ও লেনদেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র তাদের মিত্র দেশগুলোর কাছে যেসব সামরিক এবং অন্যান্য সরঞ্জাম বিক্রি করেছে সেগুলোর মূল্য পরিশোধ করা হয়েছে স্বর্ণের মাধ্যমে। এর ফলে বিশ্বের মোট রিজার্ভের ৭০ শতাংশ স্বর্ণ চলে যায় যুক্তরাষ্ট্রের হাতে। অন্যদিকে আমেরিকান ডলারের মূল্য নির্ধারিত ছিলো তখন স্বর্ণের ওপর ভিত্তি করে। সে সময় ধনী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রই ছিলো একমাত্র রাষ্ট্র যেখানে যুদ্ধের কোনো আঁচড় লাগেনি। এছাড়া ইউরোপ এবং রাশিয়া তখন যুদ্ধবিধ্বস্ত। যেহেতু তখন পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি স্বর্ণ আমেরিকার কাছে ছিলো এবং স্বর্ণের ওপর ভিত্তি করে আমেরিকান ডলার স্থিতিশীল ছিল, সেহেতু বিশ্বের চুয়াল্লিশটি দেশ ব্রেটন উডস অ্যাগ্রিমেন্টের মাধ্যমে ডলারকে তাদের বৈদিশিক মুদ্রার রিজার্ভ কারেন্সি হিসেবে রাখতে একমত হয়েছে। সেই থেকে ডলারের আধিপত্য শুরু।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ডলারকে আরো শক্তিশালীভাবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রচেষ্টা চালান। তিনি বিশ্বজুড়ে আমেরিকান ডলারের কর্তৃত্ব ধরে রাখতে এবং চাহিদা বাড়ানোর জন্য ১৯৭১ সালে ঘোষণা করেন, স্বর্ণের ওপর ভিত্তি করে ডলারের মূল্য আর নির্ধারিত হবে না। তার জন্য ১৯৭৪ সালে সৌদি আরবের সাথে একটি চুক্তি করে আমেরিকা। এই চুক্তির মাধ্যমে ডলারকে পেট্র্রোডলারে রূপ দেওয়া হয়। পেট্রোডলার মূলত ডলারের বিনিময়ে পেট্র্রোল ক্রয়ের চুক্তি (বাদশা ফয়সাল এবং প্রেসিডেন্ট নিক্সনের মধ্যে)। এই চুক্তি অনুযায়ী সৌদি আরবকে বাধ্য করা হয়েছে ডলারকে সার্বভৌম বিশ্বমুদ্রা হিসেবে মেনে নিতে। অর্থাৎ পেট্রোল কেবলমাত্র ডলার দ্বারাই কেনাবেচা করতে হবে। কোনো দেশীয় মুদ্রা দিয়ে নয়। এর বিনিময়ে আমেরিকা সৌদি বাদশাকে গ্যারান্টি দেয়, যতদিন তারা পেট্রোডলার চুক্তি মেনে চলবে ততদিন সৌদি রাজপরিবার ক্ষমতায় থাকবে। সৌদি বাদশাহদের ক্ষমতায় থাকতে আরো একটি শর্ত, সেটা হলো, ওপেকভুক্ত সব দেশকে রাজি করানো, যাতে তারা ডলার ছাড়া অন্য কোনো মুদ্রা বা স্বর্ণের বিনিময়ে তেল বিক্রি না করে।

উল্লেখ্য, সৌদি আরব ছিল সর্বোচ্চ তেল উৎপাদনকারী দেশ। তাই সৌদিআরবের চুক্তির কারণে অন্যান্য তেল উৎপাদনকারী দেশকেও এই চুক্তি মেনে নিতে হয়েছে। আর তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর সংগঠন সৌদি আরবের মতোই সিদ্ধান্ত নেয়। ফলে, প্রকারান্তরে এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সব ব্যবসা-বাণিজ্য যেন ডলার ছাড়া অন্য কোনো মুদ্রায় না চলে তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে চেয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। হয়েছেও তাণ্ডই।

আমেরিকা সবসময়ই নিশ্চিত করতে চেয়েছে যেন কোনো দেশ ডলারকেন্দ্রিক এই ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে না যায়। ডলার স্বর্ণ থেকে বিযুক্ত হয়ে যুক্ত হলো পেট্রোলিয়ামের সাথে। এর ফলে পেট্রোডলারের জন্ম হয় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়ে ডলার অনেক শক্তিশালী অবস্থানে চলে যায়। ডলার হয়ে উঠলো মার্কিন-টাকশালে ছাপা কাগজ আর পেট্রোলিয়াম মিলে এক কারেন্সি যা আন্তর্জাতিক মুদ্রা। বহুকাল ডলার ছিল মুদ্রার স্থিতিশীলতার সমার্থক। ডলারের অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক ফল ভোগ করেছে কেবল যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির শাসকরা বহুবার এ সুবিধাকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে ভিন্নমতাবলম্বী রাষ্ট্র ও সরকারের বিরুদ্ধে। ইরাক ও লিবিয়া এ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলো, তাদের কী ভয়ানক দশা ঘটেছে সবারই জানা। আমেরিকা ও ইউরোপের নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়া তাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের প্রায় অর্ধেক ব্যবহার করতে পারছে না, এসব বৈদেশিক মুদ্রা ডলার ও ইউরোতে রাখা হয়েছিল। এছাড়াও রাশিয়ার প্রায় ৬০০ বিলিয়ন ডলার আটকে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যা ছিল বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম রিজার্ভ। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং লেনদেনের যোগাযোগব্যবস্থা ‘সুইফট’ থেকে তাদের অনেক ব্যাংককে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। রাশিয়া এ মুহূর্তে ডলারভিত্তিক আন্তর্জাতিক লেনদেন ব্যবস্থা থেকে অনেক বাইরে। সর্বশেষ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান, যিনি পাকিস্তান ও চীনের মধ্যে বাণিজ্যে নিজস্ব মুদ্রার ব্যবহারের চুক্তি (২০১৯) করেন। এই চুক্তিতে সেমিকন্ডাক্টর, বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার, সম্প্রচার যন্ত্রপাতি কেনার কথা ছিলো। আমেরিকা অসন্তুষ্ট হলেও চুপ ছিল, কারণ এই চুক্তিতে তেল অন্তর্ভুক্ত ছিল না। তেলের জন্য পাকিস্তানী রুপি-রাশিয়ান রুবল চুক্তি করার প্রক্রিয়া ঘটেছে ২০২২ সালে। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিছুতেই এই চুক্তি হতে দিতে পারে না। কারণ অন্যান্য দেশ পাকিস্তানকে অনুসরণ করলে মার্কিন ডলার দুর্বল হবে এবং পেট্রোডলারের জারিজুরি থুবড়ে পড়বে। মার্কিন অর্থনীতি দুর্বল হবে। সুপার পাওয়ার হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষয় হচ্ছে। যদি এই চুক্তি হয়ে যেত তাহলে পাকিস্তান মার্কিন দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে বেরিয়ে আসত। সেই জন্যই তড়িঘড়ি করে অপসারণ করতে হয়েছে পাকপ্রধানমন্ত্রীকে। এভাবে ডলারকেন্দ্রিক বৈশি^ক বাণিজ্য টিকিয়ে রাখতে যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন দেশকে আক্রমণ করে থাকে। এই আক্রমণে তারা কখনো ‘ইউরোপ’, কখনো ‘ন্যাটো’কে সহযোগী হিসেবে নিয়েছে এবং বিনিময়ে ‘পাউন্ড’ ও ‘ইউরো’কে কিছুটা সুবিধা দিয়েছে, তবে পেট্রোল বিনিময়ের মাধ্যমে হওয়ার সুযোগ দেয়নি। আর সেই সুযোগটা নিতে চাচ্ছে রাশিয়া।

এসব ঘটনার পর পৃথিবীর অনেক দেশ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হিসেবে ডলারের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে আনতে পারে বলে অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করছেন। একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে, কোনো রাজার রাজত্ব চিরস্থায়ী হয় না। একই কথা আমেরিকার মুদ্রা ডলারের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে না তা বলা যায় না। গত পাঁচশত বছর ধরে পৃথিবীতে যেসব দেশের মুদ্রা রাজত্ব করছে তার মধ্যে রয়েছে পর্তুগাল, এরপর স্পেন, নেদারল্যান্ডস, তারপর ফ্রান্স এবং সর্বশেষ ছিল বৃটেনের মুদ্রা। এরপর থেকেই আমেরিকান ডলারের প্রভাব। বর্তমানে ডলারের একচেটিয়া অবস্থার পরিবর্তন হতে শুরু করছে। কারণ, রাজনৈতিক স্বার্থে ডলারের ক্রমাগত মারণাস্ত্র হিসেবে ব্যবহারে অনেক দেশ এখন ভীত, ত্যক্ত-বিরক্ত। বিশেষজ্ঞদের মতে, এরকম ভীতিকে কাজে লাগিয়েই ডলার আধিপত্যের বিরুদ্ধে পাল্টা প্রতিরোধ গড়তে চায় বিভিন্ন দেশ। রাশিয়া, চীন, পাকিস্তান এমনকি ভারতও।

ডলার আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রস্তুতি হিসেবে পুতিন গত ৮ বছরে স্বর্ণের মজুত তিন গুণ বাড়িয়ে নিয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধের আগপর্যন্ত রাশিয়ার রিজার্ভের এক-পঞ্চমাংশ ছিল স্বর্ণে (প্রায় ২ হাজার ৩০৩ টন)। যার ফলে ডলার সংগ্রহে এসব এখন ব্যবহার করতে পারবে। নতুন করে স্বর্ণের সঙ্গে রুবলের যে মূল্যায়ন বেঁধে দিয়েছে তারা, তাতেও স্বর্ণের মজুত আরও বাড়বে। বাড়বে রুবলের শক্তিও।

ইদানীং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ডলারবিরোধী বিক্ষিপ্ত প্রচেষ্টা মহাযুদ্ধে রূপ নিতে যাচ্ছে। ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৫৩ সালে রুবল আর রুপি দিয়ে পরস্পরের সাথে বাণিজ্যের চুক্তি করেছে। সেটা হয়েছে ইন্দো-সোভিয়েত বাণিজ্য চুক্তির অধীনে। সাম্প্রতিক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধের পর ভারত তার পুরানো চুক্তির অধীনে পরস্পরের সঙ্গে বাণিজ্য নিজের মুদ্রা ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেয়। এর ফলে ‘ডলার’ বা ‘সুইফট’ সিস্টেমের প্রয়োজন পড়ছে না। অন্যদিকে সৌদিআরব ও চীন গত ৬ বছর যাবৎ আলোচনা করছে চীনের কাছে সৌদিআরব যে তেল রপ্তানি করে সেটির মূল্য ডলারে পরিশোধ না করে চীনের মুদ্রা ইউয়ানে পরিশোধ করা যায় কিনা। ইউক্রেন যুদ্ধের সময় এ আলোচনা আবার গুরুত্ব সহকারে নতুন করে সামনে এসেছে।

এও উল্লেখ্য, সৌদিআরব যত তেল রপ্তানি করে তার পঁচিশ শতাংশ যায় চীনে। আবার রাশিয়াও এখন নতুন করে ভাবছে, তাদের তেল কেন রুবলে বিক্রি করবে না? এবং তারা পদক্ষেপও নিয়েছে। দেশটি থেকে বলা হয়েছে, যারা তাদের কাছ থেকে তেল-গ্যাস কিনবে তাদের মূল্য পরিশোধ করতে হবে রাশিয়ার মুদ্রা রুবলে। রাশিয়া এ-ও বলছে, কেবল জ্বালানি নয়, ধীরে ধীরে অন্যান্য পণ্যও তারা একই বিনিময়-ব্যবস্থায় যাবে। চীন রাশিয়ায় দীর্ঘদিন যাবৎ ডলারের বিকল্প হিসেবে নতুন একটি বৈশি^ক মুদ্রা চালুর কথাও বলছে। চীন এবং রাশিয়া চায় ডলারের বিকল্প হিসেবে এমন একটি মুদ্রা হোক যেখানে কোনো দেশের প্রভাব থাকবে না।

অর্থাৎ ডলারের আধিপত্য কমাতে হলে রাশিয়া ও চীনের সামনে চ্যালেঞ্জ হলো, পণ্য বিনিময়ে সব দেশের কাছে গ্রহণযোগ্য একক কোনো মুদ্রা বাছাই করা। এমনকি একাধিক মুদ্রার নতুন বিনিময় ব্যবস্থার কথাও ভাবছে এসব বিদ্রোহী-শক্তি, যাতে আসন্ন আন্তর্জাতিক বিনিময় ব্যবস্থাটি একক কোনো দেশকে রাজনৈতিক আধিপত্যের সুযোগ করে না দেয়। পাশাপাশি ঐসব মুদ্রায় লেনদেনের জন্য নতুন আরেক বার্তা বিনিময় ব্যবস্থাও লাগবে, যা ‘সুইফট’-এর বিকল্প হবে। রাশিয়া এবং চীন নিজেদের মধ্যে ইতোমধ্যে ‘সুইফট’-এর বিকল্প বার্তাব্যবস্থা তৈরি করে নিয়েছে। সেই ব্যবস্থায় আশপাশের অনেক দেশকে শামিল করতে জোর তৎপর। ভারত ইতোমধ্যে ‘এসপিএফএস’ (যা রাশিয়ার ফিন্যান্সিয়াল মেসেজিং সিস্টেম)-এ যুক্ত হওয়ার পরিকল্পনা বাস্তবে রূপ দিচ্ছে। ২০১৭ সাল থেকে লেনদেন চলতে থাকা এই ‘এসপিএফএস’ দ্রুত শামিল হতে চলেছে চীনের ‘সিআইপিএস’ (ক্রসবর্ডার ইন্টারব্যাংক পেমেন্ট সিস্টেম)-এর সঙ্গে। ডলারভিত্তিক আধিপত্যের জগৎ এড়াতে রাশিয়ার সাথে চীন ও ভারতের লেনদেন ব্যবস্থার সমন্বয়ের চেষ্টা এখন মোটেই আর পরিকল্পনা কিংবা আলোচনার টেবিলে আটকে নেই; বরং সেটা অনেক বাস্তব রূপ নিচ্ছে।

ইউক্রেন যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি যুক্ত না হলেও প্রথম থেকে এ যুদ্ধে তাদের প্রথম লক্ষ্য রুবলকে ঘায়েল করা। এখন মনে হচ্ছে সেটা আপাতত ঘটছে না; বরং রুবলের চাহিদা রয়েছে আন্তর্জাতিক বাজারে। তবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং রাশিয়াবিরোধী অনেক দেশে পণ্য ও সেবার জায়গায় আমেরিকা তার পণ্য ও সেবার প্রবেশ বাড়াতে পেরেছে এ মুহূর্তে। কিন্তু এর মাঝেও আমেরিকার জন্য হতাশার একটা দিক হলো, চীন ও রাশিয়া নিজেদের মাঝে ‘সুইফট’-এর বাইরে অর্থনৈতিক বার্তা আদান-প্রদান করতে থাকায় তাদের বাণিজ্য-তথ্যে যুক্তরাষ্ট্র আর আগের মতো নজরদারি করতে পারছে না। ডলার আধিপত্য না থাকার আরেক পরোক্ষ মানে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর কর্তৃত্বও অনেকটা খর্ব হওয়া। উল্লেখ্য, ‘আইএমএফ’কে ব্যবহার করে দশকের পর দশক যুক্তরাষ্ট্র তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে যেভাবে তার পছন্দের অর্থনৈতিক মডেল গ্রহণে বাধ্য করেছে, সেটা নিকট ভবিষ্যতে আর সহজ না-ও হতে পারে।

ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্ব কূটনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসী অবস্থানের বড় এক পটভূমি। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনকে মাঝখানে রেখে বিশ্বকে দু’ভাগ করতে চাইছে ওয়াশিংটন। এই ভাগাভাগির কেন্দ্রে তাদের বড় লক্ষ্য অবশ্যই ডলারের একচেটিয়াত্ব ধরে রাখা। যেসব দেশ রাশিয়া, চীন, ইরান বা ভেনিজুয়েলার সাথে নিজ মুদ্রায় লেনদেন করতে চাইছে বা চাইবে, তারা নিশ্চিতভাবেই ব্যাপক কূটনৈতিক চাপের শিকার হবে। (অতীতে এসব চাপের শিকারের দৃষ্টান্ত অনেক রয়েছে)। সেই চাপ কখনো আসবে মানবাধিকার পরিস্থিতির আদলে, কখনো রাজনৈতিক গণতন্ত্রের স্বরূপের আড়ালে। আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে শুরু হওয়া টানাপোড়েন ইউক্রেন যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করবে। এ যুদ্ধের ফলাফলে এখন আর কেবল ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব নয়, বৈশ্বিক পুরো অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার নেতৃত্ব কার হাতে থাকবে, তারও নিষ্পত্তি নির্ভর করছে। অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, এ যুদ্ধের ফয়সালা হবে সমরবিদদের দ্বারা নয়, অর্থনীতিবিদদের দ্বারা।

ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ হলেও এ যুদ্ধের আড়ালে শুরু হওয়া বিকল্প মুদ্রাব্যবস্থা গড়ার মূল যুদ্ধ থামবে না। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর গীতা গোপিনাথ সতর্ক করে বলেছেন, রাশিয়ার ওপর অবরোধ দীর্ঘমেয়াদী হলে সেটি আমেরিকান ডলারের জন্যই খারাপ হবে। অন্যদিকে আমেরিকার মাল্টিন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক ও আর্থিক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান গোল্ডম্যান সাচি সম্প্রতি তাদের এক প্রতিবেদনে বলেছেন, ১৯২০ সালের দিকে বৃটিশ পাউন্ড তাদের আধিপত্য হারানোর আগে যে ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিল এখন আমেরিকান ডলারের ক্ষেত্রেও সেটি হচ্ছে। (নয়াদিগন্ত, ২৯ এপ্রিল ’২২)।

উপরোক্ত আলোচনান্তে নতুন এক বিকল্প অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রাথমিক লক্ষণ স্পষ্ট হয়েছে, তবে বলতে গেলে বলতে হয়, ডলারকে এড়িয়ে নতুন ধারার লেনদেনগুলোও পুঁজিতান্ত্রিক বিনিময় এবং তা পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থারই অংশ। উদীয়মান এই কাঠামো কেবল ডলার উচ্ছেদ করে বিকল্প কোনো মুদ্রার আধিপত্য সৃষ্টি না করে এমন মুদ্রাব্যবস্থার প্রচলন করতে হবে, যেন প্রতিটি স্বাধীন দেশ স্বাধীনভাবে তার অর্থনীতি ও মুদ্রানীতি পরিচালিত করতে পারে, যেন শোষিত না হয়। তা হলেই বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্রের প্রকৃত সার্বভৌমত্বের অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠা সহায়ক হবে।

লেখক পরিচিতি : অধ্যাপক মোঃ হাছান আলী সিকদার: সভাপতি, চাঁদপুর জেলা জাসদ; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রনেতা, চাঁদপুর জেলা শিক্ষক নেতা; সমাজ ও রাজনীতিবিশ্লেষক।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়