প্রকাশ : ২৬ মে ২০২২, ০০:০০
নদী হলো বাংলাদেশের প্রাণ। দক্ষিণ এশিয়ার অন্তর্গত বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ। শাখা-প্রশাখাসহ প্রায় ৪০৫টি নদ-নদী বিপুল জলরাশি নিয়ে ২৪,১৪০ কিলোমিটার জায়গা দখল করে দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। বাংলাদেশের অধিকাংশ এলাকাই শত শত নদীর মাধ্যমে বয়ে আসা পলি মাটি জমে তৈরি হয়েছে। সাম্প্রতিক কালের যে প্লাবন সমভূমিগুলো দেখতে পাই তার সবটাই বাংলাদেশের নদীগুলো দ্বারা সৃষ্ট।
বাংলাদেশের নদীগুলো এখন মানুষের জীবনের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের মানুষ নদীগুলোর সাথে তাদের জীবনকে জড়িয়ে নিয়েছে। আমরা যদি পৃথিবীর প্রাচীন সভ্যতাগুলো দেখি তার প্রায় অধিকাংশই গড়ে উঠেছে বড় বড় নদীকে কেন্দ্র করে।
এই নদীগুলোই দেশের মানুষের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি। বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ হয়ে গড়ে ওঠার পেছনে রয়েছে নদীগুলোর অবদান। দেশের প্রায় ৭০ ভাগ যাত্রী এবং পণ্য পরিবাহিত হয় এই নদীগুলোর মাধ্যমে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নদীর অবদান অপরিসীম। এর কিছু অংশ তুলে ধরা হলো :-
১) নদ-নদীকে কেন্দ্র করে অনেক শিল্প-কারখানা গড়ে ওঠে; ২) রপ্তানি বাণিজ্য সহজ হয়; ৩) পরিবহন খরচ কম হয় ; ৪) মৎস্য সম্পদ আহরণ করা যায়; ৫) বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়; ৬) প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়; ৭) মৎস্য আহরণ; ৮) কৃষি সেচ; ৯) মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি; ১০) বালি উত্তোলন; ১১) পাথর উত্তোলন; ১২) পানির ব্যবহার।
যে নদীগুলো দেশের অর্থনীতির চালিকা শক্তি সেই নদীগুলো রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে দেশের ঐতিহ্য হারাচ্ছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো : (১) নাব্যতা সংকট, (২) নদী দূষণ ও (৩) নদী ভাঙ্গন, যার প্রভাব পড়ছে গিয়ে জনজীবনের উপর এবং অর্থনীতির উপর।
একজন ভূগোল এবং পরিবেশের ছাত্র হিসেবে এবং ছাত্রদের ভূগোল পড়াই বলে এবার আমি ক্ষুদ্র পরিসরে আলোকপাত করবো চাঁদপুরে বিশেষ করে পদ্মা, মেঘনা এবং ডাকাতিয়া নদীগুলোর নাব্যতা সংকট, ডুবোচর ও নদী দূষণ নিয়ে।
নাব্যতা সংকট : বিশেষ করে পদ্মা এবং মেঘনা প্রচণ্ড নাব্যতা সংকটে রয়েছে। যেহেতু চাঁদপুর লোয়ার স্টেজে রয়েছে, সেহেতু পদ্মা, মেঘনা দ্বারা বাহিত পলির অধিকাংশ এখানে সিল্টেশন হয়। আপার স্টেজ থেকে যে পরিমাণ লোড আসে লোয়ার স্টেজে এসে সে পরিমাণ লোড নদী ধারণ করতে পারে না বলে চাঁদপুর থেকে ভোলা, বরিশাল অঞ্চলে প্রচুর সিল্টেশন হয়ে থাকে। যার ফলে নাব্যতা সংকট দেখা দেয়। বড় বড় পণ্যবাহী কার্গো এবং যাত্রীবাহী নৌযানগুলো চলাচলে বিঘ্ন ঘটে।
কার্যকর ব্যবস্থা : নদীগুলোর নাব্যতা স্বাভাবিক রাখার জন্যে পরিকল্পিত ড্রেজিং চলমান রাখতে হবে। হাইড্রোলজিকেল জরিপ করে এই খননকার্য পরিচালনা করা উচিত।
ডুবো চর : আগেই বলেছি যে, নদীর ধর্ম অনুসারে লোয়ার স্টেজে এসে নদী অনেক ডুবোচরের সৃষ্টি করে। যেগুলো পানির স্বাভাবিক প্রবাহকে ব্যভহত করে। যার ফলে কাট ব্যাংকে নদী ভাঙ্গনের সৃষ্টি হয়। জাহাজ চলাচলে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে।
কার্যকর ব্যবস্থা : নদী পথের সকল ডুবোচর কেটে বালি অপসারণ জরুরি। অপসারিত বালি কাট ব্যাংকে জমা করে জমির পরিমাণ বৃদ্ধি করা যেতে পারে।
নদী দূষণ : চাঁদপুর মেঘনা, ডাকাতিয়া এবং পদ্মায় নদী দূষণ মারাত্মক আকার ধারণ করছে। ডাকাতিয়া নদী যে পরিমাণ দূষণে আক্রান্ত, যা পানি ব্যবহারের অযোগ্য। শহরের সকল সুয়ারেজ লাইন ডাকাতিয়া নদীতে দেয়ার কারণে ক্রমাগতই ডাকাতিয়া দূষিত হয়ে মেঘনাকে দূষিত করছে। আপার সেকশন থেকেও বর্জ্য দ্বারা মেঘনা দূষিত হচ্ছে। এতে করে মৎস্যের বিচরণ ক্ষেত্র, প্রজননে মারাত্মক ব্যাঘাত সৃষ্টি হচ্ছে। পানি দূষিত হয়ে কৃষিকাজের ব্যাঘাত সৃষ্টি হচ্ছে।
কার্যকর ব্যবস্থা : ডাকাতিয়া এবং মেঘনা দূষণমুক্ত করা অতীব জরুরি। শহরের সুয়ারেজ লাইনগুলে ওয়াটার ট্রিটমেন্টের আওতায় আনা যেতে পারে।
জরুরি ভিত্তিতে যেটি প্রয়োজন, চাঁদপুরকে ভাঙ্গনের কবল থেকে রক্ষা করতে হলে একটি হাইড্রোলজিক্যাল সার্ভে করা দরকার। তার ভিত্তিতে পরিকল্পনা মত, নাব্যতা স্বাভাবিক রাখতে ম্যাপে উল্লেখিত মিনি কক্সবাজার বলে পরিচিত ডুবো চরটি এবং রাজরাজেশ্বরের কিছু অংশ এবং মেঘনার ডুবোচরগুলো কেটে বালি অপসারণ জরুরি। অপসারিত বালি ভাঙ্গন কবলিত মেঘনার বাম তীরে (বিষ্ণুপুর/দাসাদী) জমা করে ভূমির পরিমাণ বৃদ্ধি করা যেতে পারে। এই কাজগুলো সবই করতে হবে একটি মাস্টার প্ল্যানের মাধ্যমে।
লেখক : অধ্যক্ষ, পুরানবাজার ডিগ্রি কলেজ, চাঁদপুর।