সোমবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৮ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার
  •   দৈনিক ইনকিলাবের প্রশাসনিক কর্মকর্তা শহীদুল্লাহ্ মিজির দাফন সম্পন্ন
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা

প্রকাশ : ২০ মে ২০২২, ০০:০০

বিম্বিত বীক্ষণ
অনলাইন ডেস্ক

পর্ব-২৫

দীর্ঘদিন ধারাবাহিক লেখাটি বন্ধ থাকার পর পাঠক এবং শুভাকাঙ্ক্ষীদের অনুরোধে আবারো শুরু করছি। বিম্বিত বীক্ষণের ২৪তম পর্বটি লিখেছিলাম ২৯/৮/২০২১ তারিখে। দীর্ঘ নয় মাস পর পাঠক এবং আমার অত্যন্ত প্রিয় শ্রদ্ধাভাজন চাঁদপুর কণ্ঠের সম্পাদক কাজী শাহাদাতের অনুরোধে আবার শুরু করলাম। সত্যি কথা বলতে কি, কাজের চাপে আর লিখতে বসা হয়ে উঠেনি। আশা করছি পাঠকরা বিষয়টি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। আপনাদের অনুপ্রেরণাই আমাকে আবার লেখা শুরু করতে অনুপ্রাণিত করেছে।

আজকের লেখায় শিক্ষার্থী, অভিভাবক এবং শিক্ষকের আন্তঃসম্পর্ক নিয়ে আলোকপাত করবো। একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শুধুই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়, এটি একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবেও কাজ করে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সামাজিক সংগঠন হিসেবে শিক্ষার্থী, শিক্ষক-কর্মচারী ও অভিভাবকের সাথে একটি মিলনসেতু হিসেবে কাজ করে। বিভিন্ন কাজের মধ্যে কিছু কাজ শিক্ষার্থী-অভিভাবক ছাড়া হয় না। আবার সকলে একটা টিম হিসেবে কাজ করলে প্রতিষ্ঠানের পারফর্মেন্স অনেক ভালো হয়। অভিভাবক সম্পর্ক ঠিক না থাকলে অনেক সমস্যা, যেমন শিক্ষার্থী উপস্থিতি কম হয়, আবার শৃঙ্খলাজনিত অনেক সমস্যা দেখা দেয়।

শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং অভিভাবকদের নিবিড় সম্পর্ক থাকলে অভিভাবকরা যেমন উপকৃত হন, তেমনি শিক্ষার্থীকে সঠিক পথে ধাবিত করতে সহায়তা করে। অভিভাবক এবং প্রতিষ্ঠানের সাথে ইতিবাচক যোগাযোগ থাকলে এতে অভিভাবকরাই উপকৃত হন। অভিভাবকদের যতো বেশি সম্পৃক্ত করা যাবে সেটা প্রতিষ্ঠানের জন্যে যেমন ইতিবাচক, তেমনি শিক্ষার্থীর জন্যে মঙ্গল বয়ে আনে। কিন্তু অধিকাংশ অভিভাবক থাকেন উদাসীন। আবার কোনো কোনো অভিভাবক এতোটাই নেতিবাচক সচেতন থাকেন যে, তাতে করে শিক্ষার্থীর নাভিশ্বাস উঠে। কিন্তু শিক্ষা যে শুধু সনদের জন্যে হবে না, শিক্ষা হবে জীবনমুখী, শিক্ষা হবে আনন্দের, থাকবে না কোনো পরীক্ষাভীতি-সেটাই অনেক অভিভাবক বুঝতে চান না। শিক্ষাকে যদি জীবনমুখী করা যায়, তবেই তৈরি হবে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের উপযোগী দক্ষ মানবসম্পদ। এসডিজি-৪ বাস্তবায়নে এর বিকল্প নেই। কিন্তু আমাদের দেশের অধিকাংশ শিক্ষার্থীর অভিভাবকের মধ্যে একটি অসুস্থ প্রতিযোগিতা দেখা যায়। অসুস্থ প্রতিযোগিতা এমন পর্যায়ে যায় যে, এতে অনেক অভিভাবক অনৈতিকতার আশ্রয় নিয়ে থাকে। যার ফলে অনেক শিক্ষকও এতে জড়িয়ে যান। বিত্তশালী অভিভাবকদের মনোভাবটা এমন থাকে যে, অর্থ দিয়ে শিক্ষা কিনতে চান সন্তানের মেধা যা-ই থাকুন না কেনো। এতে করে শিক্ষায় বৈষম্য দেখা দেয়। যাদের অর্থ আছে তারা যেনতেনভাবে হয়তো একটা তথাকথিত ভালো রেজাল্ট পায়, কিন্তু প্রান্তিক অভিভাবকদের সন্তানরা অনেকটা পিছিয়ে পড়ে।

অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছে যে, অভিভাবক যতো বেশি শিক্ষক দিয়ে তার সন্তানকে পড়াতে পারবেন তিনি ততোটা সমাজে মর্যাদা পাবেন। কিছু কিছু অভিভাবকের মনোভাব এমন থাকে যে, টাকা আছে প্রয়োজনে টাকা দিয়ে শিক্ষক কিনে নিবো। একজন শিক্ষার্থী যখন দেখবে তার বাবা বা মা অর্থের বিনিময়ে শিক্ষককে বাসায় এনে পড়াচ্ছেন তখনই তার নৈতিকতায় স্খলন দেখা দেবে। আমি অনেক অভিভাবককে দেখেছি, গৃহশিক্ষককে সন্তানের সামনে তার মাসিক বেতনটা দিয়ে থাকেন। এতে কী হয়? শিক্ষার্থী মনে করে তার অভিভাবক অর্থের বিনিময়ে পড়াচ্ছেন। এমন অবস্থা হলে শিক্ষকের প্রতি শিক্ষার্থীর যে শ্রদ্ধাবোধ সেটায় ঘাটতি দেখে দেবে। আবার আমি এমন অভিভাবকও দেখেছি যারা সন্তানের সামনে কোনোদিন শিক্ষককে বেতন দিতেন না। অবশ্য বিষয়গুলো আমাদের সমাজেরই একটি চিত্র।

অভিভাবক, শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীর মধ্যে যতোদিন মেলবন্ধন না হবে ততোদিন শিক্ষায় গুণগত পরিবর্তন আসবে না বলে মনে করি। দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করা এবং সামাজিক কাজের সাথে জড়িত থাকার কারণে আমার কাছে যেটা মনে হয়েছে, অভিভাবকদের সন্তানদের প্রতি আরো যত্নশীল হওয়া বাঞ্ছনীয়। তাহলে সেগুলো কী হতে পারে?

অভিভাবকের করণীয়

সন্তানদের নিয়মিত প্রতিষ্ঠানে উপস্থিতি নিশ্চিত করা : এটা ভুলে গেলে চলবে না, সন্তানকে প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত উপস্থিত থাকা ও শ্রেণির পাঠগ্রহণে উৎসাহ দেয়া প্রয়োজন। সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর দিতে নিজেকে প্রস্তুত করার উপযুক্ত জায়গা হলো শ্রেণিকক্ষ।

সন্তানকে গাইড বই থেকে বিরত রাখা : সন্তানকে গাইড ও নোট বই সংগ্রহ করা এবং তা মুখস্থ করা থেকে বিরত রাখতে পারে অভিভাবক।

বাসায় পড়ার পরিবেশ তৈরি করা : প্রত্যেকটি শিশু জীবন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে। শিশু যদি সমালোচনা মধ্যে বড় হয়, তবে তার মধ্যে হতাশা কাজ করে। সন্তানকে বাসায় শিক্ষার একটা সুষ্ঠু পরিবেশ দিতে হবে।

সন্তানের খোঁজখবর রাখা : প্রত্যেক অভিভাবকের উচিত তার সন্তানকে পর্যাপ্ত সময় দেয়া। সন্তান এমন একটা বয়সে থাকে যখন প্রতিটি কিশোর নিজেকে হিরো মনে করে। এই বয়সটাতে সন্তানকে অভিভাবকদের সার্বক্ষণিক তদারকিতে রাখা দরকার।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ডের সাথে সম্পৃক্ত হওয়া : অভিভাবকরা প্রতিষ্ঠানের অবিচ্ছেদ্য অংশ। পড়াশোনার পরিবেশ উন্নয়নকল্পে তারা শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে পরামর্শ প্রদান করে থাকেন। প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমের সঙ্গে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের বিভিন্ন সমস্যা জড়িত। প্রয়োজনে পাঠের বিষয়বস্তুকে বাস্তবজীবনের কোনো ঘটনার সঙ্গে মিল বা সম্পর্ক রেখে তা গল্পাকারে সন্তানদের বলা যেতে পারে। তখনই শিক্ষা দীর্ঘস্থায়ী হবে এবং বাস্তব জীবনে নিজেও তা কাজে লাগাতে পারবে।

সাম্প্রতিককালে যে বিষয়টি পুরো সমাজকে ভাবিয়ে তুলেছে তা হলো, অনেক অভিভাবক সন্তানের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছেন। অতি স্নেহ-আদর এবং উদাসীনতা এর মূল কারণ বলে ধারণা করা যায়। অধিকাংশ অভিভাবক স্কুলপড়ুয়া সন্তানের হাতে স্মার্টফোন তুলে দেন। তাদের কারো কারো মনোভাব এমন যে, সন্তানের হাতে একটি ভালো স্মার্টফোন তার আভিজাত্যকে বাড়িয়ে দেয়। এর ফল আমরা প্রতিনিয়ত দেখছি শিক্ষার্থী নৈতিক স্খলনের দিকে ধাবিত হয়। আমি অনেক অভিভাবককে জিজ্ঞেস করেছি, কেনো আপনি সন্তানকে এতো দামী মোবাইল ফোন দিলেন। অভিভাবক উত্তর দিলেন, ফোন না দিলে বাসায় মা-বাবার ওপর চড়াও হয়, বাসায় উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করে। একবার ভাবতে পারেন, ষাট-সত্তর-আশির দশকেও কি শিক্ষার্থীর এমন আচরণ লক্ষ্য করা গেছে?

আমার একজন সহকর্মী ক্লাসে মোবাইল ফোন ব্যবহার করার কারণে একদিন ক্লাস থেকে কয়েকটি মোবাইল সেট নিয়ে এসেছেন। আমি তাদের অভিভাবককে ডাকিয়ে আনলাম। তাদেরকে বোঝানের চিষ্টা করলাম যে, এ বয়সে মোবাইল না দিলেই নয়? আমার মনে হয়েছে তারা আমার কথায় সন্তুষ্ট হতে পারেননি। তাদেরকে বললাম, মোবাইল ফোনগুলো আমাদের কাছে কয়েকদিন থাকুক। আমি একজন অভিভাবকও পেলাম না বলতে, ঠিক আছে আপনি তাদেরকে একটু বোঝানোর চেষ্টা করেন এবং মোবাইল যেনো ব্যবহার না করে পরামর্শ দিন। প্রায় সকল অভিভাবক অনুরোধ করলেন, স্যার! মোবাইলগুলো দিয়ে দেন নতুবা তারা বাসায় ঝামেলা করবে। সত্যিই আমি হতাশ হলাম। এতে বোঝা গেলো সন্তানের প্রতি তাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তারা সন্তানের কাছে অনেকটা জিম্মি।

আধুনিক বিজ্ঞানমনস্কতা আমাদের সন্তানদের অনেক সময় নৈতিক স্খলন ডেকে আনে। অভিভাকরা কি একবারও খোঁজ নেন তার সন্তান মোবাইলটি কী কাজে ব্যবহার করছে? রুমের দরজা বন্ধ করে মোবাইল ফোনটা নিয়ে কী করছে? বিষয়গুলো আমাকে অনেক সময় ভাবিয়ে তোলে। কেউ হয়তো বলতে পারেন, মোবাইল ব্যবহারের ভালো দিকটাওতো আছে। আমি স্বীকার করি, সেটা আছে কিন্তু সন্তান যখন সেটা অপব্যবহার করে সেদিকে অভিভাবক কতোটা সচেতন? আপনি যখন সন্তানের হাতে মোবাইল ফোন তুলে দেবেন আপনার দায়িত্ব আরো বেড়ে যাবে, সন্তান মোবাইল ফোনটি কী উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে। আরেকটা বিষয় আমি লক্ষ্য করেছি, সেই সমস্ত শিক্ষার্থীর কাছেই দামী স্মার্ট ফোন দেখা যায় যার পিতা বিদেশ থাকেন। অনুসন্ধানে বোঝা গেলো, তারাই দামী স্মার্টফোন ব্যবহার করে যাদের পিতা বা মামা বিদেশে থাকেন। এই স্নেহ-ভালবাসায় সন্তানের জীবনে কতটুকু নেতিবাচক প্রভাব পড়ে তারা একবারও ভেবে দেখেন না।

বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় আমাদের শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা যে কী সীমাহীন দুর্ভোগ ও উদ্বিগ্নতার মধ্যে আছেন, এটি তার চিত্র। বিশ-ত্রিশ বছর আগেও শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক ছিলো গুরু-শিষ্যের। শিষ্য যে ভক্তি নিয়ে গুরুকে সমীহ করতেন, গুরুরাও সে মর্যাদা ধরে রাখতে নিজেদের সে উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার জন্যে পড়াশোনা করতেন ও আদর্শবান হতেন। শিক্ষকদের মর্যাদার জায়গাটা আগের তুলনায় অনেকটাই হারিয়ে গেছে। তার অন্যতম প্রধান কারণ হলো মানুষের সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়। শিক্ষক এবং ছাত্রের মধ্যে নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধের চর্চা কমে গেছে। অভিভাবকদের সাথেও নেই কোনো পারস্পরিক সম্পর্ক। শিক্ষা এখন এতোটাই বাণিজ্যিকরণ হয়েছে যে, এখন শিক্ষা আর জ্ঞান আহরণের বিষয় নয়। শিক্ষা হয়ে গেছে ভালো চাকুরি পেয়ে অঢেল সম্পদের মালিক হওয়া। এমন মানসিকতা থেকে আমাদের বের হয়ে আসতেই হবে। (চলবে)

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়