বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৩ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জে সংবাদকর্মীর কন্যাকে অপহরণ চেষ্টায় অভিযুক্তদের অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবি ফরিদগঞ্জ প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন সংগঠনের
  •   লক্ষ্মীপুরে মাদকসহ বাবা ও দুই ছেলে আটক
  •   চাঁদপুর সদর মডেল থানা পুলিশের অভিযানে বিভিন্ন মামলার ৮ আসামী আটক
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার

প্রকাশ : ০১ মে ২০২২, ০০:০০

রক্ত ঝরানো মে
অনলাইন ডেস্ক

বিশ্বের কোটি কোটি শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আন্দোলন আট ঘণ্টা কর্মের দাবিতে, যা ছিলো রক্ত ঝরানো এক সুদূরপ্রসারী ইতিহাস এবং বৈষম্য ও শোষণমুক্ত সমাজ গঠনের তাগিদে একটি ঐতিহাসিক ও যুগান্তকারী পদক্ষেপ। আর শ্রেণী-বৈষম্যের বিলুপ্ত ঘটিয়ে দীর্ঘদিনের শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার আদায়ে এক জোরালো প্রত্যয়। ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’ স্লোগানে আকাশ কম্পিত হয়েছিলো শিকাগো হে মার্কেটে। অতিরিক্ত মুনাফাখোর অর্থলোভী মালিকদের বিরুদ্ধে শোষণ-মুক্তির অঙ্গীকার, যা ছিলো দিনবদলের এক নতুন মাত্রা। ১৮৮৬ সালের পহেলা মে আমেরিকার শিল্পনগরী শিকাগো শহরের হে মার্কেটে সংঘটিত হয় শ্রমিকদের বীরোচিত আত্মত্যাগের কাহিনি, রক্তের কালিতে লেখা ইতিহাস। সেদিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্থানের তের হাজার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে শ্রমিকরা কর্মবিরতি ঘোষণা দিয়ে জড়ো হন ঐতিহাসিক হে মার্কেট স্কোয়ারে, সেখানে তিন লাখেরও বেশি শ্রমিক উপস্থিত ছিলেন এবং ক্রমান্বয়ে দুদিনের মধ্যে এর সংখ্যা দশ লাখ অতিক্রম করেছিলো। শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি-দাওয়া বিশেষ করে আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে উদ্ভূত দৃঢ়চেতা আপোষহীন শ্রমিকেরা এ ঐতিহাসিক দিনে একত্রিত হয়েছিলেন শিকাগোর ম্যাককরমিক ওয়াক্স কারখানার সামনে। আকাশে হালকা বৃষ্টি দিনের আলো খসে পড়েছে কিছুক্ষণ আগে, এই ঐতিহাসিক সমাবেশের প্রধান বক্তা ছিলেন অগাস্ট স্পাইস। তার বক্তব্যের সময় সমাবেশে আগতদের পিছু হটাতে হাজির ছিলো দাঙ্গা পুলিশের বিশাল দল। মুষ্টিবদ্ধ হাজারো মেহনতি মানুষের গগনভেদী হুংকার আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে, তারা ছিলেন সেদিন অটল। এই ঐতিহাসিক সমাবেশে পুলিশ শ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ করার উদ্দেশ্যে ধেয়ে আসার সময় কেউ একজন পুলিশকে লক্ষ্য করে বোমা ছোড়ে, যদিও হামলাকারীর পরিচয় জানা যায়নি, তবে পরক্ষণই পুলিশ বেপরোয়া হয়ে শ্রমিকদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে থাকে। তার ফলস্বরূপ অনেক মেহনতি জনতার রক্ত ঝরে ঐতিহাসিক এ রাজপথে। এরপরও থেমে নেই, শাসকগোষ্ঠীর উস্কানিতে পরবর্তীতে পুলিশ মামলা রুজু করে মেহনতি মানুষের বিরুদ্ধে। শুরু হয় প্রহসনমূলক বিচার, ১৮৮৭ সালের ১১ নভেম্বর উন্মুক্ত স্থানে ফাঁসির মঞ্চে ছয়জনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। এর একদিন আগে লুই কিং নামে এক মেহনতি শ্রমিক কারাগারের অভ্যন্তরে আত্মহত্যা করেন। অপর একজন অস্ফার নীবে নামক এক মেহনতি জনতাকে দেয়া হয় পনের বছরের কারাদণ্ড। মেহনতি মানুষের ইতিহাসে এই ঘটনা লেখা থাকবে রক্তের কালিতে। মনে আছে সেই দিন ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে উদাত্ত কণ্ঠে মেহনতি জনতার উদ্দেশ্যে আগস্ট স্পাইস বলেছিলেন, The day will come when our silent will be more powerful than the voice you are throwing today. আজ আমাদের এই ফাঁসি, তোমাদের আওয়াজ অপেক্ষা অধিক বেশি শক্তিশালী হবে।

ফাঁসিতে ঝোলানোর আগে অ্যাডল্ফ ফিশার উদাত্ত কণ্ঠে বলেছিলেন This is happiest moment of my life. এরপর ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে আলবার্ট পারসন্সও বলেছিলেন Let the voices of people be heard. এই বাক্যটি শেষ হওয়ার সাথে সাথেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন এ আত্মত্যগী মহান বিপ্লবী।

সবচাইতে করুণ যা হলো, এই মিথ্যা বিচার শেষ পর্যন্ত মিথ্যায় পরিণত হলো। ২৬ জুন ১৮৯৩ সালে ইলিনয়ের গভর্নর জন পিটার অটগেল্ডের পক্ষ থেকে জানানো হলো, মিথ্যা ছিলো এই বিচার। পুলিশের কমান্ডারকে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত করা হলো। ইতিহাস তার রায় পেলো।

১৮৮৯ সালে ঐতিহাসিক ফরাসী বিপ্লবের শতবার্ষিকী উদ্‌যাপন উপলক্ষে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক প্রথম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। সেখান থেকে ১৮৯০ সালে শিকাগোর হে মার্কেটের ঘটনার জোরালো নিন্দা করে আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন দেশে শোক পালনের প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। এই প্রস্তাব করেন রেমন্ড লাবিন। যা ১৮৯১ সালে আন্তর্জাতিক দ্বিতীয় কংগ্রেসে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। ১৯০৪ সালে আমস্টারডাম শহরে অনুষ্ঠিত বিশ্ব সমাজতন্ত্রীদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে একটি ঐতিহাসিক প্রস্তাব গৃহীত হয়। সেই প্রস্তাবে ছিলো, দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের সময় নির্ধারণ এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যে বিশ্বজুড়ে পহেলা মে মিছিল শোভাযাত্রা আয়োজন। এ ব্যাপারে সকল সমাজবাদী প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দল এবং ট্রেড ইউনিয়নকে আহ্বান জানানো হয়। এই সম্মেলনে কোনো ক্ষয়ক্ষতি বা হতাহতের সম্ভাবনা না থাকলেও বিশ্বব্যাপী সকল শ্রমিক সংগঠন মে মাসের ১ তারিখে বাধ্যতামূলক কাজ না করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বিশ্বের অনেক দেশের শ্রমিক সংগঠনগুলো পহেলা মে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে পালনের জন্যে দাবি জানায় এবং অনেক দেশেই তা কার্যকর হয়। তাই আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবস মে দিবস।

শৃঙ্খল ছাড়া প্রলেতারিয়েতদের হারাবার আর কিছুই নেই

১৮৮৬ সালের এই দিনে শিকাগোর হে মার্কেট স্কয়ারে শ্রমিকদের যে বীরোচিত অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়েছিলো আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে, সেই আত্মত্যাগের দিনটিকে সামনে রেখেই সারাবিশ্বে মে দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। আমাদের বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। পহেলা মে সরকারি ছুটির দিন। মে দিবসের প্রতিপাদ্য ‘শ্রমিক-মালিক গড়বো দেশ এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ’। শ্রমিকদের সার্বিক অধিকার এবং মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় ন্যায্য মজুরি নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত কর্মপরিবেশ আন্তরিকভাবে নিশ্চিত করতে সকলের প্রতি উদাত্ত আহ্বান। মে দিবসের সাথে শ্রমজীবী মেহনতী মানুষের স্বার্থ কল্যাণ ও অধিকার উপযুক্ত মজুরি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত এবং কালজয়ী ইতিহাস রচনায় অপরিসীম গৌরবময় এ দিবসটি। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রতিশ্রুতি মেহনতি মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে শোষণমুক্ত আত্মমর্যাদাসম্পন্ন একটি পূর্ণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে তোলা। শ্রমিকদের সর্বাত্মক সুরক্ষার লক্ষ্যে শ্রম আইন সংশোধন এবং যুগোপযোগী শ্রম বিধিমালা প্রণয়ন এবং শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন গঠন। শোষণ-বঞ্চনার পূর্ণাঙ্গ অবসানের লক্ষ্যে কাজ করা। করোনার করালগ্রাসে বিশ্বের সাথে সাথে বাংলাদেশও জর্জরিত। সেই মুহূর্তে এই করুণ প্রেক্ষাপট বিচার করে মেহনতি মানুষের কল্যাণে সরকার এবং মালিকশ্রেণীর আন্তরিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। শিশুশ্রম এবং তাদেরকে কম মজুরিতে খাটিয়ে নেয়ার বিরুদ্ধে সকলকে থাকতে হবে সোচ্চার এবং আপোষহীন।

আমরা যদি একটু পেছন ফিরে তাকাই অর্থাৎ ১৮৬০ সালের দিকে, শ্রমিকরা তাদের বরাদ্দকৃত মজুরি না কমিয়ে পূর্ণ দিবসে আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে সম্পূর্ণ অটল থাকে এবং একটি গঠনমূলক প্রস্তাব আকারে কাজের সময় নির্ধারণের দাবি জানায়। তারই প্রেক্ষাপটে আমেরিকান ফেডারেশন অব লেবার নামে একটি শক্তিশালী শ্রমিক সংগঠন গড়ে তোলা হয়।

মে দিবসের মাধ্যমে শৃঙ্খল ও শোষণহীন সমাজব্যবস্থা কায়েমে বদ্ধপরিকর হয় মেহনতি জনতা। জয় হোক মেহনতি জনতার। দুনিয়ার মজদুর এক হও।

মাহাবুবুর রহমান সেলিম : সভাপতি, শিল্পচূড়া শিল্প সাহিত্য ও সামাজিক সংগঠন; সভাপতি : মাদকমুক্ত চাঁদপুর গড়ি।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়