বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৭ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জে সংবাদকর্মীর কন্যাকে অপহরণ চেষ্টায় অভিযুক্তদের অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবি ফরিদগঞ্জ প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন সংগঠনের
  •   লক্ষ্মীপুরে মাদকসহ বাবা ও দুই ছেলে আটক
  •   চাঁদপুর সদর মডেল থানা পুলিশের অভিযানে বিভিন্ন মামলার ৮ আসামী আটক
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার

প্রকাশ : ২৪ এপ্রিল ২০২২, ০০:০০

রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা : মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি ও বিপক্ষশক্তি
অনলাইন ডেস্ক

রাজনীতি বিজ্ঞানের একটি প্রবাদ তথা একটা কথা আছে, যে দেশের বৃহত্তর মানুষ যেমন, সে দেশে সেরকমই রাজা বা শাসক থাকে। বাংলাদেশ এর ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে সংস্কৃতির উদয় হয়েছে, উত্তেজিত অশালীন ভাষায় যে রাজনৈতিক নেতা যত বেশি বক্তৃতা দিতে পারেন, তিনি ততটাই আমজনতার দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হন ও সমর্থক গোষ্ঠীর জোরালোভাবে বড় বড় হাততালি পান এবং মিডিয়ায় ভালো কভারেজ হয়। জনকল্যাণ সম্পর্কিত বিষয়- অর্থনীতি, বাজারব্যবস্থা, বাজেট, পররাষ্ট্রনীতি, বাণিজ্য ও প্রতিরক্ষানীতি ইত্যাদির ওপর যিনি যথার্থ রেফারেন্সসহ যুক্তির দ্বারা ভালো-খারাপ দিক তুলে ধরেন, তার কথা আমরা আমজনতা শুনতে চাই না, পানসে লাগে। রেফারেন্স ও যুক্তি ছাড়া একতরফা বক্তব্য দিতে ও শুনতে আমরা অভ্যস্ত, এতে চিত্ত উদ্বেলিত হয়। তাৎপর্যময় জ্ঞানগর্ভ কথা কেউ শুনতে চায় না, বরং উল্টো মন্তব্য করা হয়, বেটা জ্ঞান দিচ্ছে।

ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ, দখলবাজ, দাঙ্গাবাজ, সন্ত্রাসী, লাঠিয়াল, ধর্ষক যখন ভোটে জিতে সংসদ সদস্য কিংবা মন্ত্রী হন, তখন রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতির অবস্থা তেমনই হবে, ভালো কিছু আশা করা বৃথা। পাকিস্তানি এজেন্ট, গণহত্যাকারী, ধর্ষক, চিহ্নিত ও স্বঘোষিত যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামী যখন ভোটে জিতে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী হন, তখন সেই নির্বাচন যত সুষ্ঠুই হোক না কেন, তার মাধ্যমে দেশের কোনো কল্যাণ হতে পারে না। সুস্থ রাজনীতি ফিরবে না তথা রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা আসতে পারে না। নিজামীকে এদেশের মানুষই ভোটে জিতিয়েছে, এ কলঙ্কের দায় সমগ্র জাতির। কিন্তু এককভাবে এ দায় যদি কারো কাঁধে পড়ে, তাহলে তিনি হবেন বিএনপি’র প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়াউর রহমান। তিনি যদি সামরিক আদেশ দ্বারা ’৭২’র সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা এবং অনুচ্ছেদ ১২ ও ৩৮ বাতিল না করতেন, তাহলে মতিউর রহমান নিজামী গং কখনও এ দেশে রাজনীতি করতে পারতেন না। সামরিক শাসকদের প্রবর্তিত রাজনীতি ও রাজনৈতিক দল পৃথিবীর কোনো দেশেই দীর্ঘস্থায়ী হয়নি, ব্যতিক্রম বাংলাদেশ। ’৭৫’র পর পর্যায়ক্রমে ক্ষমতায় আসা দু’জন সামরিক শাসক প্রায় ১৫ বছর ক্ষমতায় থেকে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও রাজনীতির সবকিছু নষ্টদের হাতে তুলে দেন। '৯০’র গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটা প্রত্যাশার সৃষ্টি হয়। কিন্তু গত ৩১ বছরে সেই প্রত্যাশা শুধু প্রত্যাশার মধ্যেই রয়ে গেছে। দুই সামরিক শাসক কর্তৃক প্রবর্তিত নষ্ট রাজনীতি শুদ্ধিকরণের পথে কিছুই হয়নি। কেন হয়নি, তার কারণ কমণ্ডবেশি সবারই জানা।

’৯১ সালে নির্বাচনে জয়ী হয়ে বিএনপি ক্ষমতায় এলো। একটু আগে উল্লেখ করেছি, তখন একটা প্রত্যাশার সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ সম্বলিত গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার পরিবর্তে বিএনপি সরকার হঠকারী শুধু নয়, বিপরীত দিকে যাত্রা শুরু করে। ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল। ২০০১ সালের জুলাই মাসে মেয়াদ পূর্ণ করে যথারীতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা ছেড়ে দেয়। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এসেই আবার ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার জন্য অপকর্মে লিপ্ত হয়। আওয়ামী লীগকে চিরতরে শেষ করে দেওয়ার জন্য ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশের ওপর গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। তারপর পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান যাতে নিজেদের সাবেক দলীয় নেতাকে করা যায় তার জন্যে অন্যান্য সব ক্যাডার বাদ দিয়ে শুধু বিচারকদের চাকরির বয়সসীমা দু’বছর বৃদ্ধি করে দেওয়া হয়। রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনকে একই সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান বানিয়ে ক্ষমতাকে ধরে রাখার নগ্ন প্রচেষ্টায় দেশ গভীর সংকটে পড়ে যায়। সে পথ ধরে আসে কথিত '১/১১’-এর সরকার।

এ রকম একটি পরিস্থিতি অতিক্রম করছি, যে সময়টি হচ্ছে রাজনীতির এমন একটা পর্ব যে পর্বে দক্ষিণ এশিয়াসহ বহুদেশে দুই বিপরীতধর্মী দর্শন ও রাজনীতির যুদ্ধ চলছে নিষ্পত্তির জন্যে। আমি রাজনীতি বিজ্ঞানের ছাত্র এবং বামধারার রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত থেকে চুপ থাকতে পারছি না। তাই বলতে হয়, বাংলাদেশ এর বাইরে বা ব্যতিক্রম নয়। আমরা এটা প্রত্যক্ষ করছি। এখানেও সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী, জঙ্গিবাদী ও যুদ্ধাপরাধী চক্রের সাথে অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক শক্তির তীব্র লড়াই চলছে। বেশ সময় ধরে দেশে আজ এই দুই ধারার রাজনীতি তথা লড়াই চলছে। এই পরিস্থিতি বিবেচনায় না এনে বাংলাদেশের অনেকেই শেখ হাসিনা ও খালেদার জিয়ার মধ্যে সমঝোতার কথা বলেন। এ সমঝোতার কথা বলা ইদানিং একটা ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। সমঝোতার ঐকমত্য আমরাও চাই, কিন্তু তা হতে হবে নেতাণ্ডনেত্রী অথবা দলের সাথে দলের সমঝোতা, নীতির ভিত্তিতে সমঝোতা। কিন্তু হত্যাকারীর সাথে তো সমঝোতা হতে পারে না। লুটেরা ও ধর্ষণকারীর সাথে সমঝোতা মোটেইতো না। ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীর সাথে সমঝোতা কখনও না। এই সকল জঘন্য অপরাধীকে আইনের ঊর্ধ্বে রাখার সমঝোতার কথা যারা বলেন সেই সমঝোতায় ১৪ দল তথা মহাজোটের কেউ যেতে পারে না এবং কখনও যাবে না।

বেগম খালেদা জিয়া নির্বাচনের ফল (২০০৮ সালের) মানেননি। শপথ নিলেও সংসদের উদ্বোধনী অধিবেশনে যোগ দেননি। সংসদ বর্জন করে সংসদকে অকার্যকর করার চেষ্টা করেছেন। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের যখন ফাঁসি হলো তখন তিনি নীরবতার মধ্য দিয়ে খুনিদের সমর্থন দিয়েছেন, যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষ অবলম্বন করেছেন, বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল বাতিল করার ঘোষণা দিয়েছেন, প্রকাশ্যে বিডিআর-এর ঘটনার চক্রান্তকারীদের পক্ষ নিয়েছেন, আদালতগুলোর রায় অস্বীকার করেছেন এবং সংবিধান সংশোধন কমিটিতে অংশগ্রহণ না করে সংকট জিইয়ে রাখার প্রচেষ্টা চালিয়েছেন।

২০০৯ সাল থেকে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে এবং আগামী নির্বাচন পর্যন্ত একনাগাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা হবে। সরকারের বিরুদ্ধে হামলা, মামলা, হয়রানি, নির্যাতনের অভিযোগ করে আসছে বিএনপি। এর মধ্যে মিথ্যা ও সত্য দু-ই থাকতে পারে। ২০২৩ সালের শেষার্ধে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচন নিয়ে এখন থেকে মাঠ গরম করার চেষ্টা করছে বিএনপি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরে আসার সব পথ সাংবিধানিকভাবে রুদ্ধ। সব জেনেও বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি তুলছে। ফেব্রুয়ারি মাসে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে। শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন সবারই প্রত্যাশা। কিন্তু এই কঠিন চাওয়ার প্রশ্নে বড় দুই রাজনৈতিক পক্ষ আগের মতোই বিপরীত মেরুতে যে থাকছে তা অনেকটা নিশ্চিত করে বলা যায়। সুশীল সমাজও এটা নিয়ে চরম বিভাজিত অবস্থানে বলতে হয়। সংবিধান অনুসারে আইন হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু বিএনপি-আওয়ামী লীগ কোনো সরকারই সেটা করেনি। হুদা কমিশন যে প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রপতি গঠন করেছিলো তা সংবিধানবহির্ভূত এমন কথা কেউ বলেননি বা বলতে পারেননি। সুতরাং বর্তমান নির্বাচন কমিশনও রাষ্ট্রপতি একইভাবে গঠন করলে সেটিকে আইনত প্রত্যাখ্যান করার সুযোগ ছিল না। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ইস্যুতে সবপক্ষ একমত হবে এমন নজির কোথাও আছে বলে মনে হয় না। সবপক্ষই নিজ নিজ রাজনৈতিক সুবিধা পাওয়ার জায়গায় অনড় থাকবে এবং সেটাই স্বাভাবিক আর অনড় না থাকাটা অস্বাভাবিক। এ অবস্থায় কেউ হয়তো বলতে পারেন, দুই বড় পক্ষ আওয়ামীলীগ ও বিএনপি’র মধ্যে কি সমঝোতা হতে পারে না এবং আরও বলতে পারেন, রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। তবে একটু আগে উল্লেখ করেছি, কেন বিগত সময়ে সমঝোতা হয়নি, তার কারণ কমণ্ডবেশি সবারই জানা; বর্তমানেও হতে পারে না।

সে ক্ষেত্রে সমঝোতার পথ কীভাবে বিগত সময়ে বিনষ্ট হয়েছে তার যথার্থ নির্মোহ মূল্যায়নে শিক্ষণীয় বিষয়কে অবলম্বন করে সবাই সামনে এগোতে চাইলে সমঝোতার পথ বের হবে এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসবে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্যে প্রথমেই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ ও বিপক্ষের রাজনীতির অবসান ঘটানো আবশ্যক। তা সম্ভব তখনই যখন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি-সরকারি দল এবং বিরোধী দলও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির রাজনৈতিক দল হবে। তা শুধু কথায় নয় কাজেও সাংবিধানিকভাবে হতে হবে। তবেই সরকারি ও বিরোধীদলের মধ্যে সমঝোতা হতে পারে এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার সৃষ্টি হবে। আর এর জন্যে প্রথমত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ২৩ বছরের গৌরবোজ্জ্বল সংগ্রামের ইতিহাস বাঙালি রাষ্ট্রের জন্য অফুরন্ত সম্পদণ্ড-বিএনপিসহ সবাইকে এটি আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করতে হবে। দ্বিতীয়ত জাতির পিতা ও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের প্রতি আনুষ্ঠানিকভাবে সবাইকে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে হবে। তৃতীয়ত বাহাত্তরের সংবিধান কোনো দলের নয়, এটা স্বাধীন বাংলাদেশের মৌলিক ভিত্তি ও দর্শন। এগুলোর প্রতি সবার অকুণ্ঠ-সমর্থনসহ হুবহু ’৭২’র সংবিধানে ফিরে আসতে হবে। আর এটাই সুষ্ঠু রাজনৈতিক পরিবেশ তথা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার পথ সুগম করবে। রাজনীতি সুষ্ঠু অবস্থায় ফিরে না এলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও নির্বাচন কমিশন যে প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয় তা ইতিমধ্যেই বারবার প্রমাণিত হয়েছে।

লেখক পরিচিতি : অধ্যাপক মোঃ হাছান আলী সিকদার, সভাপতি, চাঁদপুর জেলা জাসদ; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রনেতা; চাঁদপুর জেলা শিক্ষক নেতা, সমাজ ও রাজনীতিবিশ্লেষক।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়