প্রকাশ : ২১ এপ্রিল ২০২২, ০০:০০
মুজিবনগর দিবসের আলোচনায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক সপরিবারে জাতির পিতার হত্যাকারী খুনি মোশতাকের প্রতি শ্রদ্ধা দেখানোর মতো যে ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়েছে, তাতে পুরো জাতি স্তম্ভিত হয়েছে। খুনিদের প্রেতাত্মারা এখনো যে সমাজের নানা জায়গায় ঘাপটি মেরে বসে আছে, সেটি আমাদের আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো।
এই শিক্ষকের বিষয়ে আমি অনেককেই বেশ আগে থেকেই সতর্ক করেছিলাম। প্রায় দেড় বছর আগে এই শিক্ষককে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) সদস্য নিয়োগ করার জন্যে উক্ত কমিশন থেকে সরকারের কাছে প্রস্তাব পাঠানোর পর ঐ শিক্ষক সম্পর্কে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে সরকার এই শিক্ষককে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের সদস্য নিয়োগ করেনি। সরকার ঐ শিক্ষককে নিয়োগের জন্যে ইউজিসির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিল। এটি দুঃখজনক যে, রাষ্ট্রের এই বার্তা অনেকেই কর্ণপাত করেনি। শিক্ষক নামের কলঙ্ক এই ব্যক্তি যে ধৃষ্টতা এবং ঔদ্ধত্য দেখিয়েছে, তাতে এই কুলাঙ্গারকে ক্ষমা করার কোন সুযোগ নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মত জায়গায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন শিক্ষক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু, বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, জাতির পিতা ও বঙ্গমাতার শিশুপুত্র রাসেলের হত্যাকারী খুনি মোশতাকের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাবে, এটি কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না। টিএসসির অডিটোরিয়াম থেকে এখনো জাতির পিতার জ্যেষ্ঠ পুত্র শহীদ শেখ কামালের নাটকের রিহার্সালের আওয়াজ শুনতে পাওয়া যায়। কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক এই অডিটোরিয়াম থেকে খুনি মোশতাকের নাম নিতে পারলো? এই টিএসসির অডিটোরিয়ামে অসংখ্যবার শহীদ শেখ কামালের শিক্ষক আর সহপাঠীরা তাঁর জন্মদিনে স্মৃতিচারণ করেছে। এই স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠানে বড় বোন শেখ হাসিনাও কয়েকবার উপস্থিত ছিলেন।
এই টিএসসি অডিটোরিয়ামে গত চল্লিশ বছরের বেশি সময় ধরে কত অসংখ্যবার সপরিবারে জাতির পিতার হত্যার প্রতিবাদ হয়েছিল, ইতিহাসের সবচেয়ে বর্বরতম এই হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করা হয়েছিল। এই অডিটোরিয়ামে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের দাবিতে সবচেয়ে বেশি বক্তৃতা হয়েছে, সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয়েছে। এই অডিটোরিয়াম থেকে জাতির পিতার খুনিদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছাড়া অন্য কিছু প্রকাশিত হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক খুনি মোশতাকের নাম কীভাবে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করতে পারে? এই ঘৃণ্যতম ঘটনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেও কলঙ্কিত করেছে। মোশতাক-জিয়া গং ইতিহাসের সবচেয়ে ঘৃণিত খুনি। জাতির পিতাকে হত্যার মধ্য দিয়ে তারা একটি দেশকে হত্যা করতে চেয়েছিল- বাংলাদেশকে পাকিস্তানি ভাবধারায় ফিরিয়ে নিতে চেয়েছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ঘটনা আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে, মুখোশধারীরা সমাজের নানা স্তরে মিশে আছে। কেও পেশাদারিত্বের মুখোশ, আবার কেও দলীয় পরিচয়ের মুখোশ পড়ে আছে। নানা পরিস্থিতিতে তাদের মুখোশ খসে পড়ে। তাদের অনেকেই পরিস্থিতির কারণে নিজেরাই নিজেদের আসল রূপ প্রকাশ করে দেয়। তবে এটি আমাদের মনে রাখতে হবে, পেশাদারিত্বের মুখোশধারীদের চেয়ে দলীয় পরিচয়ের মুখোশধারীরা অনেক ভয়ংকর।
দলীয় পরিচয়ের মুখোশ ধারণের একটি ঘটনা আমি উল্লেখ করছি। সাম্প্রতিক সময়ে একজন সরকারি প্রকৌশলীকে পেটানোর কারণে সরকার চাঁদপুরের এক উপজেলা চেয়ারম্যানকে আইনানুযায়ী সাময়িক বরখাস্ত করেছিল। সাময়িক বরখাস্ত হওয়ার একদিনের মাথায় এই চেয়ারম্যান খালেদা জিয়ার ছবির পাশে নিজের ছবি যুক্ত করা সরকার বিরোধী এক ডিজিটাল পোস্টার নিজের ফেসবুক থেকে শেয়ার করেছিল। সেই ডিজিটাল পোস্টারে খালেদা জিয়ার বিচার নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করা হয়েছিল। সরকারের বিরুদ্ধে নানা মিথ্যা বিষোদগার করা হয়েছিল।
এ জন্য তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছিল। মামলায় চার্জশিট হয়েছিল। এর কয়েক মাস পর আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে দেশ বিরোধী কিছু রাজনীতিক এবং তথাকথিত সুশীল সমাজের কিছু সদস্যের নানা অপপ্রচার চলাকালে এই চেয়ারম্যান তার ফেসবুক থেকে আওয়ামী লীগের নেতাদের বিরুদ্ধে আরেকটি ওয়ান ইলেভেন ঘটানোর হুমকি দিয়েছিলো। এ ঘটনায় তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছিল। অপরদিকে প্রকৌশলী পেটানোর বিভাগীয় মামলার তদন্তে চূড়ান্তভাবে দোষী প্রমাণিত হওয়ার পরও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
এই দলীয় পরিচয়ের মুখোশধারীরাই খুনি মোশতাক, তাহেরউদ্দিন ঠাকুর, শফিউল আলম প্রধানদের প্রেতাত্মা। খুনি মোশতাক এবং কয়েকজন খুনি আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কোনো দলের সাথে যুক্ত ছিল না। শফিউল আলম প্রধান ছাত্রলীগের আগে অন্য কোনো ছাত্র সংঘটনের সাথে যুক্ত ছিল না। পঁচাত্তরে তাদের মুখোশ খসে পড়েছিল। মান্নার মতো বর্ণচোরারাও সময়ে সময়ে লেবাস পরিবর্তন করেছিল। এই বর্ণচোরারা দলীয় লেবাসে ঘাপটি মেরে বসে আছে।
রাষ্ট্রের নিরাপত্তার স্বার্থে সকল মুখোশধারীকে চিহ্নিত করা জরুরি। পেশাদারিত্বের পরিচয়ের মুখোশধারী হোক আর দলীয় পরিচয়ের মুখোশধারী হোক-এদের চিহ্নিত করতে হবে।
লেখক : তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং সাবেক অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।