শুক্রবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৫  |   ৩৪ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য
ব্রেকিং নিউজ
  •   চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ইউসুফ গাজী গ্রেফতার

প্রকাশ : ০৬ এপ্রিল ২০২২, ০০:০০

দুর্ভাগা মুল্লুক
অনলাইন ডেস্ক

১৭৫৭ সালের ২৩ জুন বাংলার স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হওয়ার পরেই ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যের সূর্য উদিত হয়। যা অস্তাচলে যাওয়ার ঘণ্টা বেজে উঠে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট, মতান্তরে ১৫ আগস্ট। যুদ্ধক্ষেত্রে মীরজাফরীতে, অন্দরমহলের নোংরা রাজনীতিতে এবং রায় দুর্লভ, জগতশেঠ প্রমুখের স্বার্থ-সম্বলিত কূটনীতির কারণে বাংলার স্বাধীনতা ব্রিটিশদের ছিনিয়ে নিতে অনেক সহজ হয়। মীরজাফর যদি সেদিন ব্রিটিশ বাহিনীর পদানত না হয়ে সম্মুখসমরে মীর মদন ও মোহন লালকে সামান্যতম সহযোগিতাও করতো, তাহলে বাংলার স্বাধীনতার হয়তো অন্য রূপ দেখা যেতো। যাক সেটা ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত। ধূর্ত ক্লাইভ বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার সেনাবাহিনীতে এমন সুচতুরভাবে ফাটল সৃষ্টি করেছিলেন যা আজও শরীরে শিহরণ জাগায়। রবার্ট ক্লাইভের সুচতুরতায় এমনটি ঘটেছিলো।

বাংলায় একটা প্রবাদ আছে : নরানাং নরসুন্দর ধূর্ত,/পক্ষি নাং বায়স্/মুনিনাং নারদ ধূর্ত,/জন্তুনাং শৃগাল। অর্থাৎ : মানুষের মধ্যে নরসুন্দর ধূর্ত, পক্ষির মধ্যে কাক, মুনিদের মধ্যে নারদ ধূর্ত, আর জন্তুদের মধ্যে বেশি ধূর্ত শৃগাল।

বিজয়ী ক্লাইভ তার ধূর্ততার প্রমাণ দিয়েছে এভাবে যে, বিজিতদের কাউকে স্বাভাবিকভাবে মরতেও দেন নি, জীবিতদের শান্তিতেও বাঁচতে দেন নি। ব্রিটিশ সৈন্যদের পরিচালক এবং ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির ধারক ও বাহক হিসেবে ব্রিটিশ প্রথম শাসক হয়ে পুরো পাক-ভারত উপমহাদেশের শাসনভার লর্ড ক্লাইভ নিজে গ্রহণ করেন। তখন তার পদবী ছিলো গভর্নর জেনারেল। ছিয়াত্তরের মন্বন্তর এবং জালীয়ান ওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের পর ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের কিছু এলোমেলো ভাবের উদয় হয় এবং ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহে বে-সামাল অবস্থায় যাওয়ার পর ব্রিটেনের মহারাণী ভিক্টোরিয়া স্বহস্তে পরিচালনার দায়িত্ব নেন। এরপর থেকেই গর্ভনর জেনারেল পদ পরিবর্তিত হয়ে ‘ভাইস রয়’ হয়ে যায়। লর্ড কর্নওয়ালিশ ব্রিটিশ রাজপরিবারের রাণী কর্তৃক ১৭৮৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভারতে ব্রিটিশ শাসক হিসেবে প্রেরিত হন এবং ১৭৯৩ সালের অক্টোবর মাসে ভূমি সংস্কার যুগান্তকারী আইন ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ তথা ভূমির সার্বভৌম মালিকানা প্রণয়ন করেন। সরকারি কর্মচারীদের জন্যে আইসিএস প্রথা চালু করেন এবং জমিদারি প্রথা চালু করে খাজনা আদায়ের পথ সুগম করেন।

লর্ড ওয়েলেসলির অধীনতামূলক মিত্রতা আইনের নির্মম শিকার হন টিপু সুলতান।

লর্ড উইলিয়াম বেন্টিং-এর আমলে হিন্দু সমাজের অনেক কুসংস্কার আইন করে দূরীভূত করা হয়। ১৮২৯ সালে লর্ড ডালহৌসির আমলে হিন্দু বিধবা বিবাহ আইন পাকাপোক্তভাবে রহিত হয়। ১৮৫৩ সালে ভারত বর্ষের রেল যোগাযোগ, ডাকটিকেট, হিন্দু বিধবা আইন পাকাপোক্তভাবে পাস করেন। লর্ড ক্যানিং ১৮৬২ সালে কোম্পানী আইন রদ করে প্রথম মুদ্রা ব্যবস্থা চালু করেন।

১৮৭২ সালে লর্ড মেয়ো সর্বপ্রথম ভারতবর্ষে আদম শুমারী আইন চালু করেন। লর্ড লিটন ১৮৮০ সালে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ করেন। ১৮৮৪ সালে লর্ড রিপন তা পুনরায় ফিরিয়ে দেন। লর্ড রিপন একই বছরে ভারতবর্ষে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। লর্ড কার্জন ১৯০৫ সালে বঙ্গবঙ্গ অ্যাক্ট করেন। লর্ড মিন্টু ১৯১০ সালে মুসলমানদের পৃথক নির্বাচনের সুযোগ দেন। লর্ড হার্ডিঞ্জ ১৯২১ সালে রাজধানী কোলকাতা থেকে দিল্লীতে স্থানান্তর করেন এবং তার সময়ে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ হার্ডিঞ্জ রেল সেতু নির্মিত হয়। ১৯৪৭ সালে লর্ড মাউন্টবেটেন ভারত ও পাকিস্তান নামক দুটি স্বাধীন দেশের সীমানা নির্ধারণ করে দেন। অবিভক্ত বাংলার শেষ গর্ভনর স্যার ফ্রেডরিক জন বারোজ।

ব্রিটিশ শাসনের আদ্যোপান্ত বিশ্লেষণে এ তথ্যই বেরিয়ে আসে যে, ব্রিটিশ এদেশে সার্বিক উন্নয়নমূলক কিছু কিছু কাজ করেছে সত্য, কিন্তু মাথার ওপর পরাধীনতার এমন কিছু নির্মম গ্লানি চাপিয়েছে যা মানবসভ্যতার কলঙ্ক বৈ অন্য কিছু নয়। সেই অনতিক্রান্ত বৃত্তিয় বঙ্গদেশ-ই আজকের বৃত্তাত্তিক্রান্ত বাংলাদেশ। যা জয় বাংলা জাতীয় শ্লোগানভিত্তিক বাংলাদেশ। যতো কিছু উন্নয়ন ব্রিটিশ করেছে সবই কোলকাতা (রাজধানী) তথা পশ্চিম বাংলায়। পূর্ব বাংলা (বাংলাদেশ) এবং আগরতলা উন্নয়নের দিক থেকে চরম অবহেলিতই রয়ে গেছে। পূর্ব পাকিস্তান তথা স্বাধীন বাংলাদেশ বিশে^ আজ উন্নয়নের রোল মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে। যা বিশে^র অনেক দেশেরই অনুকরণীয়। অতি প্রাচীনকালে বাংলা আক্রান্ত হতো বর্গীদের দ্বারা। প্রাচীনকালের যুগে যুগে বাংলা শোষিত, বঞ্চিত ও নিষ্পেষিত হয়েছে অবাঙালি দ্বারা। এতে বাংলার প্রকৃত সংস্কৃতি বিকৃত হয়ে গেছে। বাংলার এই মিশ্র সংস্কৃতি আমাদের সমাজে আজ বীভৎসতা, অমানবিকতা এবং পৈশাচিকতায় এক ভয়ংকর রূপ নিয়েছে। এই পরিমণ্ডল ‘আন্ডার ওয়ার্ল্ড’ নামে পরিচিত। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিবর্ণতা আর রাজনৈতিক অস্থিরতা এই পরিমণ্ডলেরই অপকর্ম। এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার একটি মাত্র পথই খোলা আছে যে, বাল্যশিক্ষা ও প্রাথমিক শিক্ষা নৈতিকতায় ভরপুর হতে হবে এবং মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষায় ড. কুদরত-ই-খোদার শিক্ষা কমিশন বাস্তবায়ন করা অপরিহার্য।

লেখক : কবি; অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র শিক্ষক, বলাখাল যোগেন্দ্র নারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয় ও কারিগরি কলেজ, হাজীগঞ্জ, চাঁদপুর।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়