বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২৪  |   ১৮ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জে সংবাদকর্মীর কন্যাকে অপহরণ চেষ্টায় অভিযুক্তদের অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবি ফরিদগঞ্জ প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন সংগঠনের
  •   লক্ষ্মীপুরে মাদকসহ বাবা ও দুই ছেলে আটক
  •   চাঁদপুর সদর মডেল থানা পুলিশের অভিযানে বিভিন্ন মামলার ৮ আসামী আটক
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার

প্রকাশ : ২৪ মার্চ ২০২২, ০০:০০

প্রকৃতি বনাম ইনসান
বিমল কান্তি দাশ

এ মহাবিশে^র গর্ভে অবণী নামক গ্রহের বিশাল ভূ-ম-লের অতি ক্ষুদ্র একটি অংশে মাত্র আমরা বাস করি। যাহা বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী একটা ক্ষুদ্র ভূ-খ- মাত্র। আমাদের এই ধরণী মিলিয়ন মিলিয়ন বছরের পুরাতন। একটি উত্তপ্ত প্রোটোপ্লাজম পি- হওয়ায় সৃষ্টির আদিতে এখানে জীবের অস্তিত্ব ছিল না। ক্রমশঃ শীতল থেকে শীতলতর হয়ে ভূ-খ-ে পরিণত হওয়ার পর মানব-মানবীর আবির্ভাবের পূর্বে এই ভূ-খ-ে বাস করতো বিভিন্ন ধরনের জীব-জন্তু। যাদের ধ্বংসাবশেষ (ঋড়ংংরষং) আধুনিক যুগের বিস্ময়।

সৃষ্টির অবলীলায় ধরণীতে মানব-মানবীর আবির্ভাব, পাহাড়-পর্বত, নদী, সাগর, উপসাগর, ধূ-ধূ মরুভূমি, বিস্তীর্ণ সবুজ বনভূমি আরো কত কি পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল সৃষ্টি। কোথাও নিশীথ সূর্যের দেশ, কোথাও উদীয়মান সূর্যের দেশ, কোথাও ভূ-স্বর্গ এবং কোথাও নয়নাভিরাম জলপ্রপাত নায়াগ্রা। আর এই বাংলাদেশে রয়েছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলা ক্ষেত্র। যেখানে এক জায়গায় দাঁড়ায়ে সূর্যের উদয়-অস্ত পরখ করা যায়।

জাগতিক ইতিহাস অবশ্যই একজন রচয়িতা কোনো না কোনো ভাষায় রচনা করেন, যার নির্দিষ্ট বর্ণমালা আছে। পৃথিবী সৃষ্টির ইতিহাস প্রকৃতির স্ব-রচিত। এর বর্ণমালা কিন্তু প্রকৃতিতেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। যেমন এক টুকরো পাথর কিন্তু প্রকৃতি সৃষ্টির ইতিহাসের একটি উপাদান। এটা কিন্তু স্বকপোলকল্পিত। সমুদ্র সৈকতে ছড়ানো-ছিটানো বিভিন্ন আকৃতির নুড়িগুলোও প্রকৃতির লেখা ইতিহাসের একেকটি উপাদান। কোনো এক সময়ে এ নুড়িগুলো পাহাড়ের পাদদেশে ঘুমন্ত ছিল। বৃষ্টির পানির ¯্রােতে সাগরে এসেই ঢেউয়ের তোড়ে তীরে ঠেকেছে। আকৃতি এবং ঔজ্জ্বল্যের বিচারে এ নুড়ি আংটিতে ঢুকে আংগুলের সৌন্দর্য বর্ধনেও ব্যবহৃত হয়।

পাহাড়-পর্বতের উপরের পাথরের টুকরা, খাল-বিল, নদ-নদী অতিক্রম করে সাগরে পতিত হয়ে সমুদ্র সৈকতে নুড়ি থেকে বালিকণায় রূপান্তরিত হয়ে চিত্তাকর্ষক সী-বিচ তৈরি করে। পাথরের টুকরার এই আত্মজীবনী উপলব্ধি করার মতো কান, মন এবং চক্ষু যথেষ্ট পরিমাণে সতেজ থাকতে হবে। এটাই প্রকৃত লিখিত ইতিহাস। আমাদের চার পাশে যত কিছু আছে, সব কিছুরই একটা বাস্তব আত্মজীবনী আমাদের ইন্দ্রিয়ানুভূতিতে প্রবেশের জন্য উদগ্রীব থাকে। এটাই প্রকৃতির রচিত গ্রন্থ।

পৃথিবীতে আদি মানব-মানবীর আবির্ভাব সম্ভবত প্রস্তর যুগে। সেই যুগে মানুষের মধ্যে চিন্তা শক্তি ছিল না বলেই তারা ছিল অথর্ব। আগুন আবিষ্কার হওয়ার সাথে সাথেই কিছুটা চিন্তা শক্তি মানুষের মধ্যে উদ্রেক হয়েছে। চিন্তা শক্তির ক্রম বিবর্তনই হলো আজকের মানব সমাজ এবং আধুনিক ডিজিটাল যুগের সূচনা। এটা স্বতঃসিদ্ধ যে, মুক্ত চিন্তা শক্তির কারণেই মানুষ আজ সকল জীব জগতের ওপর কর্তৃত্ব করে যাচ্ছে। হাতি বৃহত্তম প্রাণী। অপরিমিত শক্তির অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও একজন অতি নগণ্য শক্তির মাহুত (মানুষ) তাকে যেমন খুশি তেমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করে যাচ্ছে। এর প্রকৃত কারণ হলো মানুষ মুক্ত চিন্তার অধিকারী, আর হাতি চিন্তাহীন প্রাণী। মানুষ চিন্তাশীল বলেই জানে, কীভাবে আগুন জ¦ালে, কীভাবে চাষাবাদ করে খাদ্য উৎপাদন করা যায়, কীভাবে লজ্জা নিবারণের জন্য বস্ত্র তৈয়ার করা যায় এবং বসবাসযোগ্য গৃহ কীভাবে নির্মাণ করতে হয় ইত্যাদি। আদিকালে মানুষ যখন লিখতে শিখেছিল তখন কিন্তু কাগজ ছিল না। মানুষ তখন গাছের বাকলে লিখে রাখতো। বেশি কিছু লিখলে তালপত্রে লিখতো। এসব লেখা তখন সংরক্ষণ করা বেশ কঠিন ছিল। লেখালেখির জগতে নতুন মাত্রা এনে দিল কাগজের আবিষ্কার। এলো ছাপাখানা। সাথে সাথে বেড়ে গেল লেখা-লেখি সংরক্ষণের সু-ব্যবস্থা। কিন্তু লেখা লেখিতে সৃষ্ট বইয়ের ছাপানোর পরিমাণ তেমন উল্লেখযোগ্য ভাবে বাড়ানো গেল না।

এতক্ষণ আমরা জানলাম, সৃষ্টির সূচনায় পৃথিবী ছিল একটি উত্তপ্ত পি- বিশেষ, যার মধ্যে জীবনের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। ইহা ক্রমশঃ শীতল থেকে শীতলতর হয়ে ‘জেলী’ সদৃশ মেরুদ-হীন প্রাণীর উদ্ভব ঘটে। মেরুদ-হীন প্রাণীর জীবাশ্ম থাকে না। তাই আমরা প্রাচীনকালের ‘জেলী’ সদৃশ প্রাণীর অস্তিত্ব খুঁজে পাই না। কিন্তু আজও সাগরে বিভিন্ন আকৃতিতে পরিবর্তিত ‘জেলী’ জাতীয় মাছ পাওয়া যায়। যাহা পর্যায়ক্রমে আজকের দিনের বিভিন্ন ধরনের মাছ। যাদের দেহের বহিরাবরণ অপেক্ষাকৃত শক্ত। এ-থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, পৃথিবীতে আদি প্রাণের প্রতীক হলো জেলী সদৃশ মাছ এবং সামুদ্রিক জলজ উদ্ভিদ। চার্লস ডারউইনের মতে, জীবের বিবর্তনে মানব-মানবী আবির্ভাবের ঠিক পূর্ববর্তী প্রাণী ছিল লেজবিহীন বানর এবং শিম্পাঞ্জী। এর ধারণারও মতান্তর রয়েছে। বেদান্ত মতে, ধরাধামে যুগে যুগে আবির্ভূত দশাবতারের মধ্যে প্রথম অবতারই হলো বরাহ অবতার তথা মৎস্যাবতার। কাজেই আদিকালে পৃথিবীতে প্রাণের সূচনা সম্পর্কে ধারণা দুটি পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত।

প্রথমে এই আদি প্রাণীগুলা ছিল মেরুদ-হীন। পর বিবর্তন সম্পর্কিত বিকাশের মাধ্যমে কিছু কিছু মেরুদ-ী প্রাণীতে রূপান্তরিত হয়ে গেল। অনেকগুলো অমেরুদ-ী প্রাণী বংশ বিস্তার করতে করতে সংখ্যায় অনেক বেড়ে গেলো।

আর মেরুদ-ী প্রাণীগুলো নিত্য বিবর্তন সম্পর্কিত বিকাশের তাগিদে জলজ-স্থলজ-উভয়চর ইত্যাদি রূপে বিবর্তিত হতে হতে উন্নততম প্রাণী মানব-মানবীতে রূপান্তরিত হতে থাকে। ধর্ম বিশ^াসে এটাই স্বতঃসিদ্ধ যে, আদি মানব দম্পতি আদম ও বিবি হাওয়া, মতান্তরে মনু ও শতরূপা। সেই দম্পতি থেকেই আজকের বিশে^র এই মানব সমাজ। এই সমাজের মানহুঁশ এবং চিন্তা শক্তি আছে বলেই এরা জীবশ্রেষ্ঠ। এই তিনটি জিনিস যার মধ্যে নেই সেই নরাধম।

সেই আদি মানব কুলের ক্রমবিকাশের ফলেই আজ অতি উত্তপ্ত মরুভূমিতে, অতি শীতল মেরু অঞ্চলে, নিশীথ সূর্যের অঞ্চলে, মর্ত্যরে ভূ-স্বর্গে এবং অন্ধকারাচ্ছন্ন মহাদেশ আফ্রিকার অতি দুর্গম অঞ্চলেও মানব কুলের বসবাস। এ ধরণী এখন জনসংখ্যায় টইটম্বুর। তাই দেশ-কাল-পাত্র-আবহাওয়া ভেদে মানুষের কৃষ্টি-সংস্কৃতি এবং সামাজিকতার মধ্যে একটা মৌলিক পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।

এক সময় বিশ^¯্রষ্টার ভাবনা ছিল যে, জীব শ্রেষ্ঠ মানবের জন্য ধর্মের প্রয়োজন হবে। কারণ ধর্ম চর্চা মানুষকে নিয়মানুবর্তিতার আওতায় রাখতে পারবে। যেই ভাবনা সেই কাজ। যুগে যুগে এই সৃষ্টির মৌলিক কল্যাণের সাধনে এবং অকল্যাণ দূরীকরণের নিমিত্ত একজন করে সম্প্রদায় ভিত্তিক ধর্ম প্রবর্তক প্রেরণ করেছেন। (এর মধ্যে মতান্তর থাকতেই পারে) সকল ধর্ম প্রবর্তকের একটা সাধারণ অভিমত হলো ‘পরমতসহিষ্ণুতাই উৎকৃষ্ট তথা প্রকৃষ্ট ধর্ম’। এতে পারস্পরিক ঘৃণা-বিদ্বেষ-হিংসা প্রশমিত হয়। প্রকৃত ধর্ম চর্চা অমানুষকে মানুষে রূপান্তর করে। আর মানুষের ধর্ম চর্চা অতিমানুষ তৈরি করে, অতিমানুষের ধর্ম চর্চা মহামানব তৈরি করে যাহা মানব সমাজের অশেষ মঙ্গল করে এবং দিক দর্শক হিসেবে কাজ করে। যে ব্যক্তি মিথ্যা বলবে না, চুরি করবে না, পরের ক্ষতি করবে না, দেহে মনে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকবে, পরস্ব-হরণে বিরত থাকবে এবং জৈবিক বৃত্তিসমূহকে মানবিক মূল্যবোধের ভিতর নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হবে এমন লোকই ‘ভদ্রলোক’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত। ভদ্রলোকের ধর্মই হলো ‘মানবধর্ম’। এর প্রধান গুণ ‘মনুষ্যত্ব’ সম্পন্ন যে গুণাবলি থাকলে মানুষকে মানুষ বলা চলে আর না থাকলে মানুষ বলা চলে না-সেটার নাম মনুষ্যত্ব। এটাই তার বিশেষত্ব। মনুষ্যত্ব বিহীন মানুষে আর পশুতে কোনো পার্থক্য নেই।

প্রকৃতিতে বিরাজমান সকল বস্তুরই একটা মৌলিক ধর্ম আছে। বস্তুর এই ধর্মটা হলো ওহযবৎবহঃ য়ঁধষরঃু অর্থাৎ পানি পরিমাণ মত হলে তৃষ্ণা নিবারিত হয় আর অগ্নির দহন ক্রিয়া চলমান থাকে যতক্ষণ দাহ্য পদার্থ থাকে। কোনো কোনো পদার্থের ধর্ম তার সরবরাহের ওপর নির্ভরশীল। কোনো কোনো বন্য প্রাণীর ধর্ম তার সহজাত। কিন্তু মানব ধর্মের বিক্রিয়ক তার চিন্তা শক্তি। সৃষ্টির আদি কাল থেকে উন্নততম জীব হলো মানুষ। মানব জাতিকে শৃঙ্খলাবদ্ধ রাখার তাগিদে ধর্মের সৃষ্টি। আগে মানুষ পরে ধর্ম-তারপর ধর্মী। ‘ধর্মের জন্য মানুষ, না মানুষের জন্য ধর্ম’ এই প্রশ্নের জবাবে বলতে হয়, ‘মানুষের জন্যই ধর্ম সৃষ্টি হয়েছে’ কিন্তু ধর্মের জন্য মানুষ নয়।

যে অকৃত্রিমতা এবং মানবতার নির্যাস দিয়ে ধর্ম সৃষ্টি সেখানে ধর্ম জিতলে মানবতা ধ্বংস হয় আর মানবতা জিতলে ধর্মের সুগভীর উৎকর্ষতা জন্মে। নৈষ্ঠিক মানবতা বিজড়িত এবং গভীর শ্রদ্ধা চর্চিত একটা বিশেষ গুণ হলো ধর্ম। ধর্মে নিজস্ব কোনো অনুভূতি নেই যাতে আঘাত লাগতে পারে। তবে স্বার্থন্বেষী ধর্মীয় মহল হানাহানির কাজে ব্যবহার করে। ধর্ম নিত্য আমল করার জিনিস মাত্র।

অতীতে দুটি বিশ^যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে বিভেদের হানাহানি মনস্কতার কারণে, যার করুণ পরিণতির চিহ্ন জাপানের হিরোশিমা নাগাসাকিতে মানব সভ্যতাকে ব্যঙ্গ করছে। যে শান্তিপূর্ণ আধুনিক ডিজিটাল বিশ^ বিস্ফোরণোন্মুখ বারুদের উপর দাঁড়িয়ে আছে, তা হলো ফিলিস্তিনিদের স্বাধিকার আন্দোলন, আরব ইসরাইল হানাহানি এবং আফগানিস্তারের গীর্জা নিয়ে হানাহানির সুপ্ত জের আর ধর্মানুভূতিতে আঘাতের সুপ্ত জেরে তৃতীয় বিশ^যুদ্ধের প্রত্যক্ষ হুমকি বহন করে। ধর্মানুভূতিতে আঘাতের উছিলায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের বিষবাস্প মুক্ত ইনসামিয়াত চায় জগৎবাসী। জয় হোক মানবতার, সুন্দর হোক বাংলার প্রকৃতি।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র শিক্ষক, বলাখাল জে.এন. উচ্চ বিদ্যালয় ও কারিগরি কলেজ, হাজীগঞ্জ, চাঁদপুর।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়