প্রকাশ : ২৩ জানুয়ারি ২০২২, ০০:০০
নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীরা আবারও রাস্তায়। শুক্রবার রাজধানীর রামপুরায় তারা বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন। এ সময় হাতে লেখা বিভিন্ন স্লোগান সংবলিত পোস্টার প্রদর্শন করা হয়। শিক্ষার্থীদের হাতে লেখা পোস্টারগুলোতে ‘নিরাপদ সড়ক চাই, নিরাপদ বাংলাদেশ চাই’, ‘আমরা আছি-থাকব, যুগে যুগে লড়ব’, ‘সড়কের দুর্নীতির বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলুন, লড়াই করুন’ ইত্যাদি স্লোগান ছিল। প্রশ্ন হলো নিরাপদ সড়কের জন্য শিক্ষার্থীদের কেন বারবার মাঠে নামতে হয়?
সড়ক পরিবহন আইন কার্যকর হয়েছে এবং তা বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে ১ নভেম্বর ২০১৯ থেকে। এ আইন কার্যকর হওয়ার পর থেকে সড়কে প্রতি বছর আহত এবং নিহতের হার বাড়ছেই। আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগের অভাবে এমনটা হচ্ছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে আমাদের সড়ক মহাসড়কে ২৪ লাখ অদক্ষ ও লাইসেন্সবিহীন চালক রয়েছে। যা বিশে^ও আর কোথাও নেই। এসব অদক্ষ চালকদের দাপটে দুর্ঘটনা বাড়ছেই। লাগাম টানা যাচ্ছে না। প্রতিদিনই দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। পত্রিকান্তরে প্রকাশ, ২০২১ সালে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৫ হাজার ৩৭১টি। এতে নিহত হয়েছেন ৬ হাজার ২৮৪ জন এবং আহত ৪৬৮ জন। বিগত দুই বছরের তুলনায় এ সংখ্যাটি অনেক বেশি। শেষ বছরের দুর্ঘটনায় মানবসম্পদের যে ক্ষতি হয়েছে, তার আর্থিক মূল্য ৯ হাজার ৬৩১ কোটি টাকা। যা জিডিপির দশমিক ৩ শতাংশ। এই সময়ে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হয়েছে মোটরসাইকেল। ২ হাজার ৭৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটে এ সময়ে।
সড়ক আইন ছিল আগেও, এখনও আছে। প্রয়োগ হয় কি কখনো? নিরাপদ সড়ক হয়তো আর হবে না। অসভ্য দেশে সড়ক নিরাপদ হয় কী করে? যে দেশে সড়ক পরিবহন শ্রমিকরা আইন বাতিল করার কথা বলে আইনের লাইসেন্স পায়, আর প্রশ্রয় পায় সে দেশে সড়ক নিরাপদ হবার আশা করা মোটেও ঠিক নয়। সড়ক পরিবহন আইন বাস্তবে কতটা প্রতিফলন ঘটাবে সেটাই এখন দেখার বিষয়। মনে প্রশ্ন জাগে, আদৌ কি সড়ক আমাদের জন্য নিরাপদ হবে? থামকে কি সড়কে মৃত্যুর মিছিল?
ভাবি পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, একপ্রেসওয়ে, ফ্লাইওভার, বঙ্গবন্ধু টানেল সব কিছুই তো হচ্ছে দেশে। অসভ্য খুনে সড়ক হয়তো আদৌ নিরাপদ হবে না। এ নিয়ে মনে বড় সংশয়! কিছু কিছু ঘটনায় দেখেছি প্রধানমন্ত্রী নাড়া দিলে সব নড়েচড়ে ওঠে। তিনি দৃষ্টি দিলে সব কিছু সহজ হয়ে যায়। তিনি যখন কক্সবাজারে সমুদ্রে পা ভিজিয়ে ছিলেন তখন- “সমুদ্র জলে প্রধান মন্ত্রীর পা : পর্যটনের কিছু একটা হবে?” এই শিরোনামে কলাম লিখেছিলাম। সেখানে কিছু একটা হচ্ছে এখন। কক্সবাজারে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাজে হাত দিয়েছে সরকার। কাজ চলছে। সমুদ্রের সৌন্দর্য বর্ধনের কাজও হচ্ছে। পতেঙ্গা সীবিচ ইতোমধ্যে দর্শনীয় হয়েছে, আরও হবে। এমনি করে প্রধানমন্ত্রী সরাসরি নজর দিলে আমাদের সড়ক হয়তো নিরাপদ হবে। প্লিজ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি সড়ক নিয়ে হুঙ্কার দিন, গর্জে উঠুন। আপনার তর্জন গর্জনে আমাদের সড়ক একদিন নিরাপদ হবেই হবে।
এদেশের সড়ক নিরাপদ হওয়া কিন্তু খুব জরুরি। খুন খারাবির চেয়ে সড়কেই মানুষ মরছে বেশি। প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ মরছে, আহত হয়ে পঙ্গু হচ্ছে শত শত মানুষ। সড়কে আইন না মানা, ফিটনেসবিহীন গাড়ি, অদক্ষ এবং অবৈধ ড্রাইভার গাড়ি চালাতে গিয়ে হরহামেশাই দুর্ঘটনায় পড়ছে। সম্প্রতি উচ্চ আদালত ফিটনেসবিহীন গাড়িতে জ্বালানি সরবরাহ না করতে নির্দেশনা দিয়েছেন। আদালতের সেই নির্দেশ মানা হচ্ছে না। মোটরসাইকেলে হেলমেট না থাকলে জ্বালানি তেল না দেয়ার নির্দেশ ছিল পেট্রোল পাম্পগুলোর প্রতি। আমরা লক্ষ করেছি সে নির্দেশ মানা হচ্ছে। তাই মোটরসাইকেল আরোহীরা হেলমেট পরে গাড়ি চালাতে বাধ্য হচ্ছেন। কাজেই পরিবহনের ক্ষেত্রে ফিটনেসবিহীন গাড়িতে জ্বালানি না দেয়ার বিষয়টি মনে হয় জনস্বার্থে মেনে নেয়া দরকার এবং মেনে নিলে মানুষ উপকৃত হবে। আমাদের পরিবহনগুলো ঠিকঠাক থাকলে পরিপাটি হবে, সড়ক দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমে আসবে। আদৌ তা হবে কিনা তা ভাবছি। এর আগে সড়ক নিরাপদ না হওয়ার ব্যাপারে সাবেক নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খানকে দোষ দেয়া হতো। এখন তিনি নেই, তাহলে কার শক্তিতে পরিবহন সেক্টরে মালিক-শ্রমিকরা সড়ক আইন অমান্য করছে। এভাবে চললে আইন করে কোনো কাজেই আসবে না। আইন যেমন পাকাপোক্ত করতে হবে, আইন মানতে হবে, আইন মানাতে হবে, আইন মানতে বাধ্য করতে হবে। তবেই সড়ক নিরাপদ হবে।
আসলে আমরা বলছি অনেক; করছি কম। সব হচ্ছে, কিন্তু কিছুই হচ্ছে না আইন প্রয়োগ না হওয়ার কারণে। এদেশে কত শত রাজীবের হাত যাচ্ছে, পা যাচ্ছে, মাথা যাচ্ছে, এখলাছ উদ্দিন, ইমাম হোসেন, শারমি, মিশুক-মুনীর, সাইফুর রহমানদের জীবন যাচ্ছে। থামছেই না সড়কে মৃত্যুর মিছিল। আমরা বিশেষ দু’একজনের জন্য আহ্ উহ্ করি। প্রতিদিন কত খালিদ, কত হৃদয় পঙ্গু হচ্ছে, জীবন দিচ্ছে। তার খোঁজ কি রাখি? আমরা কেন মৃত্যুর মিছিল রোধ করছি না? কেবল আলোচিত ঘটনায় মন্ত্রী, এমপিরা ছুটে যায় স্বজন কিংবা লাশের পাশে। আমরা মায়া কান্না করি; লাভ কি তাতে?
প্রশ্ন হলো, সড়ক দুর্ঘটনা কি অলঙ্ঘনীয় ব্যাপার? এদেশে সড়ক দুর্ঘটনা হলো মৃত্যুদূত ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকার মতো। ঘর থেকে বের হয়ে আবার ঘরে ফেরা যাবে কি? এমন সংশয় বরাবরই থেকে যায়। এ প্রশ্নের ইতিবাচক জবাব পাওয়াও কঠিন বাংলাদেশে। তাই প্রতিদিন গণমাধ্যমে আমরা দেখতে পাচ্ছি সড়ক দুর্ঘটনার অসংখ্য বীভৎস ছবি, দেখতে পাই স্বজন হারানোদের আহাজারি। আমাদের সড়ক যেন এখন মরণফাঁদ। এমন কোনো দিন নেই, যেদিন অকালে প্রাণ ঝরছে না, প্রিয়জন হারানোর বেদনায় বাতাস ভারি হয়ে উঠছে না। দেশে যেভাবে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েছে, তাতে নিরাপদ সড়ক বলে আর কিছু নেই। এ অবস্থায় আজকাল আর কেউ ঘর থেকে বের হলে পৈত্রিক প্রাণটা নিয়ে ফের ঘরে ফিরতে পারবেন কিনা সে নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না।
এমন কোনো দিন নেই, যে দিন সড়ক দুর্ঘটনা হচ্ছে না। বিগত এরশাদ সরকারের আমলে সড়ক দুর্ঘটনা অস্বাভাবিক বেড়ে গেলে সরকার দুর্ঘটনা সংঘটনকারী গাড়ির চালকের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন করেন। কিন্তু পরিবহন শ্রমিকদের আন্দোলনের মুখে পড়ে তা রহিত করতে বাধ্য হয় সরকার। এরপর থেকে বিভিন্ন সরকারকে পরিবহন শ্রমিকদের দাবি দাওয়ার কাছে প্রায় জিম্মি থাকতে দেখা যাচ্ছে। এভাবে দুর্ঘটনা সংঘটনকারী চালকদের শাস্তি না হওয়া, ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন, লাইসেন্সবিহীন ও অদক্ষ চালক কর্তৃক গাড়ি চালানো, আনফিট গাড়ি রাস্তায় চালানো, সড়ক যোগাযোগে অব্যবস্থাপনা ইত্যাদি কারণে ইদানীং সড়ক দুর্ঘটনা মারাত্মকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। দুর্ঘটনার সাথে জড়িত চালকদের বিচারের কাঠগড়ায় নিয়ে আসার ঘটনা এদেশে বিরল। দেখা গেছে, প্রায় সব ক’টি দুর্ঘটনার ক্ষেত্রেই চালকরা পার পেয়ে গেছে। কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থাই নেয়া হয়নি তাদের বিরুদ্ধে।
এদেশে সড়ক দুর্ঘটনা স্বাভাবিক এবং প্রাকৃতিক নয়, তা হচ্ছে মানবসৃষ্ট কারণে। এই হিসাবে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতরা পরোক্ষভাবে হত্যারই শিকার। কিন্তু হত্যাকারীদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনার কাক্সিক্ষত উদ্যোগ নেই। ফলে সড়ক দুর্ঘটনা না কমে জ্যামিতিক হারে বেড়েই চলেছে। এরশাদ সরকারের আমলে সড়ক দুর্ঘটনা অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেলে সরকার গাড়ির চালকের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন করে। এতে চালকের দায়িত্বে অবহেলার কারণে সড়ক দুর্ঘটনায় কারো মৃত্যু ঘটলে চালককে নরহত্যার দায়ে অভিযুক্ত করার বিধান রাখা হয়। কিন্তু পরিবহন শ্রমিকদের আন্দোলনের মুখে পড়ে তা রহিত করতে বাধ্য হয় সরকার। দুর্ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটছে, ঘটবেও। কেন তা রোধ করা যাচ্ছে না? আইনের সঠিক প্রয়োগ না থাকায় দেশে দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। এসব রুখতে হবে? আমরা সড়ক দুর্ঘটনা রোধে পরিবহন মালিক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছ থেকে সমন্বিত আন্তরিক, সচেতন, দৃঢ় ও দায়িত্বশীল ভূমিকা আশা করি।
লেখক : মীর আব্দুল আলীম