প্রকাশ : ১১ জুলাই ২০২১, ০০:০০
আমার মনে হয় আঁচল কী তা আজকের বিশেষভাবে শহুরে সমাজের উচ্চবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্ত, অত্যাধুনিক, পাশ্চাত্য কৃষ্টির অনুসারী মাতা-পিতার সন্তানেরা ভালোভাবে জানে না। অবশ্য এর কারণও রয়েছে। আজকাল ঐসব পরিবারের মায়েরা আর শাড়ি পরেন না। পারিবারিক জীবনে কেবল বিশেষ অনুষ্ঠান ব্যতীত তাদের ঘরোয়া এবং পারিবারিক পরিমণ্ডলে মায়েদের শাড়ি পরতে খুব একটা দেখে না। তাদের অনেকের কাছে শাড়ি অনেকটা গ্রামীণ, অপেক্ষাকৃত দরিদ্র পরিবারের মায়ের পরিধেয় বস্ত্র। কেননা, শাড়ি ছাড়াতো তাদের বিকল্প নেই। শাড়ি তাদের জন্যেই প্রস্তুতকৃত, তাদের জন্যেই মানানসই। আর শাড়ি বা শাড়ির আঁচল অতীতের জিনিস। এজন্যে বাস্তবে আঁচল বিষয়ে তাদের অভিজ্ঞতা কম।
তবে, আবহমানকাল থেকেই গ্রামীণ সমাজে শাড়ি মায়ের অপরিহার্য আবরণ। পল্লী কবি জসীমউদ্দিনের ভাষায় শহুরে বন্ধুদের গ্রামে একটু বেড়াতে আমন্ত্রণ জানিয়ে বলি
‘তুমি যাবে ভাই যাবে মোর সাথে আমাদের ছোট গাঁয়?’
মায়ের আঁচলের বহুল ব্যবহারের সঙ্গে অপরিচিত শহুরে বন্ধুদের এবং আমাদের মতো গ্রামীণ পরিবেশে বড় হওয়া আমাদের প্রাণাধিক প্রিয়, সার্বজনীন, চিরায়ত, চিরচেনা পরম শ্রদ্ধেয় মায়ের আঁচলের দিকে একটু দৃষ্টিপাত করাতে চাই। একই সঙ্গে একটু স্মৃতি রোমন্থন করি।
আসলে মায়ের আঁচলের মূলনীতি হচ্ছে, মাকে যথাযথ, সর্বোচ্চ সম্মান ও মর্যাদা দেওয়া। মায়ের আঁচল হলো এক অনন্য বস্তু। আঁচলের মহিমা, এর বহুরূপী এবং বহুমুখী ব্যবহার সম্পর্কে সামান্য কিছু আলোকপাত করতে চাই।
মাকে আমরা দেখেছি, চুলার থেকে গরম কোনো পাত্র নামানোর সময় হাতের কাছে অন্য কোনো জিনিস নেই, মা তখন জরুরি হিসেবে আঁচল দিয়ে গরম পাত্রটি ধরে সুবিধাজনক স্থানে রাখেন। কারণ ঐ বিশেষ মুহূর্তে আঁচল অত্যন্ত কার্যকর এবং উপযোগী।
আঁচল শিশুদের ঘাম, চোখের জল মুছতে, নোংরা হাত-পা, মুখমণ্ডল পরিষ্কার করার জন্যেও ব্যবহৃত হতো, হচ্ছে। মা-ও পরম আদরে নিজ আঁচলকে সন্তানের পরিচর্যায় দ্বিধাহীনভাবে ব্যবহার করেন। আর গ্রামীণ সমাজে তোয়ালের ব্যবহার সে তো অল্পদিন আগের কথা। ফলে আঁচল তোয়ালে হিসেবে বহুল ব্যবহৃত একটি নৈমিত্তিক উপকরণ।
খাবার খেয়ে মায়ের আঁচলে মুখ মোছা, বা মা মুখটা পরিষ্কার করিয়ে দেওয়া কতো যে তৃপ্তির, কতো যে আনন্দের তা ভাষায় প্রকাশের অতীত। আহা! সেই তৃপ্তির ঢেঁকুর কখনো কি ভোলা যায়?
কখনও কখনও চোখে ব্যথা হলে, চোখে ধূলা-বালি ঢুকলে মা তার আঁচলকে গোল করে পাকিয়ে নিজে জোরে ফুঁ মেরে গরম করে চোখের উপর রাখতেন। এটা ম্যাজিকের মতো কাজ দিত। মনে হয় মুহূর্তে সমস্ত ব্যথা উধাও হয়ে যেতো। সব ডাক্তার ফেল। মা যে কতো বড় মনোবিজ্ঞানী তা কি বলার অপেক্ষা রাখে? মায়ের আঁচলের কত বড় জাদুকরি শক্তি তা ভাবাই যায় না।
প্রচণ্ড গরম। ঘুম আসে না। অপার মমতাময়ী মা নিজে ঘুম ত্যাগ করে পরম যত্ন সহকারে আঁচল দিয়ে বাতাস করেন। আহা! কী শান্তির ঘুম। বৈদ্যুতিক পাখার বিকল্প চিরায়ত রূপ শাড়ির আঁচল।
মশার যন্ত্রণায় ঘুম আসে না। আগে গ্রামে ক’জনারই মশারি ছিলো। মায়ের আঁচল ছিল কয়েল। সন্তানের ঘুম না আসা পর্যন্ত অবিরাম গতিতে চলতো আঁচলের পাখা। আর আরাম পেয়ে সে কি নাক ডাকা ঘুম। আঁচলের কতো ক্যারিমশা দেখা যেতো।
মায়ের কোল ঘুমন্ত শিশুর পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ, আরামদায়ক এবং স্বস্তির মহাস্থান। আর এক্ষেত্রে মায়ের আঁচল চাদর হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এতো আধুনিককালের এয়ারকন্ডিশনকেও হার মানায়।
কোনও অচেনা লোক বাড়িতে আসলে শিশুটি মায়ের আঁচলের একটি আড়াল নিয়ে তাকে দেখেন। শিশু কোনো বিষয়ে লজ্জাবোধ করলে সে ঐ আঁচল দিয়ে মুখটি ঢেকে রাখে এবং আঁচলের ভেতর লুকিয়ে পড়ে।
মায়ের সঙ্গে সন্তান ঘরের বাইরে গেলে মায়ের আঁচল গাইড হিসেবে কাজ করে। যতক্ষণ শিশুটির হাত মায়ের আঁচল ধরা থাকে ততক্ষণ বিশ্বজগৎ তার হাতের মুঠোয়। এ যেন নিশ্চিত নিরাপত্তার প্রতীক।
শীতকালে ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় মা সন্তানকে আঁচল দিয়ে চারপাশে জড়িয়ে শীত থেকে রক্ষা করেন, প্রয়োজনীয় উষ্ণতা দান করেন। মায়ের আঁচল আহা কী শান্তি! যেন বেহেশতের প্রশান্তি! মহান আল্লাহর অশেষ নেয়ামত।
মা তাঁর আঁচল অনেক ক্ষেত্রে পর্দা হিসেবে ব্যবহার করেন। নামাজ, ইবাদত ইত্যাদি কাজে মাথায় ব্যবহৃত আঁচল একেবারেই নিয়মিত এবং সার্বজনীন দৃশ্য। এ বিষয়টি আমাদের কাছে চিরচেনা। অপরিচিত, অচেনা মানুষের সঙ্গে সরাসরি দেখা না দিয়ে মুখখানি আঁচল দিয়ে ঢেকে কথা বলেন। আঁচল ব্যবহার করে মিষ্টি-মধুর বকুনি দেন। আবার শোক, দুঃখ, যাতনা আঁচল দিয়ে ঢেকে প্রকাশ করেন। বহুল পঠিত যতীন্দ্রনাথ বাগচীর ‘কাজলা দিদি’ কবিতার সেই কলি স্মরণযোগ্য
‘সেদিন হতে কেন মা আর দিদিরে না ঢাকো ;
দিদির কথায় আঁচল দিয়ে মুখটি কেন ঢাকো?’
আঁচলের বহুমুখী ব্যবহারের মধ্যে আধুনিককালের এপ্রোনও একটি। মায়ের হাতের রান্না খায়নি এমন লোক পৃথিবীতে পাওয়া দুষ্কর। তবে, আমাদের মতো সাধারণ ঘরে মায়ের আঁচলই রান্না ঘরের এপ্রোন।
রান্না, গৃহস্থালি সংক্রান্ত সকল ধরনের কাজতো মা-ই করছেন কাক-ডাকা ভোর হতে গভীর রাত পর্যন্ত। আর যন্ত্রের মতো অবিরাম, অন্তহীন এ কাজের সময় মা আঁচলটি মাজায় শক্ত করে বেঁধে নেন। এই বন্ধন তাঁকে অফুরন্ত শক্তি যোগায়।
মায়ের কাছে মালামাল বহনযোগ্য কোনো বস্তু বা উপকরণ নেই। তাতে কী? গাছ থেকে পড়া আম, জাম, খেজুর, ফল-মূল, ফুল, শাক-সবজি ইত্যাদি কুড়িয়ে আনতে আঁচলের ব্যবহার গ্রামীণ সমাজের অতি পরিচিত একটি চিত্র। ঘরে রাখা জিনিস থেকে ধূলা-বালি মুছে ফেলতেও এটির ব্যবহার সদাসর্বদা দৃশ্যমান।
মায়ের আঁচলে একটি গিট্টু মানি একটি চলন্ত ব্যাংক। অল্প কিছু টাকা-পয়সার আঁধার হচ্ছে ঐ গিট্টুটি। বায়না ধরলে প্রথমে না করলেও মমতাময়ী মা ব্যাংকটি খুলে সন্তানের হাতে গুঁজিয়ে দিতেন, দেন। তাছাড়া, মা বেড়াতে গেলে বা কেউ বেড়াতে আসলে পরম মমতায় আঁচল খুলে চুপেচাপে অতিথির হাত ভরে দান করেন। অবশ্য মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নের ফলে আঁচল টাকা-পয়সা ছাড়াও চাবির গোছা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। মা কাউকে আঁচল দিয়ে মুছে দেন। পরম মমতায় ভরা এই মুছে দেয়া পরম তৃপ্তি, ভক্তি আর শ্রদ্ধার আধার হিসেবে কাজ করে। এই আঁচলের স্পর্শ মৃত সঞ্জিবনী সুধা এবং টনিকের মতো কাজ করে। আমাদের সার্বজনীন বিশ্বাস, মায়ের আঁচলের ছোঁয়ায় সব রোগ-বালাই দূরীভূত, ভূত-প্রেত পর্যন্ত দূর দূর করে পালায়।
মায়ের আঁচল এক মায়াবী অনুভূতি ছাড়া আর কিছুই নয়। আমরা চিরকাল বয়ে যাওয়া সমাজ, সংস্কৃতির অনুসারী, পুরানো প্রজন্মের সাধারণ মানুষ। আমরা সদা-সর্বদা, জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে, প্রতিটি ক্ষেত্রে, সুখে-দুঃখে মায়ের ভালবাসা এবং স্নেহ অনুভব করি। মায়ের আঁচলের প্রশান্তির ঝর্ণাধারায় অবগাহন করে হৃদয় সিক্ত করি।
মা, মা, মা আহা! কী জাদুকরি শক্তি এই অতি ছোট একটি শব্দের মধ্যে। পৃথিবীর সকল শান্তির উৎস। মা আর মায়ের আঁচল অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। সেই মায়ের আঁচল সম্পর্কে পরম অনুভূতি অনুভব এবং উপলব্ধি করা আজকের কোনো কোনো প্রজন্মের ধারণাতীত এবং চিন্তাশক্তি রহিত।
বিজ্ঞানের কাড়িকাড়ি উন্নতির পরও মায়ের আঁচলের বিকল্প খুঁজে বের করা সত্যি অনেক কঠিন। সেজন্যে আবহমানকাল থেকে বিশেষভাবে বাংলাদেশ এবং উত্তর ভারতে মায়ের আঁচল চিরন্তন, অপরাজেয়, বিকল্পহীন।
লেখক : মোঃ মাকছুদুর রহমান পাটওয়ারী, সিনিয়র সচিব (পিআরএল), ভূমি মন্ত্রণালয়।