প্রকাশ : ১৬ ডিসেম্বর ২০২১, ০০:০০
সবুজের জমিনে রক্তিম সূর্যখচিত মানচিত্রের দেশটি এবার বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপন করছে। বহু ত্যাগ, শত বাধা পেরিয়ে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্ণ করে সৃষ্টি করেছে সংগ্রামী ইতিহাসের নতুন অধ্যায়, রচিত করেছে লাল-সবুজের নতুন গল্প, দিচ্ছে বাংলাদেশের মানুষের জীবনে নতুন উদ্দীপনার জোয়ার। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত থেকে পাকহানাদার বাহিনীর কালো থাবায় নিহত হয়েছিল অগণিত মানুষ, সম্ভ্রম হারিয়েছিলো বহু নারী, পৃথিবীর আলো না দেখেই বিদায় নিয়েছে বহু শিশু, যা দেখে হতবাক হয়েছিলো পুরো বিশ^। সেদিন শান্তিপ্রিয় বাঙালির ওপর পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর অতর্কিত হামলার প্রেক্ষিতে বাঙালির স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে অস্ত্র হাতে যুদ্ধে নেমেছিল বাংলার সর্বস্তরের মানুষ। জীবনের প্রতি মায়া, পরিবারের প্রতি ভালোবাসা, সম্পদের প্রতি আকাক্সক্ষা ছুড়ে ফেলে দিয়ে শোষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে মাতৃভূমি ও মায়ের সম্ভ্রমকে রক্ষা করতে দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম চালিয়ে বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল বাঙালি নওজোয়ানেরা। অর্জিত বিজয়ের বিনিময়ে দিতে হয়েছিল লাখো নারী-পুরুষের জীবন এমনকি সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুর প্রাণটিও।
কী অপরাধ ছিলো সেদিন বাঙালির? কেন নির্বিচারে বাঙালির ওপর চালানো হয়েছিল ইতিহাসের বর্বরোচিত এই গণহত্যা? একটি জাতির ন্যায্য অধিকার আদায়ের দাবির প্রতিদানই কি এমন নৃশংস হামলা? অথচ দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে সম্প্রদায়ের ভাই হিসেবে বুকে টেনে নিয়েছিলো বাঙালিকে। আমরা তো পশ্চিম পাকিস্তান থেকে কিছু চাইনি, শুধু চেয়েছিলাম নিজস্ব ভূমিতে বেঁচে থাকার অধিকার। কিন্তু পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী আমাদের বেঁচে থাকার অধিকারকেও গলা টিপে হত্যা করেছে। নিজ জন্মভূমিতে মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার, নিজ ভূমিতে কষ্ট করে উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য হিস্যা, আর বাকস্বাধীনতার অধিকারটুকুই তো আমরা চেয়েছিলাম। এই সত্তাগত অধিকারগুলো তো চাওয়ার নয় বরং রাষ্ট্র নামক ব্যবস্থার প্রথম দায়িত্বই হলো তার জনগণের মৌলিক এই অধিকারগুলো নিশ্চিত করা। বাঙালির এসব মৌলিক অধিকার চাওয়াই যদি অপরাধ হয় তাহলে পৃথিবীর সকল জাতিই তো অপরাধী! কারণ এই মৌলিক অধিকারগুলো ছাড়া তো পৃথিবী নামক গৃহে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। অথচ পাকিস্তানী শাসকরা সেটাও হরণ করতে চেয়েছিল। তাই আমরাও তাদেরকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছি অন্যায় ও জুলুমের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারি এবং কোনো অপশক্তি আমাদেরকে দাবায় রাখতে পারবে না। বাঙালি তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীদের দাঁতভাঙা জবাব দিয়েছে এবং ভবিষ্যতেও কেউ কোনো ষড়যন্ত্র করলে তাকেও সমুচিত জবাব দিতে কার্পণ্য করবে না।
আমরা একাত্তরের মুক্তির সংগ্রামে সফল হওয়ার সাথে বিস্তৃত ক্ষুধাকেও জয় করেছি, এখন আমাদের জীবন মান উন্নতি, দারিদ্র্য বিমোচন এবং বিশ^সভায় মর্যাদার আসন লাভ করার সংগ্রামের সাফল্য চাই। আমরা উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে পদার্পণ করে আবারও প্রমাণ করেছি আমরা সংগ্রামী এবং সংগ্রাম করতেই পছন্দ করি। বাংলার মানুষ নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনে প্রতিনিয়ত পরিশ্রম করে যাচ্ছে। এদেশের মাটি ও মানুষের সাথে মিশে আছে ¯্রষ্টাপ্রদত্ত অপার সম্ভাবনার শক্তি। একাত্তরে কোথায় ছিলাম, আজ আমরা কোথায় এসেছি। আমাদেরকেই তো বলা হয়েছিল তলাবিহীন ঝুড়ি। অথচ আজ এই তলাবিহীন ঝুড়িটাই বিশ^ অর্থনীতির সম্ভাবনার দুয়ার। স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণের মাধ্যমে আমরা যে সক্ষমতা দেখিয়েছি তা বিশে^র দরবারে বাংলাদেশের মাথা উঁচু করে দিয়েছে। শত কটুক্তি উপেক্ষা করে উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় আসতে আমাদের প্রয়োজন ছিল প্রবল আত্মশক্তি। দেশপ্রেমের আত্মশক্তিতে বলীয়ান ছিলাম বলেই মাত্র নয় মাসেই লাল সবুজের পতাকা বিশে^র দরবারে উড়িয়েছি এবং বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীতে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে পদার্পণ করেছি। একাত্তরের স্বাধীনতা আমাদেরকে শিখিয়েছে অন্যায় ও জুলুমের কাছে মাথা নত না করে প্রতিবাদী বজ্রকণ্ঠে তুলে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে। একাত্তরের হার না মানা ইতিহাস বাঙালির শক্তি ও এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা। তাই বাঙালিকে নিয়ে কেউ কোনো ষড়যন্ত্র করলে তাকে আগে চোখ বুলাতে হবে একাত্তরের দিকে। আমাদের হয়তো বিশাল অস্ত্র ভা-ার নেই, তবে আছে অদম্য মানসিক শক্তি। যে শক্তির কাছে হার মানতেই হবে যেকোনো পরাশক্তিকে। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, যে জাতির কাছে এই মানসিক শক্তি ছিলো তাদের সামনেই মাথা নোয়াতে হয়েছিল বহু সম্রাজ্যবাদী পরাশক্তিকে। আমরা বাঙালিরা কখনো কারো অধিকার হরণ করিনি। বরং সবাই আমাদের নৈতিক চেতনার নীতিকে দুর্বলতা মনে করে আমাদের ওপর শোষণের বিস্তার ঘটাতে চেয়েছিলো। কিন্তু আমরাও কাউকে ছাড় দেইনি। আমাদের ওপর অর্পিত শোষণ এবং আমাদের করা সংগ্রামের ইতিহাসকে নতুন প্রজন্মের কাছে অদম্য শক্তি হিসেবে তুলে ধরতে হবে। তাহলেই সংরক্ষিত থাকবে লাখো শহীদের তাজা রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা। এখনও বাংলার সোনালী জমিনের দিকে বিদেশি ঈগলের চোখগুলো আড়ি পেতে আছে। আমাদের এই উন্নতির অগ্রযাত্রা ও শান্তিপূর্ণ বসবাস তাদের অন্তরে জ্বালা সৃষ্টি করছে। তাই আমাদের সার্বভৌমত্ব স্বাধীনতার সুরক্ষার প্রাচীর আমাদেরকেই ঐক্যবদ্ধ থেকে রক্ষা করতে হবে। গণতন্ত্রের মুক্ত চর্চার ফলে বাঙালি হয়তো নানা দলে-উপদলে ভাগ হয়ে আছে। কিন্তু মাতৃভূমির সার্বভৌমত্ব বিন্দুমাত্র ক্ষুণœ হলে বাঙালি আবারও দলমত-নির্বিশেষে একযোগে দেশমাতৃকার স্বার্থে একাত্তরের মত গর্জে উঠবে। মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের জীবনের বিনিময়ে আমাদের জন্য রেখে গেছেন সবুজে আঁকা স্বাধীন বাংলা। এই স্বাধীনতার স্বাদ তখনই পাবো আমরা যখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বুকে ধারণ করে দেশকে, দেশের মানুষকে ভালোবাসবো এবং দেশের কল্যাণে কাজ করে যাবো। সার্থক বাঙালি হিসেবে বিশ্বের বুকে তখনই মাথা উঁচু করে চলতে পারবো যখন মাতৃভূমির মর্যাদা সমুন্নত রাখতে পারবো। বাংলাদেশের মানুষ বিজয়ের স্বাদ আস্বাদন করেছে, তার সুফলও প্রতিনিয়ত লাভ করছে। এই অগ্রযাত্রাকে অব্যাহত রাখতে চাইলে একাত্তরের স্বাধীনতা অর্জনকে আত্মশক্তি হিসেবে লালন করতে হবে।
লেখক : মোঃ মুরাদ হোসেন, শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয় ও সাংগঠনিক সম্পাদক, চাঁদপুর জেলা স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন, চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়। ইমেইল : সঁৎধফযড়ংযবহ৬৪০@মসধরষ.পড়স