প্রকাশ : ২০ জুলাই ২০২৩, ০০:০০
সমাজে হাজারো রাব্বি, তবুও---

মনুষ্য সমাজে অকালে বাপ হারানো, মা হারানো কিংবা বাপ ও মা উভয়কে অকালে হারানো কত শিশু যে রয়েছে, সেটা দেখার জন্যে আমাদের বাংলাদেশে রেল স্টেশন ও লঞ্চঘাটসহ মাদ্রাসা ও এতিমখানায় গেলেই যথেষ্ট। এছাড়া আরো অনেক জায়গায় খুঁজে পাওয়া যায় অনেক শিশুকে। বিভিন্ন বাসা-বাড়িতে কাজের লোক হিসেবেও খুঁজে পাওয়া যায় এতিম শিশুদের। এতিমখানা/ মাদ্রাসায় যে সকল শিশু আশ্রিত, তারা তো মোটামুটি ভালো পরিবেশেই থাকে। আর যারা ভবঘুরে কিংবা ভাসমান হিসেবে থাকে, বিভিন্ন বাসা-বাড়িতে কাজের লোক হিসেবে থাকে, তারা কম-বেশি নানা নিগ্রহের শিকার হয়। যে সকল এতিম শিশু সৎমা কিংবা সৎ বাবার সংসারে থাকে, তাদের স্বল্পসংখ্যকই ভালো থাকে, আর বাকিরা অবহেলা, অযত্ন সহ নির্যাতনের শিকার হয়। এমতাবস্থায় এরা কোথাও না কোথাও শিশু শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ পায় এবং কষ্টকর শ্রমনির্ভর জীবনে নিপতিত হয়। সৎবাবার সংসার থেকে ছিটকে পড়ে মায়ের স্নেহবঞ্চিত হওয়া এমন এক শিশু শ্রমিক হচ্ছে রাব্বি। সে তার মায়ের বর্তমান অবস্থান থেকে শতাধিক কিলোমিটার দূরে বয় হিসেবে কাজ পায় রাজধানীর চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট হাসপাতালের কেন্টিনে। সৌভাগ্যক্রমে সেখানে সে প্রধানমন্ত্রীর নজরে এসে গত রোববার ফিরতে পেরেছে তার মায়ের কোলে। এমন সৌভাগ্যের শিকার হওয়া এতিম শিশুর সংখ্যা একেবারে বিরল।
রাব্বি সরকারি একটি গাড়িত করে গত রোববার রাত সোয়া ৯টায় চাঁদপুর সদর উপজেলার লক্ষ্মীপুর মডেল ইউনিয়নের রামদাসদী আশ্রয়ণ প্রকল্পে তার মায়ের আশ্রিত ঘরে পৌঁছায়। এ সময় তার সাথে তার সৎ বাবা ও বোন জামাই ছিলেন। এলাকাবাসী জানায়, রাব্বি দীর্ঘ দেড়মাস পর মাকে দেখে জড়িয়ে ধরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। খবর পেয়ে রামদাসদী আশ্রয়ণ প্রকল্পে বসবাসরত অধিকাংশ নারী-পুরুষ ও শিশু ছুটে আসেন রাব্বিকে এক নজর দেখতে। এতে খুশিতে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন রাব্বির পরিবারের লোকজনসহ এলাকাবাসী। রাব্বির মা রাবেয়া আক্তার বলেন, রাব্বির যখন এক বছর বয়স তখন আমরা চাঁদপুর শহরের পুরাণবাজারের ছিলাম। আমার প্রথম স্বামী রাব্বির বাবা তখন মারা যান। মা-বাবা, ভাই-বোন ও স্বামী হারানোর পর পেটের দায়ে শিশু ছেলে রাব্বি ও দশ বছর বয়সী মেয়ে সোনিয়া আক্তার কেয়ার খাবার জোগাতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাজ করি। কখনো কখনো পুরাণবাজারে সুতার মিলেও কাজ করি। এভাবে কয়েক বছর যাবার পর বাধ্য হয়ে আবার বিয়ে বসি দিনমজুর জাহাঙ্গীর আলমের সাথে। তার সাথে পুরাণবাজার থেকে চলে আসি রামদাসদী আশ্রয়ণ প্রকল্পে। সেখানে নিকটাত্মীয়ের এই ঘরে ওই ঘরে প্রায় দুই বছর ধরে আশ্রয় নিয়ে আছি। বর্তমানে তফুরা বেগম নামে একজনকে বোন ডেকে তার ঘরে আশ্রিত আছি। সেখানে মাসে শুধু ২শ’ টাকা বিদ্যুৎ বিল দিয়ে থাকি। এসব কারণে ছেলেমেয়েকে লেখাপড়া করাতে পারিনি। নিরূপায় হয়ে মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দেই। ছেলে রাব্বি গ্রামের একটি স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়লেও সংসারের হাল ধরতে এলাকায় নানা কাজে লেগে যায়। তার বয়স এখন প্রায় ১৩ বছর। গত প্রায় দেড়মাস আগে তার বোনজামাই রাব্বিকে ৩ হাজার টাকা বেতনে ঢাকার চক্ষুবিজ্ঞান হাসপাতালে ক্যান্টিন বয় হিসেবে কাজ জোগাড় করে দেয়। আর সেখানেই আমার ছেলে রাব্বি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেখে সে তার নানীর মতো দেখাচ্ছিল মনে করে কাছে যেতে চায়। এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নজরে আসে রাব্বি। আর তখনই আল্লাহর পক্ষ থেকে রাব্বির জীবনে যেন সুখবর বয়ে আসে। কিন্তু আমার ঘর নেই, বাড়ি নেই, জমি নেই। এই রাব্বিকে নিয়ে আমরা কোথায় থাকবো, কীভাবে থাকবো জানি না। তারপরও আমি চাই প্রধানমন্ত্রী আমার ছেলের ভবিষ্যৎটা গড়ে দিবেন।
শনিবার ঢাকার চক্ষুবিজ্ঞান হাসপাতালে ১০ টাকায় টিকেট কেটে সাধারণ রোগীদের সাথে চোখ দেখাতে গিয়ে চাঁদপুরের রাব্বির দিকে নজর পড়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। আর তখনই প্রধানমন্ত্রী নিজে ছুটে যান রাব্বির কাছে। সবার উপস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী রাব্বির খোঁজ খবর নেন। সাথে সাথেই প্রধানমন্ত্রী রাব্বির পড়াশোনাসহ সব দায়িত্ব নিয়ে চাঁদপুরে পাঠিয়ে দেন। এ বিষয়ে চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক কামরুল হাসান বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে আমরা রাব্বির বাড়ি-ঘরের খোঁজ খবর নেই। এখন প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা আসলেই যা যা করণীয় তা করা হবে। গত সোমবার সকালে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নগদ অর্থ সহায়তা ও দৈনন্দিন খাদ্য সামগ্রী হিসেবে চাল, ডাল, তেল লবণসহ অন্যান্য সামগ্রী তুলে দেয়া হয়।
প্রধানমন্ত্রী মায়ের মমত্ববোধ ও সংবেদনশীলতা থেকেই শিশু শ্রমিক রাব্বির পাশে দাঁড়িয়েছেন। শিশু রাব্বিকে তিনি সরকারি শিশু পরিবারে পাঠিয়ে দায়িত্ব শেষ করতে পারতেন। কিন্তু মায়ের কাছে যাবার আকুলতার কারণেই রাব্বিকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শিশু পরিবারে না পাঠিয়ে মায়ের কাছে পাঠানোর নির্দেশ দিয়ে ও তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিয়ে তাকে গড়ে তুলবার সামগ্রিক দায়িত্ব নিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর এমন মমত্ববোধ ও সংবেদনশীলতা থেকে আমাদের সমাজের সামর্থ্যবানদের অবশ্যই শেখার আছে। তারাও এমন অনেক রাব্বিকে খুঁজে বের করে দায়িত্ব নিলে এতিম শিশুদের বাবা/মা হারানোর কষ্ট লাঘব হবে এবং সমাজের অন্যান্য শিশুর সাথে সমানতালে বেড়ে ওঠার সুযোগ তৈরি হবে।