প্রকাশ : ১৭ মার্চ ২০২৩, ০০:০০

সন্তান জন্ম দিয়ে জননী ধন্য হন। কিন্তু সব জন্ম পৃথিবীর জন্যে স্মরণীয় হয়ে ওঠে না। মানুষের অনুকরণীয় কর্ম ও মানবকল্যাণমুখর জীবন-সংগ্রাম জন্মকে স্মরণীয় করে তোলে। অগণন মানুষের পৃথিবীর ইতিহাসে হাতেগোনা কিছু মানুষের জন্মে ধন্য হয়ে উঠেছে সমগ্র চরাচর। এই বিরল জন্মের একজন হলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর জন্মের আগে ১৯২০ সাল নিয়ে মানুষের তেমন কোন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠার পর ধীরে ধীরে ১৯২০ সাল উঠে এলো পাদণ্ডপ্রদীপের আলোয়। শোষিত মানুষের মুক্তির ইতিহাসে ১৯২০ সালও যেন জন্ম লাভ করেছে শেখ মুজিবের জন্মের সাথে সাথে।
বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মের আগে কেউ সার্থক ও সফলভাবে বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে পারেননি।
তৎকালীন ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার সবচেয়ে শেষের ইউনিয়নের নাম পাটগাতী। এই ইউনিয়নের কোল ঘেঁষে বয়ে যাওয়া নদী বাইগার যা অনতিদূরে মধুমতীতে মিলেছে। এরই তীরে গড়ে ওঠা গ্রাম টুঙ্গীপাড়া, ছায়াঢাকা-মায়াঘেরা প্রশান্তপল্লি। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ বড় তিনবোনের পথ ধরে জননী সায়েরার কোল আলো করেই জন্ম নিলেন খোকা, যিনি নানার নামকরণে হয়ে ওঠেন শেখ মুজিবুর রহমান। নিজের চরিত্রগুণে মা-বাবার খোকাই হয়ে ওঠে গ্রামের সকলের মিয়াভাই। টুঙ্গীপাড়ার এই মিয়াভাইকেই কুশলী সময় গড়ে তোলে জগতজুড়ে বঙ্গবন্ধু হিসেবে। জন্মশতবছরের উৎসবে জাতিসংঘ নিজেই বঙ্গবন্ধুকে ‘বিশ্ববন্ধু’ খেতাব দিয়ে নিজেদের যুক্ত করে রাখে ইতিহাসের এই প্রাতঃস্মরণীয় মহান মানুষটির সাথে।
পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম স্রষ্টা এই মানুষটির জীবন কেটেছে মূলত তিনটি ক্ষেত্রে। প্রথমত সংগ্রামমুখর রাজপথে, দ্বিতীয়ত কারাগারের বন্দিশালায় আর তৃতীয়ত মানুষের হৃদয়ে। মাত্র পঞ্চান্ন বছরের জীবনের ব্যাপ্তিতে তিনি নিজের ব্যক্তিত্বগুণে ছাড়িয়ে গিয়েছেন পৃথিবীর সবশ্রেষ্ঠ পর্বতমালা হিমালয়কেও। কারাগারে যাপন করা চার হাজার ছয়শ বিরাশি দিনের রোজনামচা আজ পরিণত হয়েছে বিশ্ববাসীর আদর্শিক গ্রন্থরূপে।
শেখ মুজিবের পাঠের প্রবণতা যেমন অপ্রতিরোধ্য, তেমনি তাঁর পাঠের রুচি ও ক্ষুধাও অনন্য। এই পাঠ ও জ্ঞানাহরণের অদম্যতাই তাঁকে করে তুলেছে অন্য অনেকের চেয়ে মহীয়ান।
প্রতিবাদী বঙ্গবন্ধু পৃথিবীর জন্যে অদ্বিতীয়। শোষিত মানুষের লাঞ্ছনা-বঞ্চনাকে নিজের জীবনের দুর্বহ বেদনা হিসেবে নিয়ে তিনি তাদের মুখে হাসি ফুটিয়ে গেছেন নিজের প্রাণের বিসর্জনে। মায়ের ভাষার মান রক্ষা থেকে শুরু করে ছাত্রাবাসের ছাত্রদের জীবন-মানের নিরাপত্তায় তিনি ছিলেন বিনিদ্র সেনাপতি। দক্ষিণবঙ্গের ধানকাটার দাওয়াল-শ্রমিক থেকে শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী প্রমুখ সকলের ন্যায্য দাবি আদায়ে প্রতিবাদমুখর হয়ে তিনি তুচ্ছ করেছেন নিজের জীবনের সুখণ্ডস্বাচ্ছন্দ্য। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কারসাজিতে অপরাজনৈতিক ভোগান্তিতে তিনি ফাঁসির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেও অটল ছিলেন নিজের দেশের মানুষের অধিকার আদায়ে। নয়মাসের দীর্ঘ মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তাঁর জীবন ছিল পৃথিবীর মানুষের অবহিতির অতীত। কোন্ কারায় তাঁকে আটক রেখেছে পশ্চিম পাকিস্তানের শোষকগোষ্ঠী, আদৌ মুজিব বেঁচে আছেন কি না, তা ছিল বিশ্ববাসীর কাছে মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন। ঊনিশশো বাহাত্তরের দশ জানুয়ারি তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনই আমাদের জানিয়ে দিলো, যে দীপ জ্বলে উঠেছে মানুষের মুক্তির জন্যে, তাকে নির্বাপণ করার সামর্থ্য সামরিক জান্তার নেই।
স্বদেশকে উন্নয়নের ধারায় এগিয়ে নিতে মুজিব স্বপ্ন দেখেছিলেন দ্বিতীয় বিপ্লবের। কিন্তু পরাজিত শক্তির স্বদেশীয় দোসরদের কাপুরুষোচিত রাত-গভীরের ষড়যন্ত্রে মুজিবের দেহ নিথর হয়ে যায়, সিঁড়ির রক্ত-শয্যায় মুজিব হয়ে ওঠে পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম বিয়োগান্তকাব্যের মহানায়ক। শৈশবে বেরিবেরি-গ্লুকোমা কিংবা নৌকাডুবির আশঙ্কা তাঁর প্রাণ হরণ করতে পারেনি। প্রাণ হরণ করতে পারেনি পশ্চিম পাকিস্তানি হায়েনারাও। কিন্তু স্বদেশি শ্বাপদের হাতে তাঁর রক্তাক্ত প্রস্থান বিশ্ববাসীকে হতবাক করে দেয়। একটা হত্যাকান্ড সমগ্র জাতির ললাটে এঁকে দেয় কলঙ্ক-তিলক।
ছ'ফুটের অধিক উচ্চতার হিমালয়প্রতিম ব্যক্তিত্ব্যের মানুষটা দেহান্তরিত হলেও সারাবিশ্বে মুজিব আজ বহুল পঠিত ও চর্চিত নক্ষত্রের অন্যতম, যাঁর আদর্শের জ্যোতির্ময়তায় পৃথিবী আজ স্বপ্ন দেখে মানুষের মুক্তি ও কল্যাণের। আজ জাতির পিতার একশ তিনতম জন্মবার্ষিকে আমরা বিনম্র চিত্তে তাঁকে স্মরণ করি, শ্রদ্ধা জানাই। অনাগত প্রজন্মে তাঁর আদর্শ ও স্বপ্নের প্রতিফলন ঘটুক, এই কামনা করি নিরন্তর। মুজিব ছিল, মুজিব আছে, মুজিব থাকবে ইতিহাসের অমর ও অজর দীক্ষাগুরুরূপে। মানুষের দুঃখ-বেদনার আগল খুলে জ্যোতির্ময় আজ অবতীর্ণ হয়েছে শোষিতের ত্রাতা হয়ে, আলোর ঝলকানি নিয়ে।