প্রকাশ : ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০০:০০

মৃত্যুর এমন পরম্পরাকে চাঁদপুরের সাংবাদিক সমাজ মেনে নিতে পারছে না। এই তো সেদিন (৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২) চাঁদপুরের সর্বজনশ্রদ্ধেয় প্রবীণ সাংবাদিক শঙ্কর চন্দ্র দে (৭৮) চিরবিদায় নিলেন। মাত্র ৩ দিনের ব্যবধানে গত ৬ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাতে প্রবীণ সাংবাদিক মিয়া মুহম্মদ আব্দুল খালেক (৮০) যেনো তাঁর অনুগামী হলেন। নিঃসন্দেহে তাঁদের মৃত্যুর কারণ বার্ধক্যজনিত রোগ। তবু এতো কাছাকাছি দুটি মৃত্যু অপ্রত্যাশিত ও কষ্টকর। চাঁদপুরের মাঠে-ময়দানে বর্তমানে সক্রিয়ভাবে কর্মরত সাংবাদিকরা অনুপ্রেরণা আহরণের প্রয়োজনে চাইলেই বয়োজ্যেষ্ঠ হিসেবে তাদের ‘শঙ্কর দা’ ও ‘খালেক ভাই’কে আর খুঁজে পাবে না। ক্রমশ মুরব্বি শূন্য হওয়ার হাত থেকে মহান সৃষ্টিকর্তা যেনো চাঁদপুরের সাংবাদিকদের রক্ষা করেন-সেটাই এখন তাদের আকুল প্রার্থনা।
‘শঙ্কর দা’র মতো ‘খালেক ভাই’ও মেঘনার ভাঙ্গনে বিপন্ন একজন মানুষ। পৈত্রিক সম্পদের জোরে নয়, নিজেদের উচ্চ শিক্ষার জোরে উপযুক্ত পেশায় নিজেদের নিয়োজিত করেছেন। তাঁরা উভয়েই পরাধীন পাকিস্তান আমলে ¯œাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ‘শঙ্কর দা’ জুট মিলে লেবার অফিসার হলেও ‘খালেক ভাই’ শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেন এবং মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ইংরেজি বিষয়ের দক্ষ শিক্ষক হিসেবে নিজের পরিচিতি তুলে ধরেন। পাশাপাশি সাংবাদিকতাকে স্বাধীন মত প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে বেছে নেন। ‘শঙ্কর দা’ সাংবাদিকতায় ঝুঁকি না নিলেও ‘খালেক ভাই’ সেটি নেন এবং নিরাপোষ মানসিকতায় সাহসিকতার সাথে অন্যায় অনিয়মের বিরুদ্ধে কলম ধরেন, অনেকটা প্রতিবাদী ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। তাঁর স্পষ্ট ভাষণ ও লিখন ছিলো আলোড়ন সৃষ্টিকারী।
স্বাধীনতা পূর্বকালে ষাটের দশকের শুরুতে স্থানীয় সংবাদ ও স্থানীয় লেখকদের লেখায় সমৃদ্ধ হয়ে পাক্ষিক একটি সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়, যার নাম ‘অন্যগ্রাম’। এটি তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক সালাউদ্দিন আহমেদ (০৯/১১/১৯৫৯-০৬/৩/১৯৬১)-এর উদ্যোগে মহকুমা জনসংযোগ অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত হতো। এটির সম্পাদক ছিলেন প্রথমে নাজিম সেলিম ও পরবর্তীকালে হাসান ইমাম। এই ‘অন্যগ্রামে’ লিখেই সাংবাদিকতায় প্রবেশ করেন ‘খালেক ভাই’। ১৯৬৯ সালে পূর্ব পাকিস্তানে গণঅভ্যুত্থানের মুখে পাকিস্তানের এগার বছরের সেনা শাসক আইয়ুব খানের পতনের সাথে সাথে ‘অন্যগ্রামে’র প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়। এমতাবস্থায় ৫-৬ বছর চাঁদপুরে ছিলো না কোনো সংবাদপত্র। এ অভাবটুকু পূরণে এগিয়ে আসেন ‘খালেক ভাই’। তিনি ১৯৭৪ সালে প্রকাশ করেন সাপ্তাহিক চাঁদপুর বার্তা। দীর্ঘ এক যুগ ধরে তিনি এ পত্রিকাটির ধারাবাহিক প্রকাশনা টিকিয়ে রাখেন। অন্যায়-অনিয়মের বিরুদ্ধে লিখে তিনি প্রভাবশালীদের রোষানলে পড়েন এবং তাদের চাপে ১৯৮৬ সালে চাঁদপুরের দ্বিতীয় জেলা প্রশাসক এসএম শামসুল আলম পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধ করে দেন। ‘খালেক ভাই’ অনেকটা অভিমান করেই ‘সাপ্তাহিক চাঁদপুর বার্তা’ পুনঃপ্রকাশের আর উদ্যোগ নেননি। তবে ‘চাঁদপুর বার্তা’ এখন অন্য প্রকাশক ও সম্পাদকের মাধ্যমে দৈনিক হিসেবে প্রকাশিত হচ্ছে।
স্বাধীনতোত্তর চাঁদপুরবাসীকে স্থানীয় সংবাাদের স্বাদ পাইয়ে দিতে ‘খালেক ভাই’ সাপ্তাহিক চাঁদপুর বার্তা প্রকাশের যে কষ্টকর ও সাহসী উদ্যোগ নিয়েছেন এবং যুগব্যাপী সেটির প্রকাশনা ধরে রেখে চাঁদপুরের সংবাদপত্রের ইতিহাসে যে অধ্যায় সৃষ্টি করে গেছেন, সেটি কোনোভাবেই মুছে ফেলার মতো নয়। সেজন্যে ইতিহাসের পাতায় তাঁর অধিষ্ঠান সম্মানজনক। আমরা তাঁর মৃত্যুতে চাঁদপুর জেলাবাসীর পক্ষে গভীর শোক প্রকাশ করছি এবং তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনাপূর্বক শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জানাচ্ছি।