প্রকাশ : ০৫ জুলাই ২০২১, ০০:০০
বীরাঙ্গনা : নারী-জাগৃতির প্রথম দ্রোহ
বাংলা সাহিত্যের প্রথম ও শ্রেষ্ঠ পত্রকাব্য ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’। ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ রচনার পরপরই মাইকেল মধুসূদন দত্ত ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’ রচনায় প্রবৃত্ত হন। বন্ধু রাজনারায়ণ বসুর নিকট লেখা এক পত্রে তাঁর এই গ্রন্থ রচনার কথা জানা যায়।
"But within the last few weeks, I have been scribbling the thing to be called ‘বীরাঙ্গনা’; i.e. Heroic Epistles from the most noted Puranic woman to their lovers or lords. There are to be twenty one Epistles and I have finished eleven ........ The first series contain (1) Sacuntala to Dusmanta, (2) Tara to Some, (3) Rukmini to Dwarakanath, (4) Kaikayae to Dasarath, (5) Surpanakha to Lakshman, (6) Droupadi to Arijuna, (7) Bhanumaty to Durjodhana, (8) Duhsala to Jayadratha, (9) Jana to Niladhaja, (10) Jahnavi to Santuna and (11) Urbasi to Pururava. a goodly list, my friend."
চিঠি দেখে জানা যায়, সব মিলে ২১টি পত্র লেখার অভিপ্রায় ছিল, তাঁর কিন্তু রচনা করেছেন ১১টি। রোমের প্রসিদ্ধ কবি Ovid (ওভিদ) [খ্রি.পূ.৪৩ - খ্রি.০১] -এর পত্রাবলির আদর্শে মধুসূদন এ কাব্য রচনা করেন। ওভিদের 'The Heroides or Epistle of the Heroines' কাব্যে মোট ২১টি পত্র রয়েছে। কাব্যের উপাদান তিনি সংগ্রহ করেছেন গ্রিক পুরাণ এবং গ্রিক ও রোমান সাহিত্য থেকে। আর মধুসূদনের কাব্যের উপাদান গৃহীত হয়েছে ভারতীয় পুরাণ ও সাহিত্য বিশেষত-রামায়ণ, মহাভারত এবং কালিদাসের কাব্য হতে। ওভিদের কোনো কোনো পত্র ট্রয়-যুদ্ধের পটভূমিতে রচিত হয়েছে, তেমনি মধুসূদনের পত্রে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পটভূমি এসেছে। এক্ষেত্রে বাঙালি কবি ঔচিত্যবোধের পরিচয় দিয়েছেন। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকে ওভিদের গ্রিক ও রোমান পুরাণকথা এবং মহাকাব্যাদি থেকে উপাদান সংগ্রহের কারণ তখনও পর্যন্ত সাহিত্য জগতে নবতর দিগন্ত উন্মোচিত হয়নি। কিন্তু ঊনিশ শতকের বাঙালি কবি যে হাজার বছরের দেশীয় ঐতিহ্যের দিকে নজর না দিয়ে রামায়ণ-মহাভারতের (এবং ক্বচিৎ ভগবতের) দিকে আকৃষ্ট হয়েছিলেন, সেটা তার কবিপ্রাণেরই বিশেষ প্রবণতার চিহ্নবাহী। তবে পুরাণ ও প্রাচীন সাহিত্য থেকে নায়ক ও নায়িকা বা উপাদান সংগৃহীত হলেও তিনি সম্পূর্ণ নতুনভাবে চরিত্রগুলো উপস্থাপন করেছেন। তাঁর কাব্যের মূল সুর প্রেম। নায়িকার আশা-নিরাশা, প্রত্যাশা-ব্যর্থতা, সন্দেহ-সংশয়, ত্যাগ-তিতিক্ষা, প্রেম-ঘৃণা, স্বপ্নবিলাস-স্বপ্নভগ্ন এ সকল সূক্ষ্ম আবেগ ও অনুভূতি তাঁর কাব্যে স্থান পেয়েছে।
মধুসূদনের ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যকে আলোচনার সুবিধার্থে দু’ভাগে ভাগ করা যেতে পারে
১. পতির প্রতি পত্নীর পত্র
২. প্রণয়ীর প্রতি প্রণয়িনীর পত্র
১. পতির প্রতি পত্নীর পত্র :
(ক) প্রত্যাখ্যান পত্র : প্রেম বন্ধন ছিন্ন করার জন্য বিরহীর উদ্দেশ্যে এ পত্র লেখা হয়। এর অন্তর্ভুক্ত পত্র হলো শান্তনুর প্রতি জাহ্নবী।
(খ) স্মরণার্থ পত্র : স্বামীর প্রণয়জনিত ব্যাকুলতা কিংবা স্বামীর মঙ্গল কামনায় অথবা স্ত্রীকে ভুলে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে পত্রগুলো লিখিত। পত্রগুলো হলো দুষ্মন্তের প্রতি শকুন্তলা, অর্জুনের প্রতি দ্রৌপদী, দুর্যোধনের প্রতি ভানুমতী, জয়দ্রথের প্রতি দুঃশলা।
(গ) অনুযোগ পত্র : স্বামীর প্রতিজ্ঞাভঙ্গ বা আদর্শচ্যুতির প্রেক্ষাপটে পত্রগুলো লিখিত। এগুলো হলো দশরথের প্রতি কেকয়ী, নীলধ্বজের প্রতি জনা।
২. প্রণয়ীর প্রতি প্রণয়িনীর পত্র :
প্রেমাস্পদের অনুগ্রহ প্রার্থনা করে পত্রগুলো লিখিত। এখানে চারটি পত্র রয়েছে। চারজন নারীর নারীজীবনের চার অবস্থার চিত্র এখানে ফুটে উঠেছে। তারা সধবা, শূর্পণখা বিধবা, রুক্মিণী কুমারী এবং উর্বশী বারবণিতা। পত্রগুলো হলো- সোমের প্রতি তারা, লক্ষ্মণের প্রতি শূর্পণখা, দ্বারকানাথের প্রতি রুক্মিণী ও পুরুরবার প্রতি উর্বশী।
মহাভারতের আদিপর্বে দেখা যায় শাপভ্রষ্ট অষ্টবসুর ক্রন্দনে বিচলিত হয়ে জাহ্নবী মানবীরূপে মর্ত্যে আসে এবং শর্তসাপেক্ষে রাজা শান্তনুকে পতিরূপে গ্রহণ করে। শর্ত হলো স্বামী কোনো কাজে বাধা দিলে সে সম্পর্ক ছিন্ন করে স্বর্গে চলে যাবে। জাহ্নবী একে একে সাতটি সন্তান লাভ করে এবং গঙ্গাজলে বিসর্জন দেয়। কিন্তু অষ্টম সন্তান জন্মলাভের পর তাকে বিসর্জন দিতে গেলে রাজা সহ্য করতে না পেরে স্ত্রীকে বাধা দেয়। ফলে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ হয়েছে বলে জাহ্নবী স্বামীগৃহ ত্যাগ করে বহুদিন গঙ্গাতীরে উদাসীনভাবে অতিবাহিত করতে থাকলে জাহ্নবী বয়ঃপ্রাপ্ত সন্তান দেবব্রতকে দিয়ে পত্রটি পাঠায়। ‘শান্তনুর প্রতি জাহ্নবী’ পত্র কবিতায় জাহ্নবী বিগত দিনের কথা উল্লেখ করে বলেছে, অতীতের কথা স্মরণ করে বৃথা অশ্রু বিসর্জন না করে বরং শান্তনুর উচিত নতুন করে জীবন শুরু করা। তাদের সন্তান দেবব্রতকে সে সর্ব বিদ্যায় শিক্ষিত করে তুলছে। তাই সে স্বামীকে অনুরোধ করে পুত্রকে যেন সিংহাসনের উত্তরাধিকারী করা হয়। মূলত জাহ্নবীর মধ্যে কর্তব্যবোধ স্পৃহা প্রবল হয়ে দেখা দিয়েছে সেটা স্বামী কিংবা সন্তান উভয়ের ক্ষেত্রেই। তাইতো স্বামীর উদ্দেশ্যে তাকে বলতে শুনি
“বৃথা তুমি, নরপতি, ভ্রম মম তীরে
বৃথা অশ্রুজল তব, অনর্গল বহি,
মম জলদল সহ মিশে দিবা নিশি!
ভুল, ভূতপূর্ব কথা, ভুলে লোক যথা
স্বপ্ননিদ্রা, অবসান! এ চির বিচ্ছেদে
এই হে ঔষধ মাত্র, কহিনু তোমারে।” [শান্তনুর প্রতি জাহ্নবী]
বন-নিবাসিনী শকুন্তলা পতির বিরহে বিরহিনী হয়ে রাজা দুষ্মন্তকে যে পত্র লেখেন তার মূল উপজীব্য কালিদাসের ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলা’। নাটকে পুরুকুল নিধির মৃগয়া প্রসঙ্গে আশ্রমে আগমন, শকুন্তলার সাথে সাক্ষাৎ, আতিথেয়তা গ্রহণে মুগ্ধ ও রূপলাবণ্যে বিমোহিত হওয়া; পরিণামে প্রণয় ও পরিণয়; পরবর্তীতে অভিশপ্ত শকুন্তলার রাজা কর্তৃক প্রত্যাখ্যান এবং তপস্যার মাধ্যমে জীবনের পরিপূর্ণতা লাভ প্রভৃতির মধ্য দিয়ে মহাকবি কালিদাস চরিত্রটি চিত্রিত করেছেন। মধুসূদন ‘দুষ্মন্তের প্রতি শকুন্তলা’ পত্রটিতে স্বল্প পরিসরে বিরহাতুরা শকুন্তলার চিত্র তুলে ধরেছেন। যে নিকুঞ্জ বনে শকুন্তলার সাথে দুষ্মন্তের প্রণয় ঘটেছিল সেখানে আজ বসন্ত। চারদিকে কোকিলের গান, অলির গুঞ্জনধ্বনি, স্রোতোনাদ, পরিমল সুধা, পাতার মর্মর অথচ প্রিয়তম কাছে নেই। তার মনে সংশয় জেগেছে সে কি স্বামী কর্তৃক প্রবঞ্চিতা কিংবা পরিত্যক্তা?
“শোন পত্র-সরস দেখিলে
তোরে সমীরণ আসি নাচে তোরে লয়ে
প্রেমামোদে; কিন্তু যবে শুখাইস কালে
তুই, ঘৃণা করি তোরে তাড়ায় সে দূরে
তেমতি দাসীরে কিরে ত্যজিলা নৃপতি?” [দুষ্মন্তের প্রতি শকুন্তলা]
শকুন্তলার বিরহে সখীরা নৃপতিকে নিন্দা করলেও ঋষিকন্যা সে অপবাদ নীরবে সহ্য করে। কারণ পতিই তার ধ্যান। পতির পদসেবা করাকেই সে জীবনের সার্থকতা মনে করে। তাইতো বন-নিবাসিনী, বাকল-বসনা শকুন্তলার স্বর্ণ-রত্ন-সংঘটিত অট্টালিকা, দ্বিরদ-রদ-নির্মিত দুয়ার, মণি-মুক্তা খচিত অলকা-সদন প্রভৃতি রাজসুখের প্রতি আগ্রহ নেই।
“জানে দাসী, হে নরেন্দ্র, দেবেন্দ্র সদৃশ
ঐশ্বর্য, মহিমা তব; অতুল জগতে।
কুল, মান, ধনে তুমি, রাজকুলপতি!
কিন্তু নাহি লোভে দাসী বিভব! সেবিবে
দাসীভাবে পা দুখানি এই লোভ মনে-
এই চির-আশা, নাথ, এ পোড়া হৃদয়ে।” [ দুষ্মন্তের প্রতি শকুন্তলা]
ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির দুর্যোধনের আহ্বানে পাশা খেলায় পরাজিত ও রাজ্যচ্যুত হয়ে সকলে মিলে বনে বাস করেন। পরবর্তীতে শত্রু দমনের নিমিত্তে অস্ত্র-বিদ্যা শিক্ষার জন্য অর্জুন ত্রিদশালয়ে (স্বর্গে) গমন করে ফিরে আসতে বিলম্বিত হলে দ্রৌপদীর বিরহী মনোভাবের প্রেক্ষিতে মাইকেল ‘অর্জুনের প্রতি দ্রৌপদী’ পত্রটি রচনা করেন। এতে একদিকে পতির প্রতি তার প্রেম এবং অন্যদিকে শঙ্কাও প্রকাশ পায়। দ্রৌপদীর ধারণা স্বর্গালোকে যেহেতু প্রলুব্ধ করার সামগ্রীর অভাব নেই তাই হয়তো অপ্সরার মোহপাশে আবদ্ধ হয়ে স্বামীর প্রত্যাগমনে বিলম্ব হচ্ছে।
“ -------------------- সতত আদরে
সেবে তোমা, সুরবালা পীন পয়োধরা
ঘৃতাচী; সুউরু রম্ভা! নিত্য প্রভাময়ী
স্বয়ম্প্রভা; মিশ্রকেশী সুকেশিনী ধনী।
উর্বশী কলঙ্কহীনা শশিকলা দিবে।” [অর্জুনের প্রতি দ্রৌপদী]
তবে পতির প্রতি তার বিশ্বাস, স্বয়ম্বর সভায় অর্জুন যেভাবে তাকে উদ্ধার করেছে; তেমনি এবারও কৌরবকুলের ভীষ্ম, দ্রৌণ, কর্ণ, প্রমুখদের সম্মুখ যুদ্ধে পরাজিত করে সে পাণ্ডবদের রাজাসনে বসাবে। পত্রের শেষে তাকে বলতে শুনি, যুবতী স্ত্রীকে একাকিনী রাখা সমীচীন নয় “কে ফেরে বিদেশে যুবতী পতœীরে ঘরে রাখি একাকিনী?” তাই তার প্রত্যাশা- প্রিয়তম স্বামী পত্রের জবাব না দিয়ে যেন পত্রবাহকসহ সশরীরে উপস্থিত হয়। পত্রটিতে বিয়ের পূর্বাবস্থা, পরবর্তী ঘটনা, পূর্বরাগ প্রভৃতি অনুষঙ্গ চমৎকার ভঙ্গিতে উপস্থাপিত হয়েছে।
মহাভারতের কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পটভূমিতে ‘দুর্যোধনের প্রতি ভানুমতী’ পত্রটি লিখিত হয়েছে। মাতুলের কুপরামর্শে দুর্যোধন ন্যায়পরায়ণ পা-বদের প্রতি ঈর্ষাকাতর হয়ে তাদের বিরুদ্ধাচরণ করেন। চিত্রসেন কর্তৃক দুর্যোধন কুরুবধূ দলসহ বন্দি হলে পাণ্ডবদের সহায়তায় মুক্তি পান অথচ পা-বরা তখন দুর্যোধনের আহ্বানে পাশাখেলায় পরাজিত হয়ে বনবাসে নির্বাসিত।
ভানুমতী লক্ষ্য করেছে কুরুরা পাণ্ডবদের প্রতি কখনো ন্যায়-নীতি প্রদর্শন করেনি। পত্রে ভানুমতী অর্জুন এবং ভীমের বীরত্ব ও সাহসিকতা তুলে ধরেছে। সে স্বপ্নে দেখেছে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে পাণ্ডব কর্তৃক ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ, দুর্যোধন প্রমুখের মৃত্যুর করুণ দশা। তাই সে ভীত হয়ে এই অন্যায় যুদ্ধ পরিহার করে স্বামীকে ন্যায়ের পথে ফিরে আসতে অনুরোধ জানায় এবং পাণ্ডবদের পাঁচটি গ্রাম দিয়ে সন্ধি করতে বলে
“এস তুমি, প্রাণনাথ, রণ পরিহরি!
পঞ্চখানি গ্রাম মাত্র মাগে পঞ্চরথী।
কি অভাব তব, কহ? তোষ পঞ্চ জনে;
তোষ অন্ধ বাপ মায়ে; তোষ অভাগীরে;” [দুর্যোধনের প্রতি ভানুমতী]
পত্রটিতে ভানুমতীর দৃঢ়তা ও যুক্তিবাদী লেখনীর দ্বারা তার ন্যায়বোধ, অন্যায় যুদ্ধ পরিহার এবং স্বামীর প্রতি হিতাকাক্সক্ষাই প্রকাশ পেয়েছে।
‘জয়দ্রথের প্রতি দুঃশলা’ পত্রটিতে দুঃশলার আতঙ্কগ্রস্ত মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায়। মহাভারতের কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পটভূমিতে পত্রটি রচিত। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে দ্রোণ, কর্ণ, কৃপ, অশ্বত্থামা, শকুনি, দুর্যোধন ও দুঃশাসন এসপ্ত মহারথী একযোগে যুদ্ধ করে অর্জুনের পুত্র অভিমন্যুকে হত্যা করে। পুত্রবধের কথা শুনে অর্জুন প্রতিজ্ঞা করেন পরদিন সূর্যাস্তের পূর্বেই জয়দ্রথকে বধ করবেন। তখন দুঃশলা ভীত হয়ে পত্রটি জয়দ্রথের কাছে প্রেরণ করে। দুঃশলা স্বামীকে বনপর্বে দ্রৌপদী হরণ করে পাণ্ডব কর্তৃক লাঞ্ছিত হবার ঘটনাও এ প্রসঙ্গে স্মরণ করিয়ে দেয়। সে আরো বলে, দ্রোণ, দুর্যোধন, কর্ণ, অশ্বত্থামা, কৃপাচার্য, দুঃশাসন অনেকেই হয়তো তাকে আশ্বস্ত করবে অর্জুনের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য কিন্তু সবই মোহিনী বাণী। জয়দ্রথ যে অন্যায় সমরে লিপ্ত হয়েছে, তাতে দুর্যোধনের স্বার্থ থাকতে পারে কিন্ত তার স্বামীর কি স্বার্থ আছে? তাই সে অন্যায় সমর থেকে স্বামীকে ফিরে আসার অনুরোধ জানায়। সিন্ধুপতি জয়দ্রথ যদি তাকে ভুলে থাকে, তবু যেন তার সন্তানকে ভুলে না যায়
“ভুলে যদি থাক মোরে, ভুল না নন্দনে,
সিন্ধুপতি;” [জয়দ্রথের প্রতি দুঃশলা]
সে আরো অনুরোধ জানায়
“এস তুমি, এস নাথ, রণ পরিহরি!
ফেলি দূরে বর্ম, চর্ম, অসি, তূণ, ধনু
ত্যজি রথ, পদব্রজে এস মোর পাশে।” [জয়দ্রথের প্রতি দুঃশলা]
কিংবা,
“এস শীঘ্র প্রাণসখে, রণভূমি ত্যজি!
নিন্দে যদি বীরবৃন্দ তোমায়, হাসিও
সমন্দিরে বসি তুমি।” [জয়দ্রথের প্রতি দুঃশলা]
মূলত, দুঃশলা নিজের স্বামীকে আসন্ন বিপদ থেকে বাঁচাতে গিয়ে সব ধরনের পথ এমনকি নীচতার আশ্রয় নিতেও দ্বিধা করেনি।
বাল্মীকি রামায়ণের অযোধ্যাকাণ্ডে রাজা দশরথ কেকয়ীর নিকট প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন ভরতকে রাজ্যদান করবেন। পরবর্তীতে দশরথ স্বসত্য বিস্মৃত হয়ে কৌশল্যা নন্দন রামচন্দ্রকে রাজ্য প্রদানের ইচ্ছা প্রকাশ করলে মন্থরা নামক দাসীর মুখে এ সংবাদ পেয়ে কেকয়ী রাজসমীপে যে পত্র প্রেরণ করেন, তারই প্রেক্ষিতে ‘দশরথের প্রতি কেকয়ী’ পত্রটি রচিত। হিন্দু ধর্মশাস্ত্রে স্বামীর বিরুদ্ধাচরণ নিষিদ্ধ হলেও নিচুকুলসম্ভবা কেকয়ী স্বামীর এ অন্যায়ের তীব্র প্রতিবাদ করেন। এর সাথে অভিযোগ, অনুযোগ, ভর্ৎসনা, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের ভাব-বৈচিত্র্য পত্রটিতে অপূর্ব রস সঞ্চার করেছে। কেকয়ী পৃথিবীর সর্বত্র বলে বেড়াবেন রঘু-কুলপতি কেবল ধর্মাচরণের ভান করেন। তার দীপ্ত ঘোষণা“পরম অধর্মচারী রঘু কুলপতি।” তিনি ব্যঙ্গ করে বলেছেন আজ অপগত যৌবনা বলে কি রাজা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারী?
“না পড়ি ঢলিয়া আর নিতম্বের ভরে!
----------------------------
----------------- নম্রর-শিরঃ এবে
উচ্চ কুচ! সুধা-হীন অধর! লইল
লুটিয়া কুটিল কাল, যৌবন ভাণ্ডারে
আছিল, রতন যত; হরিল কাননে
নিদাঘ কুসুম-কান্তি, নীরসি কুসুমে!” [দশরথের প্রতি কেকয়ী]
পত্রের শেষাংশে ক্রুদ্ধ ও উত্তেজিত কেকয়ীর স্বামীর প্রতি অভিশাপ বাণী নিম্নরূপ
“থাকে যদি ধর্ম, তুমি অবশ্য ভুঞ্জিবে
এ কর্মের প্রতিফল! দিয়া আশা মোরে,
নিরাশ করিলে আজি; দেখিব নয়নে
তব আশা-বৃক্ষে ফলে কি ফল, নৃমণি?” [দশরথের প্রতি কেকয়ী]
‘নীলধ্বজের প্রতি জনা’ পত্রকবিতায় মহাভারতের অশ্বমেধ পর্বে মাহেশ্বরী পুরীর যুবরাজ প্রবীর যুধিষ্ঠিরের অশ^মেধ যজ্ঞের ঘোড়া ধরলে পার্থ (অর্জুন) তাকে হত্যা করে। রাজা নীলধ্বজ্জ পুত্র হত্যার প্রতিশোধ না নিয়ে বরং পার্থের সাথে সন্ধি করে তাকে রাজপুরীতে সংবর্ধনার আয়োজন করে এবং মিত্রতার নিদর্শনস্বরূপ হস্তিনায় যেতে রাজি হলে প্রতিহিংসায় উদ্দীপ্তা জনা পত্রটি রাজসমীপে প্রেরণ করে। পুত্রের মৃত্যুতে জনা মুহ্যমান নয় বরং গর্বিতা
“ক্ষত্রকুল-রত্ন পুত্র প্রবীর সুমতি,
সম্মুখ-সমরে পড়ি, গেছে স্বর্গধামে
কি কাজ বিলাপে, প্রভু?” [নীলধ্বজের প্রতি জনা]
কিন্তু যখন সে জানতে পারল রাজসভাতে পুত্রহন্তা পার্থ সমাসীন, নর্তকীরা তাঁকে তুষ্ট করার জন্য নৃত্য করছে, এমনকি রাজা স্বয়ং পার্থকে তুষ্ট করার জন্য সেবা যতœ করেছে, তখন স্বামীর প্রতি তার ক্রোধ ও ক্ষোভ জ্বলন্ত হয়ে উঠেছে। স্বামীর প্রতি তার বিদ্রুপাত্মক বাক্য উচ্চারিত হয়েছে এভাবে
“তব সিংহাসনে
বসেছে পুত্রহা রিপু-মিত্রোত্তম এবে!
সেবিছে যতনে তুমি অতিথি রতনে,
কি লজ্জা! --------------------
-----------------------------
যে দারুণ বিধি, রাজা, আঁধারিলা আজি
রাজ্য, হরি পুত্রধনে, হরিলা কি তিনি
জ্ঞান তব? ----------------------
-------- ক্ষত্রিয় ধর্ম এই কি নৃমণি?” [নীলধ্বজের প্রতি জনা]
এসব উক্তির মধ্য দিয়ে একদিকে স্বামীর প্রতি তার প্রচণ্ড ঘৃণা, অন্যদিকে পুত্রের প্রতি আকণ্ঠ মমত্ববোধ প্রকাশ পেয়েছে।
এছাড়াও জনা পা-বদের বিভিন্ন কুকীর্তির (পাণ্ডব-দাহনে কৃষ্ণের সহায়তা; কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে ভীষ্মনিধনে শিখণ্ডীর সাহায্য লাভ; ছলনার আশ্রয়ে দ্রোণাচার্যের হত্যাসাধন; অন্যায় যুদ্ধে কর্ণকে হত্যা) উদাহরণ দিয়েও যখন নীলধ্বজকে উদ্দীপ্ত করতে ব্যর্থ হলো, তখন সে আত্মহত্যাকেই শ্রেয় মনে করলো
“মহাযাত্রা করি
চলিল অভাগা জনা পুত্রের উদ্দেশে!
------------------------------
যাচি চির বিদায় ও পদে!” [নীলধ্বজের প্রতি জনা]
গুরুপত্নী তারা শিষ্য সোমের রূপে মুগ্ধ হয়ে প্রেমাসক্ত হন। সোম বিদ্যা শেষে গুরুর নিকট থেকে বিদায় নিতে চাইলে তারাদেবী নিজ মনোবাঞ্ছা আর ধরে রাখতে পারলেন না এবং সতীত্বধর্ম জলাঞ্জলি দিয়ে সোমদেবতাকে পত্র লেখেন। ঋগ্বেদ এবং বিষ্ণু পুরাণে এই কাহিনি উল্লেখ আছে। মধুসূদনের লিখিত ‘সোমের প্রতি তারা’ পত্রে প্রথম দর্শনেই শিষ্যের প্রতি গুরুপত্নীর রূপজ-মোহের চিত্র ফুটে উঠে
“যে দিন প্রথমে তুমি এ শান্ত আশ্রমে
প্রবেশিলা, নিশিকান্ত, সহসা ফুটিল
নব কুমুদিনীসম এ পরাণ মম
উল্লাসেভাসিল যেন আনন্দ সলিলে।” [ সোমের প্রতি তারা]
তারার এ প্রেম নিবেদন সমাজের দৃষ্টিতে রুচি গর্হিত। কিন্তু কাব্য সৌন্দর্যে অতুলনীয়। ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাঙালি সমাজের প্রেক্ষাপটে গৃহবধূ তারার সোমের রূপে মুগ্ধ হয়ে গৃহত্যাগের বাসনা বিস্ময়কর বৈকি!
“মধুসূদনের তারা পত্রের অবৈধ প্রেমই বাংলা সাহিত্যে সমাজ বিরোধী প্রেম-সম্পর্কের প্রথম স্বাক্ষর। সমাজ সংস্কারের বিরুদ্ধে নারীচিত্তের মুক্তির কামনা অবৈধ প্রেমচিত্রের একটি ধারার সৃষ্টি করেছে পরবর্তী বাংলা সাহিত্যে। যে হৃদয় বৃত্তির প্রবলতম আকর্ষণে শৈবালিনী একদিন ঋষিকল্প স্বামীর ঘর পরিত্যাগ করে প্রতাপের সাক্ষাৎ অভিলাষে অভিসার করেছিল, তারা’য় তারই পূর্বরূপ।” [ ক্ষেত্রগুপ্ত- মধুসূদনের কবি-আত্মা ও কাব্যশিল্প]
“কর আসি কলঙ্কিনী কিঙ্করী তারারে,
তারানাথ! নাহি কাজ বৃথা কুলমানে,
এস, হে তারার বাঞ্ছা! পোড়ে বিরহিনী
পোড়ে যথা বনস্থলী ঘোর দাবানলে।
-------------------------------
------------- এস শীঘ্র করি!
এ নব যৌবন, বিধু অর্পিব গোপনে
তোমায়।” [সোমের প্রতি তারা]
বাল্মীকি ‘রামায়ণ’-এ রাক্ষসী শূর্পণখাকে বিরূপাক্ষী, তাস্রকেশী, বিরূপা, কণ্ঠস্বর ভীষণা, অতিবৃদ্ধা, প্রতিকূল-ভাষিণী, দুর্বৃত্তা, বিকটাকৃতি প্রভৃতি বীভৎস রস দিয়ে চিত্রিত করেছেন। কিন্তু মধুসূদন এই ধারা থেকে সরে গিয়ে ‘লক্ষ্মণের প্রতি শূর্পণখা’ পত্রে সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে শূর্পণখাকে তুলে ধরেছেন। তাই তিনি পাঠকের কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন
“কবিগুরু বাল্মীকি রাজেন্দ্র রাবণের পরিবারবর্গকে প্রায় বীভৎস রস দিয়া বর্ণন করিয়া গিয়াছেন; কিন্তু এ স্থলে সে রসের লেশমাত্র নাই। অতএব পাঠকবর্গ সেই বাল্মীকি-বর্ণিতা বিকটা শূর্পণখাকে স্মরণপথ হইতে দূরীকৃতা করিবেন।” [লক্ষ্মণের প্রতি শূর্পণখা]
পত্রে দেখা যায় বিজন বনে লক্ষ্মণের রূপ দেখে শূর্পণখার মধ্যে প্রেমভাব জাগ্রত হয়। স্বর্ণ-নির্মিত গৃহ, দ্বিরদ-রদের গবাক্ষ, পারিজাত ফুলের সাহচর্য, সহস্র সঙ্গিনীর নৃত্যগীত, পাখির সুমধুর কলকাকলি, কুসুম-কাননে বিরাজিত পরিমল, সতত সঞ্চরণ বায়ু, জলের কলকল ধ্বনি এ সবই তার কাছে তুচ্ছ লক্ষ্মণের প্রেমের জন্য। লক্ষ্মণকে পাওয়ার জন্য সে রত্ন খচিত কাঁচলি, সুসজ্জিত বেণী, চন্দন, মুক্তমালা প্রভৃতি ভূষণ ছেড়ে উদাসিনী বেশও ধারণ করতে প্রস্তুত। এমনকি সে তার যৌবন সুধা দিয়ে লক্ষ্মণকে প্রলুব্ধ
করতে চেয়েছে
“আইস মলয় রূপে; গন্ধহীন যদি
এ কুসুম, ফিরে তবে যাইও তখনি
আইস ভ্রমর-রূপে। না যোগায় যদি
মধু এ যৌবন-ফুল, যাইও উড়িয়া
গুঞ্জরি বিরাগ-রাগে।” [লক্ষ্মণের প্রতি শূর্পণখা]
-শূর্পণখার এই সর্বস্ব ত্যাগের মনোবৃত্তির মাধ্যমে কবি তার প্রেমেরই বিজয়বার্তা ঘোষণা করেছেন।
ভাগবত পুরাণে দ্বারকানাথের নিকট রুক্মিণীর পত্রের উল্লেখ আছে। যৌবনে উপনীত হলে রুক্মিণী ভাই যুবরাজ রুক্মিণী চেদীশ্বর শিশুপালের সাথে তার পরিণয়ে উদ্যোগী হলে রুক্মিণীদেবী তাকে উদ্ধারের জন্য দ্বারকানাথ কৃষ্ণের নিকট পত্র প্রেরণ করেন। মধুসূদনের হাতে এ প্রেমপত্রটি ‘দ্বারকানাথের প্রতি রুক্মিণী’ রূপে নতুন ভঙ্গিতে উপস্থাপিত হয়েছে। প্রিয় মিলনের আকাক্সক্ষায় অধীর এ পত্রে দেবীর সলজ্জ চিত্র থাকলেও এ প্রেম ইন্দ্রিয়াতীত নয়। দ্বারকানাথের কাছে রুক্মিণীর এ পত্র যেন একজন ভারতীয় নারীর তার দয়িতের নিকট উদ্ধারের আকুল আবেদন
“আসি উদ্ধারহ মোরে, ধনুর্দ্ধর তুমি
মুরারি।----------------------
কালরূপে শিশুপাল আসিছে সত্বরে
আইস তাহার অগ্রে। প্রবেশি এ দেশে
হর মোরে! হরে লয়ে দেহ তাঁর পদে
হরিলা এ মনঃ যিনি নিশার স্বপনে।” [দ্বারকানাথের প্রতি রুক্মিণী]
‘পুরুরবার প্রতি উর্বশী’ পত্রের উপাদান মধুসূদন কালিদাসের ‘বিক্রমোবর্শী’ নাটক হতে গ্রহণ করেছেন। চন্দ্রবংশীয় রাজা পুরুরবা অপহৃত উর্বশীকে কেশী নামক দৈত্যের হাত হতে উদ্ধার করেন। উর্বশী রাজার রূপে মুগ্ধ হয়ে পত্রখানি লেখেন। মধুসূদন তাঁর লেখনীতে নাটকীয়ভাবে ঘটনাটি উপস্থাপন করেন। স্বর্গে দেবতাদের মাঝে ‘লক্ষ্মী সয়ম্বর’ নাটক অভিনয়কালে বারুণীর প্রশ্নের জবাবে উর্বশী রাজা পুররবার প্রতি তার মনোবাঞ্ছা প্রকাশ করে। ফলে ভরতঋষি কর্তৃক সে অভিশপ্তা হয়। স্বর্গের নর্তকী হয়েও পুরুরবার প্রতি তার আকর্ষণের কারণ দৈত্য কেশীর নিকট থেকে উদ্ধারের সময় পুরুরবার রূপ-গুণ ও শৌর্য-বীর্য দর্শন। স্বর্গীয় সুখও তার কাছে তুচ্ছ “কি ছার স্বর্গ তোমার বিহনে?”
তাই সুধাংশু-বংশ-চূড়ের প্রতি তার নিবেদন
“কঠোর তপস্যা নর করি যদি লভে
স্বর্গভোগ; সর্বাগ্রে বাঞ্ছে সে ভুঞ্জিতে
যে স্থির-যৌবন-সুধা অর্পিব তা পদে!
বিকাইব কায়মনঃ উভয়, নৃমণি
আসি তুমি কেন দোঁহে প্রেমের বাজারে!
উর্বীধামে উর্বশীরে দেহ স্থান এব,
উর্বশী! রাজস্ব দাসী দিবে রাজপদে
প্রজাভাবে নিত্য যত্নে।” [পুরুরবার প্রতি উর্বশী]
ঊনিশ শতকে বাঙালি নবজাগরণের অন্যতম ভিত্তি ছিল নারীর অধিকার সচেতনতা এবং পুরুষের পাশাপাশি নারীর কর্তব্য করার আগ্রহ প্রতিষ্ঠা। এই নারী-জাগৃতির চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটেছে ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’র প্রমীলার সেই বিখ্যাত উক্তি ‘আমি কি ডরাই সখি, ভিখারী রাঘবে?’ এর মাধ্যমে। ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যে ভারতীয় পুরাণে বর্ণিত এগারোজন নারীকে তাদের ব্যক্তিত্ব ও অধিকার সচেতনতার আলোকে নব রূপায়িত করা হয়েছে। পুরাণে এদের ব্যভিচারিণী, উর্বশী, বনবাসিনী কিংবা রাজ প্রাসাদের সাধারণ রাণী হিসেবে দেখানো হয়েছে। পুরুষের সেবা বা মনোরঞ্জন অথবা সন্তান উৎপাদন ছাড়া এদের তেমন পরিচয় নেই। অতএব সে যুগের নারীরা বিরহ জীবন-যাপন করবে কিংবা সবকিছু সহ্য করবে এটাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু ভারতীয় নারী চির আনুগত্যের প্রতীক নয়। তাই মধুসূদন পুরাণের এই এগারো নারীর মধ্যে ব্যক্তিগত স্বাধীন চিন্তা আরোপ করেছেন এবং কারো কারো মধ্যে পুরুষকে অতিক্রম করে অগ্রবর্তী হবার বাসনা জাগিয়েছেন; এমনকি রাক্ষসী শূর্পণখাকে মানবীয় রূপ দিয়েছেন যা রেনেসাঁসের অন্যতম লক্ষণ।
প্রশ্ন উঠতে পারে ‘বীরাঙ্গনা’-র সব নারীই কি বীরাঙ্গনা? ক’জনা বীরাঙ্গনা একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। কিন্তু ভানুমতী বা দুঃশলা? প্রেমচেতনার প্রবলতায় সংসার-ধর্ম ও নীতিবোধকে অস্বীকার করায় তারা চরিত্রে বীর-নারীর বীরত্ব কিছু প্রকটিত হতে পারে। শকুন্তলা, রুক্মিণী প্রভৃতি চরিত্রে বীরত্ব কোথায়?
বাংলা সাহিত্যে মধুসূদনই প্রথম ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’র প্রমীলার মাধ্যমে নারীকে গৃহবন্ধনের সামান্যতা থেকে মুক্তি দিলেন । তারপরে এই কাব্যটির নাম দিলেন ‘বীরাঙ্গনা’। ফলে পাঠক প্রত্যেকটি চরিত্রে বীরত্বের উপকরণ খুঁজবেন এটাই স্বাভাবিক। বীরাঙ্গনার নারীরা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যে মহিমান্বিত কিন্তু গতিশীল নয়। তবে বিশিষ্ট জীবনার্থ অনুসন্ধানে মধুসূদন চরিত্রগুলোর মধ্যে স্বাধীনচিত্ততা, প্রেম ও প্রাণের প্রবলতা, সর্ববাধা উত্তরণের সাহস প্রভৃতি লক্ষণগুলো সঞ্চারিত করেছেন। এই বিশেষ দিক দিয়ে দেখলে এঁরা অনেকেই বীর নারী এমন কি প্রেমের মাধুর্যের জন্য ক্ষাত্রধর্ম-বিসর্জন-প্রয়াসী দুঃশলাও।
“মধুসূদন সেই আদর্শ নারীর স্বপ্ন দেখেছিলেন যে বীর্যবতী কিন্তু তার বীর্য সৌন্দর্যবিহীন নয়। শক্তি ও সৌন্দর্যের, ঐশ^র্য ও মাধুর্যের একটি সমন্বয় ছিল তাঁর আকাক্সক্ষা। তারই নাম ‘বীরাঙ্গনা’। মধুসূদনের কাব্যে এই বীরাঙ্গনা শব্দটিকে তাই অন্য দৃষ্টিতে বিচার করতে হবে। তাঁর কাব্যের নায়িকারা কেউ বীর নয়। কাজেই অনেকের মতে এ শব্দ ব্যবহার তাঁর হঠকারিতা-বিশেষ করে তাঁর ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যগ্রন্থের নাম। কিন্তু শব্দটিকে বিশ্লেষণ করে আরো কিছু পাওয়া যাবে। অভিধান বলছে, ‘বীর’ শব্দটি হলো র্বী+অ(অন্) সোজা কথায় যে শৌর্য প্রকাশ করে। কিন্তু শব্দ যখন বিশেষণ তখন মানে হলো শ্রেষ্ঠ বা প্রধান। তিন লিঙ্গেই এই মানে। আর ‘অঙ্গনা’অঙ্গ+ন, প্রশংসার্হ+আ স্ত্রী লিঙ্গে। সুন্দর দেহ যে নারীর। ‘বীরাঙ্গনা’ মানে দাঁড়াল শ্রেষ্ঠ নারী। অর্থাৎ স্বাতন্ত্র্যময়ী শোভনা সুন্দরী নারী হলো বীরাঙ্গনা শব্দের ব্যঞ্জনা।”
[মধুসূদনের কবি মানস, শিশির কুমার দাশ]