রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৪ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ২০ অক্টোবর ২০২১, ০০:০০

কোরআন ও হাদীসের আলোকে ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম

অনুবাদ : কাজী সাইফুদ্দিন হোসেন

কোরআন ও হাদীসের আলোকে ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম
অনলাইন ডেস্ক

[আল হাশেমীয়া সোসাইটি ল-নের আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আদর্শবাহী সংস্থা। এটি ঈমান-আক্বিদাভিত্তিক লেখা ওয়েভসাইটের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী প্রচার করে থাকে ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বৈধতা প্রসঙ্গে প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন এটার বিজ্ঞ আলেমরা আর ওয়েবসাইট থেকে পাঠকদের জন্য এ লেখা অনুবাদ করেছেন ঢাকার বিশিষ্ট লেখক ও অনুবাদক কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন।]

প্রশ্ন : কুরআন মজীদ ও হাদীস শরীফের আলোকে ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর বৈধতার প্রমাণ পেশ করুন।

উত্তর : ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর পক্ষে দালিলিক প্রমাণ উপস্থাপন করার আগে আমরা মিলাদ শব্দটির আভিধানিক ও শরয়ী অর্থ ব্যাখ্যা করতে চাই।

‘মিলাদ’ শব্দটির মূল ‘বেলাদত’ যার অর্থ হলো জন্ম। অতএব, আরবী ভাষায় মীলাদ শব্দটি জন্মের স্থান ও সময়কে বোঝায়। শরিয়তের আলোকে আমরা মিলাদ বলতে বুঝি সেই সব ঘটনা যা নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর বেলাদত তথা ধরাধামে শুভাগমনের সময় ঘটেছিল; আর এতে আমরা তাঁর সকল বিষয় বর্ণনা করার সুযোগ পেয়ে থাকি; আমরা তাঁর প্রতি দুরূদ-সালাম পেশ করার সুযোগও পেয়ে থাকি। মানুষের কাছে মহানবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর অনন্য ও অনুপম গুণাবলী এবং প্রশংসা বর্ণনা করার সুযোগ আমরা মিলাদের মজলিসে পাই। মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম হলো ধর্ম প্রচারের একটি বড় ধরণের উৎস। এই পবিত্র শুভক্ষণে আলেম সমাজের জন্যে মহানবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর জীবন আদর্শ, নৈকিতা, ঐতিহ্য, ধর্মীয় বিষয়াদি প্রচার করা অবশ্য কর্তব্য।

আমরা এবার কুরআন মজীদ, হাদীস শরীফ ও উলামায়ে কেরামের ঐকমত্যের ভিত্তিতে মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর প্রমাণ পেশ করছি।

কুরআন মজীদ

কুরআন মজীদের আয়াতসমূহ মীলাদ উদ্যাপনের বৈধতাই শুধু প্রমাণ করে না, এগুলোর মোস্তাহাব (প্রশংসনীয়) হবার প্রমাণও বহন করে।

১. আল্লাহ তা’আলা এরশাদ ফরমান-

অর্থ : ‘‘এবং শান্তি তাঁরই ওপর যেদিন জন্ম গ্রহণ করেছেন, যেদিন বেসালপ্রাপ্ত (খোদার সাথে মিলনপ্রাপ্ত) হবেন এবং যেদিন জীবিতাবস্থায় পুনরুত্থিত হবেন’’। [সূরা মারইয়ম, আয়াত -১৫]

উপরিউক্ত আয়াতে করীমায় আল্লাহ তা’আলা হযরত ইয়াহইয়া আলাইহিস্ সালাম এর সম্পূর্ণ মিলাদ বর্ণনা করেছেন। আর এর আগে আল্লাহ পাক তাঁর বেলাদতের পূর্ববর্তী ঘটনাবলীও বর্ণনা করেছেন। এ কারণেই সুন্নী মুসলমানরা সর্বশেষ নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর মিলাদ উদ্যাপন করাকে বৈধ জেনেছেন। আরেক কথায়, পূর্ববর্তী নবী হযরত ঈসা আলাইহিস্ সালাম সহ অন্যান্যদের দ্বারা নিজ মিলাদ উদ্যাপনের বিশুদ্ধ বর্ণনা আমরা পেয়ে থাকি।

২. আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন-

অর্থ : এবং ওই শান্তি আমার প্রতি যেদিন আমি জন্ম লাভ করেছি এবং যেদিন আমার মৃত্যু হবে, আর যেদিন জীবিত অবস্থায় পুনরুত্থিত হবো। [সূরা র্মায়াম, আয়াত-৩৩]

এ আয়াতে করীমার আগে আল্লাহ তা’আলা মরিয়াম আলাইহিমাস্ সালাম এর সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করেছেন; তাঁর গর্ভে হযরত ঈসা নবী আলাইহিস্ সালাম এর জন্মের কথাও আল্লাহ তা’আলা জানিয়েছেন। উপরিউক্ত আয়াতে আল্লাহ তা’আলা হযরত ঈসা আলাইহিস্ সালাম এর বাণী উদ্ধৃত করেন যা দ্বারা তিনি নিজের প্রশংসা করেছেন। এই বর্ণনা শৈলী হযরত ঈসা আলাইহিস্ সালাম এর মিলাদ উদযাপন ছাড়া আর কিছু নয়। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত তথা সুন্নী মুসলমানও এই একই বর্ণনা শৈলী দ্বারা মহানবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর মিলাদ উদযাপন করে থাকেন। হযরত ইয়াহইয়া আলাইহিস্ সালাম ও হযরত ঈসা আলাইহিস্ সালাম এর ক্ষেত্রে আল্লাহ্ তা’আলা তাঁদের মিলাদের বর্ণনা দিয়েছেন, আমরাও মহানবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর বেলাদতের বিভিন্ন ঘটনা বর্ণনা করে থাকি। অতএব, বিবেকবান সবাই এ ব্যাপারে স্বীকার করবেন যে মিলাদ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা আল্লাহ তা’আলারই রীতি। তাই এটা প্রমাণিত যে মিলাদের ভিত্তি কুরআন মজীদেই বিদ্যমান।

৩. আল্লাহ পাক এরশাদ করেন-

অর্থ : তাদেরকে (মানুষদেরকে) আল্লাহর দিনগুলো সম্পর্কে স্মরণ করিয়ে দিন। [সূরা ইব্রাহীম, আয়াত-৫]

এ আয়াতে করীমায় আল্লাহ তা’আলা তাঁর নবী হযরত মূসা আলাইহিস্ সালাম এর প্রতি এ আহবান জানিয়েছেন যেন তিনি তাঁর জাতিকে আল্লাহর দিনগুলো সম্পর্কে স্মরণ করিয়ে দেন। ‘‘আল্লাহর দিনগুলো’’ হলো সে সব দিন যাতে বড় বড় ঘটনা ঘটেছিল বা এমন সব দিন যেগুলোতে আল্লাহ পাক তাঁর সৃষ্টিকুলের প্রতি তাঁরই বড় নেয়ামত বর্ষণ করেছিলেন। ‘আল্লাহর দিনগুলোর’ ব্যাখ্যার পক্ষে কুরআন মজীদ সাক্ষ্য দেয়, যেখানে হযরত মূসা আলাইহিস্ সালাম যে উদ্ধৃত করা হয়েছে : ‘‘আর যখন মূসা আলাইহিস্ সালাম আপন সম্প্রদায়কে বলেছিলেন, স্মরণ করো তোমাদের ওপর আল্লাহর অনুগ্রহকে, যখন তিনি তোমাদেরকে ফেরআউনী সম্প্রদায়ের কবল থেকে মুক্তি দিয়েছেন, যারা তোমাদেরকে নিকৃষ্ট শাস্তি দিতো এবং তোমাদের পুত্রদের যবেহ্ করতো ও তোমাদের কন্যাদেরকে জীবিত রাখতো; এবং এতে তোমাদের প্রতিপালকের মহান অনুগ্রহ রয়েছে।’’ [সূরা ইব্রাহীম, আয়াত -৬]

উল্লিখিত আয়াতের সারমর্ম অনুযায়ী, হযরত মূসা আলাইহিস্ সালাম এর জাতি যেদিন ফিরআউন হতে মুক্তি লাভ করে সেদিনটি ‘‘আল্লাহর দিন’’ হিসেবে পরিগণিত হয়েছে; অতএব মহানবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম যেদিন এ ধরাধামে শুভাগমন করেন, সেদিনও ‘‘আল্লাহর দিন’’ হিসেবে বিবেচিত হবে। কেননা, মহানবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম অজ্ঞতার অন্ধকার থেকে সারা বিশ্ব জগতকে মুক্ত করে হেদায়াত তথা সঠিক পথের আলোতে নিয়ে এসেছেন। তাই অন্যান্য ঘটনার দিন উদ্যাপনের চেয়ে মহানবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর বেলাদত দিবস উদ্যাপন অগ্রাধিকার পাবে। অন্যথায় আল্লাহ তা’আলার রহমত (করুণা) অর্থাৎ বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি শোকরিয়া আদায় করা হবে না। এমতাবস্থায় আল্লাহ পাক আমাদেরকে শাস্তি দেবেন যেমনটি তিনি এরশাদ ফরমান-

অর্থ : এবং স্মরণ করো, যখন তোমাদের প্রতিপালক শুনিয়ে দিলেন, যদি তোমরা কৃতজ্ঞ হও তবে আমি তোমাদেরকে আরও অধিক দেবো, আর যদি অকৃতজ্ঞ হও, তবে আমার শাস্তি কঠোর। [সূরা ইব্রাহীম, আয়াত-৭]

৪. মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন-

অর্থ : সুতরাং আল্লাহর অনুগ্রহগুলোকে স্মরণ করো; এবং পৃথিবীতে ফ্যাসাদকারী হয়ে বিচরণ করো না। [সূরা আ‘রাফ, আয়াত ৭৪]

উপরিউক্ত আয়াতে করীমায় আল্লাহ তা’আলা তাঁর রহমত ও নি’মাতগুলো স্মরণ করার হুকুম দিয়েছেন। শেষ নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম হলেন নিঃসন্দেহে সারা মানবকুলের জন্যে আল্লাহ তা’আলার সবচেয়ে বড় নেয়ামত। এ কথা তিনি অন্যত্র জানিয়েছেন-নিশ্চয় আল্লাহর মহান অনুগ্রহ হয়েছে মুসলমানদের ওপর যে তাদের মধ্যে তাদেরই মধ্য থেকে একজন রাসূল প্রেরণ করেছেন, যিনি তাদের ওপর তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করেন এবং তাদেরকে পবিত্র করেন আর তাদেরকে কিতাব ও হেকমত শিক্ষা দান করেন এবং তারা নিশ্চয় এর আগে স্পষ্ট গোমরাহীতে ছিল। [সূরা আলে ইমরান, আয়াত- ১৬৪]

অতএব, কুরআন মজীদে আল্লাহ তা’আলার হুকুম অনুযায়ী আমাদেরকে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে স্মরণ করতে হবে; আর মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম হলো সর্বশ্রেষ্ঠ নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে স্মরণ করার শ্রেষ্ঠ উপায়।

অন্যত্র আল্লাহ পাক এরশাদ ফরমান-

অর্থ : এবং আপনার প্রতিপালকের নেয়ামতের বেশি বেশি আলোচনা তথা প্রচার প্রসার করুন। [সূরা দোহা, আয়াত- ১১]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু ‘নেয়ামত’ শব্দটির ব্যাখ্যায় বলেন, ‘‘আয়াতোল্লিখিত ‘নেয়ামত’ শব্দটি দ্বারা নবুয়্যত ও দ্বীন ইসলামকে বোঝানো হয়েছে।’’ [তাসফীরে ইবনে আব্বাস, সূরা দোহা -৬৫১]

অতএব, মহানবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর চাচাতো ভাই ও রঈসুল মুফাস্সিরীন প্রদত্ত ব্যাখ্যার আলোকে আমরা বলতে পারি যে মহাপরাক্রমশালী খোদা তা’আলা আমাদেরকে আদেশ করেছেন এ মর্মে যেন আমরা তাঁরই প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে আমাদের সমাজে, মসজিদে এবং পারিবারিক পরিম-লে স্মরণ করি; আর এ ক্ষেত্রে কুরআনী উদ্দেশ্য পূরণে মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ পন্থা কী হতে পারে!

৫. মহান আল্লাহ তা’আলা আমাদের প্রতি আদেশ করেন-

অর্থ : আপনি বলুন, আল্লাহরই অনুগ্রহ ও তাঁরই দয়া, এবং সেটারই ওপর তাদের আনন্দ প্রকাশ করা উচিত। তা তাদের সমস্ত ধন দৌলতের চেয়েও শ্রেয় [সুরা ইউনুস, আয়াত- ৫৮]

এ আয়াতে কারীমায় আল্লাহ তা’আলা আমাদের প্রতি আদেশ করেছেন যেন আমরা তাঁর অনুগ্রহ ও করুণা প্রাপ্তিতে খুশি প্রকাশ করি। আমাদের চারপাশে তাকালে আমরা দেখতে পাই যে আল্লাহ তা’আলার প্রতিটি নেয়ামত আমাদের জন্যে তারই অসীম দয়া। এমন কি আমাদের অস্তিত্বও তাঁর দয়ার বহিঃপ্রকাশ মাত্র। কিন্তু আল্লাহ তা’আলার সর্বশ্রেষ্ঠ করুণা হলেন আমাদের মহানবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এ

সম্পর্কে আল্লাহ পাক এরশাদ ফরমান-

অর্থ : হে রাসূল সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম! আপনাকে আমি প্রেরণ করেছি জগতসমূহের জন্যে আমার রহমত করেই। [সূরা আম্বিয়া, আয়াত-১০৭]

সুতরাং কোরআনের শিক্ষা অনুযায়ী, মহানবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর বেলাদত (ধরাধামে শুভাগমন) দিবসে খুশি প্রকাশ ও শোকরিয়া (কৃতজ্ঞতা) আদায় করা আমাদের প্রতি অবশ্য কর্তব্য করা হয়েছে। যে ব্যক্তি মহানবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি খুশি থাকে, সে সত্য কুরআন মজীদের একজন খাঁটি অনুসারী। আর এটা নিশ্চিত যে, সারা বিশ্বের মুসলমান মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম উদ্যাপন করে থাকেন; এবং তা এ কারণে যে, আল্লাহ তা’আলার অনুপম করুণা বিশেষ করে হযরত রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি শোকরিয়া আদায়ের উদ্দেশ্যেই মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম উদ্যাপন করে থাকেন। অতএব, পবিত্র কুরআন মজীদ মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে সমর্থন করে বলে প্রমাণিত হলো।

৬. মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর সমাবেশ। (জুলুস, মাহফিল ইত্যাদি) মুসলমানদেরকে বিশ্ননবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি দুরূদ সালাম পাঠে অনুপ্রাণিত করে যা আল্লাহর আদেশের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ; এরশাদ হয়েছে-

অর্থ : নিশ্চয় আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতাবৃন্দ দরূদ প্রেরণ করেন এই অদৃশ্য বক্তা (নবী) এর প্রতি। হে ঈমানদার মুসলমান সকল! তোমরাও তাঁর প্রতি দরূদ ও (ভক্তিসহ) সালাম প্রেরণ করো। [সূরা আহযাব, আয়াত-৫৬] শরিয়ত অনুযায়ী, শরিয়তে কোনো কিছু কাম্য হলে তা মূলত শরিয়তের একটি লক্ষ্যে- পরিণত হয়। আর দুরূদ শরীফের ফযিলত সংখ্যায় এতো বেশি যে তা গুণে শেষ করা যাবে না। দুরূদ ও সালাম দুনিয়া ও আখেরাতে আল্লাহ তা’আলার সাহায্য প্রাপ্তিতে কারণস্বরূপ। তাই মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তা’আলার আজ্ঞা পালনের একটি উৎস নিঃসন্দেহে।

৭. আল্লাহ তা’আলা এরশাদ ফরমান-‘‘এবং সব কিছু আমি আপনাকে রাসূলগণের সংবাদই শুনাচ্ছি, যা দ্বারা আমি আপনার হৃদয়কে দৃঢ় করবো’’ [সূলা হুদ, আয়াত-১২০]

এ আয়াতে করীমায় প্রতিভাত হয় যে, পূর্ববর্তী আম্বিয়ায়ে কেরামের ঘটনাবলী বর্ণনা করার মধ্যে হেকমত হলো, এতে করে মহানবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর হৃদয় মোবারককে আরো সুদৃঢ় করা হয়েছে। আর এটা নিশ্চিত, বর্তমানকালে আমাদের অন্তরের দৃঢ়তারও প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। আমাদের জানতে হবে কেমন করে মহানবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম তাঁর সময়কার সমস্যাবলী মোকাবেলা করেছিলেন, যাতে করে আমরাও সুন্নাহ অনুসারে আমাদের সময়কার সমস্যাগুলো মোকাবেলা করতে পারি।

অতএব, মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম হুজুর পুরনূর সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর ঘটনাবলী সম্পর্কে জানবার একটি সুযোগ আমাদের করে দেয়।

হাদীস শরীফ থেকে প্রমাণ

মহানবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম থেকে অনেকগুলো বর্ণনা আমরা পাই, যাতে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর প্রমাণ মিলে। আমরা এখানে মাত্র কয়েকটি উদ্ধৃত করছি :

১. নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম নিজেই সর্বপ্রথমে তাঁর বেলাদত (ধরাধামে শুভাগমন) শরীফ সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন। তিনি এরশাদ ফরমান- ‘‘আমি পবিত্র ঔরস থেকে পবিত্র গর্ভে প্রতিনিয়ত স্থানান্তরিত হয়েছি। আল্লাহ পাক যখন হযরত আদম আলাইহিস্ সালাম কে পৃথিবীতে পাঠালেন, তখন তিনি আমাকে আদম আলাইহিস্ সালাম এর মেরুদ-ে স্থাপন করেন, আর সেখান থেকে নূহ আলাইহিস্ সালাম এর কাছে তাঁর নৌকায় স্তানান্তরিত হলাম, অতঃপর সেখান থেকে হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস্ সালাম এবং তাঁর পর ধারাবাহিকভাবে পবিত্র ঔরস থেকে পবিত্র গর্ভ হয়ে আমার পবিত্র পিতা-মাতার ঔরসে স্থানান্তরিত হই, যাঁরা কখনোই অবৈধ যৌনাচার করেন নি [তাফসীরে রূহুল বয়ান, ৩য় খণ্ড, ৫৪ পৃষ্ঠা]

আমরা প্রথমেই বলেছি মিলাদ অর্থ জন্মের সময় কিংবা স্থান। অতএব, মহানবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম স্বয়ং তাঁর মিলাদ উদ্যাপন করেছেন। এই রীতি অনুসরণ করে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত (সুন্নী মুসলমান সমাজ) বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর বেলাদতের বিভিন্ন ঘটনা বর্ণনা করে থাকেন। এ হাদীসটি মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর একটি সুস্পষ্ট দলিল এবং এটি আমাদের নিশ্চিত করে যে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম উদ্যাপন কোনো বেদআত (মন্দ উদ্ভাবিত রীতি) নয়, বরং সুন্নতে নববী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম।

মহানবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম স্বয়ং বহুবার মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম উদ্যাপন করেছেন। এমন অনেক রেওয়ায়াত আছে যার কিছু কিছু মেশকাত শরীফ নামের হাদীস গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে।

২. যে ব্যক্তি মহানবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর বেলাদত দিবস উদ্যাপন করেন তাঁকে চরম শাস্তি দেয়া হবে না; বরং এটা আশা করা হয় যে মুসলমান ব্যক্তি মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম উদ্যাপন করেছেন তাঁকে জাহান্নামে শাস্তি দেয়া হবে না। কেননা ইমাম বোখারী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বর্ণনা করেছেন যে মহানবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর বেলাদতের সুখবর দাসী সোয়াইবিয়ার কাছ থেকে জানতে পেরে খুশি হয়ে আবু লাহাব আঙ্গুলের ইশারায় ওই দাসীকে মুক্ত করে দিয়েছিল, যার কারণে প্রতি সোমবার (হুজুর পাকের বেলাদত দিবস) জাহান্নামে তার শাস্তি লাঘব হয় এবং তার ওই আঙ্গুল থেকে পানি প্রবাহিত হয়, আর তা সে পান করে। মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম উপলক্ষে খুশি প্রকাশ করায় সে এই পুরস্কার পেয়েছে। [সহীহ্ বোখারী, ২য় খণ্ড, ৭৬৪ পৃষ্ঠা]

ইমাম শামসউদ্দীন নাসের আল্ দামেশকী এ হাদীসটি তাঁর কবিতায় বর্ণনা করেছেন। নিচে এর অনুবাদ দেয়া হলো :

যদি সেই কাফের যাকে (কুরআনে) অভিসম্পাত দেয়া হয়েছে, আর তার হাতগুলো ধ্বংস হয়েছে, আগুনে স্থায়ী আবাস হয়েছে, বর্ণিত আছে, আহম্দ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর বেলাদতের খুশিতে প্রতি সোমবার তার শাস্তি লাঘব হয়, তবে সেই গোলাম কী আশা করতে পারেন, যিনি সারা জীবন আহম্দ মোজতাবার বেলাদতে খুশি হয়েছেন, আর আল্লাহ তা’আলার একত্বে বিশ্বাস করে ইন্তেকাল করেছেন, [হাওলুল ইহতিফাল বিল মওলিদিন্ নববী আল শরীফ ১১ পৃষ্ঠা]

২. প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম নিজেই তাঁর বেলাদত দিবস উদ্যাপন করেছেন রোযা রেখে। সহীহ মুসলিম শরীফে বর্ণিত হয়েছে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে সোমবার দিন তাঁর রোযা রাখার কারণ জিজ্ঞেস করা হয়। তিনি উত্তর দেন-

অর্থ :এ দিন (সোমবার) আমার বেলাদত (প্রথিবীতে শুভাগমন) হয়েছে এবং এ দিনেই আমার প্রতি কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে। ]মেশকাত শরীফ, ১৭৯ পৃষ্ঠা]

এই রওয়ায়াত (বর্ণনা) প্রমাণ করে যে, প্রতি সোমবার মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম উদ্যাপন করা মহানবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর সুন্নাত। দ্বিতীয়ত মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর জন্যে কোনো নির্দিষ্ট দিন ধার্য করা মোবাহ্ (বৈধ)। তৃতীয়ত, মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর খুশিতে এবাদত করা সুন্নাহ সম্মত একটি আমল।

মুসলিম উম্মাহ ও আলেমদের ঐক্যমত্য

১. ইমাম হাফেয আল্ সুয়ূতী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি তাঁর প্রসিদ্ধ ‘আল হাওউইয়ী লিল ফাতাওইয়া’ গ্রন্থে এ বিষয়ে একটি বিশেষ অধ্যায় রয়েছে যার শিরোনাম হলো ‘‘ মওলিদ উদ্যাপন উদ্দেশ্যের শ্রেষ্ঠত্ব’’। এ অধ্যায়ে তিনি লিখেন ‘‘বিবেচনাধীন প্রশ্নটি হলো এই যে, রবিউল আউয়াল মাসে মহানবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর পবিত্র বেলাদত দিবস উদ্যাপনের ব্যাপারে শরিয়তের রায় কী? শরিয়তের দৃষ্টিতে এটি কি একটি প্রশংসনীয় কাজ, না দূষনীয় কাজ? আর যারা এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে তাঁরা কি আল্লাহর অনুগ্রহ লাভ করেন, না করেন না’’?

ইমাম সৈয়ুতী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি অতঃপর লিখেন, ‘‘এ প্রশ্নের উত্তরে আমার দৃষ্টিভঙ্গি হলো, মিলাদ শরীফ এমনই একটি খুশির অনুষ্ঠান যেখানে মানুষেরা সমবেত হন এবং কুরআন মজীদ সহজভাবে তেলাওয়াত করা হয়। অতঃপর নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর ধরাধামে শুভাগমন বিষয়ক বিভিন্ন ভবিষ্যদ্বাণী যা হাদীসসমূহে ও বিভিন্ন লেখনীতে বিধৃত হয়েছে তা বর্ণনা করা হয়, আর তাঁর বেলাদতের সময় যে সব অলৌকিক ঘটনা ও আলামত দেখা গিয়েছিল তাও বর্ণনা করা হয়। এরপর অনুষ্ঠানে আগত মানুষদের সামনে খাবার পরিবেশিত হয় এবং তাঁরা তা নিজ সন্তুষ্টি অনুযায়ী গ্রহণ করেন। মহানবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর বেলাদত দিবস পালনের এই উৎসব হলো বেদআতে হাসানা (উত্তম উদ্ভাবন) এবং যারা এর আয়োজন করেন তাঁরা সওয়াব (আর্শীবাদ) পাবেন। কেননা, এ ধরণের অনুষ্ঠান উদ্যাপনের মধ্যে নিহিত রয়েছে মহানবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর সুউচ্চ শান-মানের প্রতি এবং তাঁর বেলাদতের প্রতি খুশি প্রকাশ।’’ এমন কি (বিভ্রান্তদের গুরু) ইবনে তাইমিয়া দারুল হাদীস প্রকাশিত তার ‘‘সঠিক পথের প্রয়োজনীয়তা’’ শীর্ষক পুস্তকের ২৬৬ পৃষ্ঠায় (নিচের দিকের ৫ম লাইনে) লিখেছে ‘‘খ্রিষ্টানদের যীশু খৃষ্টের জন্মদিন পালনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা স্বরূপ হোক কিংবা মহানবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধা ও ভালবাসার নিদর্শন স্বরূপ হোক, মুসলমান সমাজ মিলাদ অনুষ্ঠানে যা যা আমল করেন, তাঁদের এই ধরণের ইজতেহাদের জন্যে আল্লাহ পাক অবশ্যই তাঁদেরকে পুরস্কৃত করবেন।’’ ইবনে তাইমিয়া অতঃপর লিখেন ‘‘মিলাদ যদিও বা সালাফ, (পূর্ববর্তী যমানার পূণ্যবান মুসলমানবৃন্দ) কর্তৃক আচরিত হয় নি, তথাপি তাঁদের তা অনুশীলন করা উচিত ছিল। কেননা, শরিয়তের দৃষ্টিতে এর বিরুদ্ধে কোনো আপত্তি ছিল না।’’

আর আমরা তো নিঃসন্দেহে মিলাদ উদ্যাপন করি বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি ভালবাসা ও ভক্তি শ্রদ্ধা প্রকাশের জন্যেই।

২. সহীহ্ বুখারী শরীফের শরাহ (ব্যাখ্যা) লেখক ইমাম হাফেয আল কাসতালানী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন, ‘‘আল্লাহ তা’আলা এমন ব্যক্তির প্রতি তাঁর রহমত বর্ষণ করুন, যিনি মহানবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর বেলাদতের মাস রবিউল আওয়ালের রাত (দিন) গুলোকে খুশি প্রকাশ ও উদ্যাপনের বিষয়বস্তু হিসেবে গ্রহণ করেন যাতে মিলাদে পাকের এ উৎসব ওই ব্যক্তির জন্য কঠিন পীড়াদায়ক হয়। যার অন্তরে হিংসা ও একগুয়েমী ইত্যাদি ব্যধি ররেয়ছে। তদুপরি, ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম উদ্যাপনের মাধ্যমে পীড়িত ব্যক্তির হৃদয়ের নিরাময় লাভ হতে পারে।

৩. মিলাদ শরীফ সম্পর্কে ইমাম সৈয়ুতী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি কে যে প্রশ্ন করা হয়ে ছিল তা হাফেয ইবনে হাজর রাহমাতুল্লাহি আলায়হি কেও করা হয়। তিনি উত্তরে বলেন, ‘‘আল্লাহ তা’আলার করুণা অবতীর্ণ হয়েছে কিংবা কোনো দুর্যোগ তিনি দূর করে দিয়েছেন এমন দিবসকে স্মরণ করার জন্যে কোনো নেক কাজ করা এবং তা প্রতি বছর উদ্যাপন করা হলো আল্লাহ তা’আলার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের একটি পন্থা। মহান প্রভুর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ বিভিন্ন এবাদতের মাধ্যমে করা যায়- যেমন, নামাযের সেজদা ও নামাযে দাঁড়ানো, দান সাদকা ও কুরআন তেলাওয়াত। আর এই দিনে (১২ রবিউল আওয়াল) দয়ার নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর ধরাধামে শুভাগমনের চেয়ে আল্লাহ তা’আলার বড় নেয়ামত আ রকী হতে পারে?

কেউ কেউ শুধু ১২ রবিউল আউয়ালের মিলাদুন্নবী উদ্যাপনকে সীমাবদ্ধ রাখেন নি, বরং ওই মাসের পুরোটুকুই মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম উদ্যাপন করে থাকেন। আর কেউ কেউ সারা বছরের যে কোনো দিন তা পালনে ব্রত হয়েছেন। তাঁদের মতে এটি বছরের যে কোনো সময় উদ্যাপন করা যায়। কেননা এর উদ্দেশ্য একই, অর্থাৎ মহানবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর বেলাদতে খুশি প্রকাশ ও তা উদ্যাপন করা।

রাসুল (সাঃ)-এর সুন্নত ও আধুনিক স্বাস্থ্যবিজ্ঞান

মাওঃ গোলাম মোস্তফা

অন্যায়-অবিচার-জুলুম-নির্যাতন-দুর্নীতি-পাপাচারসহ নানাবিধ কুসংস্কারে মানবজাতি যখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে তখন আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মানবজাতিকে হেদায়াতের জন্যে আলোকবর্তিকা হিসেবে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) কে সর্বশ্রেষ্ঠ মহাগ্রন্থ আল-কোরআন দিয়ে প্রেরণ করেন। রাসুল (সাঃ) উত্তম আদর্শ ও মহাগ্রন্থ কোরআনের অনুস্মরণে অসভ্য-বর্বর জাতি উৎকৃষ্ট ও বিশ^ নেতৃত্বদানকারী শ্রেষ্ঠ জাতিতে রুপান্তরিত হয়। রাসুল (সাঃ)-এর ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে পারিবারিক সামাজিক এমনকি রাষ্ট্রীয় জীবন ছিলো বিশ^ মানবতার সেবায় নিয়োজিত ন্যায় ও ইনসাফভিত্তিক আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত। তাঁর প্রতিটি কথা-কাজ-আদেশ-নিষেধে রয়েছে মানবজাতির জন্যে কল্যাণ ও প্রশান্তির ছোঁয়া। কারণ তিনি তো ছিলেন বিশ^বাসীর জন্যে রহমতস্বরুপ। তাঁর প্রতিটি কথা ব্যক্তি মুহাম্মদ (সাঃ)-এর নয় বরং আল্লাহপ্রদত্ত ওহী। পবিত্র কোরআনের সুরা নজমের ৩ ও ৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর তিনি মনগড়া কোনো কথা বলেন না। তিনি যা বলেন তা তো ওহী বা আল্লাহর বাণী, যা তার উপর প্রেরণ করা হয়’। রাসুল (সাঃ)-এর সকল কথা কাজ ও মৌন সমর্থনকে হাদিস বা সুন্নত বলা হয়। তার এ সুন্নত নিয়ে আধুনিক বিজ্ঞানে গবেষণা করা হচ্ছে। যতোই গবেষণা করা হচ্ছে ততোই এর গুরুত্ব ও গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। চিকিৎসাবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, দর্শন শাস্ত্র, জ্যোতিবিদ্যা, ইতিহাস, অর্থনীতি, বিচার ব্যবস্থা, ধর্মতত্ব এমনকি সাংস্কৃতি অঙ্গনেও রাসুল (সাঃ)-এর সুন্নতসমূহ তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগেও শতভাগ বিজ্ঞানসম্মত। মানবজাতির জন্যে সমস্ত নেয়ামতের মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট নেয়ামত হলো সুস্থতা। রাসুল (সাঃ)-এর সুন্নত অনুযায়ী জীবনযাপন করলে যে কতটুকু সুস্থ থাকা যায় তা কেবল সাহাবাদের জীবনী থেকেই জানতে পারি। ভিনদেশী রাজা উপঢৌকন হিসেবে রাসুল (সাঃ)-এর দরবারে একজন চিকিৎসক প্রেরণ করেছিলেন। দীর্ঘদিন মদিনায় থাকার পর চিকিৎসক রাসুল (সাঃ) কে বললেন আমাকে ক্ষমা করবেন আমি চলে যাবো অনেক দিন ধরে এসেছি কোনো রোগী পাইনি এর কারণ বলবেন কি? রাসুল (সাঃ) এক কথায় তার উত্তর দিলেন আমরা ক্ষুধা না লাগলে খাই না আর ক্ষুধা রেখেই খাওয়া শেষ করি তাই রোগ হয় না। প্রিয় পাঠক, রাসুল (সাঃ)-এর একটি কথার অনুস্মরণে চিকিৎসাবিদদের মতে ৭৫ শতাংশ রোগ থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব। রাসুল (সাঃ)-এর এ রূপ অসংখ্য সুন্নতের মধ্য থেকে কিছু সুন্নাতের স্বাস্থ্যগত উপকারিতা তুলে ধরছি। রাসুল (সাঃ)-এর একটি সুন্নত হচ্ছে-এশার নামাজের পরেই ঘুমিয়ে পড়া এবং শেষ রাতে ঘুম থেকে জেগে পবিত্র হয়ে নামাজে দাঁড়িয়ে যাওয়া। এতে চিকিৎসাবিজ্ঞানের মতে মানব শরীরে জমে থাকা অতিরিক্ত চর্বি অনেক রোগের মূল কারণ। রাতের প্রথম ভাগের ঘুম আহার নিয়ন্ত্রণ আর রাতের শেষভাগে ব্যায়ামের মাধ্যমে চর্বি গলে যায়। এমন অভ্যাস সুস্বাস্থ্যের প্রথম সোপান। ঘুম থেকে উঠার পর উভয় হাতের তালু দিয়ে চোখ ও মুখম-ল ঘর্ষণ সুন্নত, এতে ঘুম ও ক্লান্তি উভয় দূর হয় (তিরমিযি)।

মিসওয়াক করা অন্যতম সুন্নত : রাসুল (সাঃ) বলেছেন, উম্মতের জন্যে যদি কষ্ট না হতো তাহলে মিসওয়াক করা ফরজ করে দিতাম (আবু দাউদ)। নিয়মিত মিসওয়াক করলে দাঁতের কয়েকটি ভয়ংকর রোগ যেমন জিনজি ভাইটিস বা দাঁতের পচন রোগ, কেরিসটিথ বা দাঁতের ক্ষয় রোগ ও পাইয়োরিয়া বা দাঁতের মাড়িফোলা রোগ থেকে মুক্ত পাওয়া যায়। অযু বা গোসলের পূর্বে হাত ভালো করে পরিষ্কার করে পানির পাত্রে হাত দেয়া সুন্নত (তিরমিযি)।

স্বাস্থ্য বিজ্ঞানের মতে, হাতে বিভিন্ন কারণে ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়াসহ বিভিন্ন দুষিত পদার্থ লেগে থাকতে পারে। তাই ভালো করে হাত পরিষ্কার করা জরুরি। এরই সূত্র ধরে বর্তমানে করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে সাবান, স্যানিটাইজার, হ্যান্ডওয়াশ, হ্যান্ডগ্রাব দিয়ে হাত পরিষ্কার রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বাথরুম বা টয়লেটে প্রবেশের সময় মাথা ঢাকা ও জুতা পরা সুন্নত। চিকিৎসাবিজ্ঞানের মতে, বাথরুমে বিভিন্ন জীবাণুসহ অনেক বক্র ক্রিমি থাকে যা খালি চোখে দেখা যায় না। মাথা ঢেকে পায়ে জুতা পরে প্রবেশ করলে এসব জীবাণু ও ক্রিমি হতে রক্ষা পাওয়া যায়।

পেশাব-পায়খানা থেকে পবিত্রতা অর্জন করা একটি অত্যাবশ্যকীয় সুন্নত (বুখারী ও তিরমিযি)। বিশেষজ্ঞ স্বাস্থ্যবিদদের মতে, মানব শরীরে প্রতিনিয়ত অসংখ্য রোগ-জীবাণু প্রবেশ করে। কিন্তু রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার কারণে এবং অনুকূল পরিবেশ না পেয়ে ১০ শতাংশ জীবাণু মলের সাথে এবং ৯০ শতাংশ পেশাবের সাথে বের হয়। এসব মলমুত্র শরীরে বা কাপড়ে লাগলে রোগাক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্নতা জরুরি। রাসুল (সাঃ) বলেছেন, তোমরা গোফ খাটো করো এবং দাড়িকে ছেড়ে দাও (বুখারী ও তিরমিযি)। স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের মতে, ঘনঘন দাড়ি ও গোফ সেভ করলে ত্বকের স্পর্শকাতরতা কমে ও দৃষ্টিশক্তি লোপ পায়।

রাসুল (সাঃ)-এর আরেকটি সুন্নত হলো নাভীর নিচে ও বগলের পশম পরিষ্কার করা এবং মাথার চুল ও দাড়ি পরিষ্কার করে তেল ও মেহেদী লাগানো। স্বাস্থ্য গবেষণায় প্রমাণিত চুলে তেল ও মেহেদী লাগালে অকালে চুল পাকা ও ঝড়ে পড়া বন্ধ হয়। রাসুল (সাঃ) হাত ও পায়ের নখ ছোট করার নির্দেশ দেন। নখ ছোট ও পরিষ্কার রাখলে পেটের পীড়া থেকে মুক্ত থাকা যায়। খাওয়ার পর প্লেট ও হাতের আঙ্গুল চেটে খাওয়া সুন্নত। এর দ্বারা খাদ্যের অপচয় রোধ ও ভিটামিন গ্রহণ সম্ভব হয়। আর আঙ্গুল চুষার কারণে মুখের ভিতর সেলিভারি গ্রান্ড নামক এক প্রকার পাচক বের হয়। যা খাদ্য দ্রুত হজমে সহযোগিতা করে এবং বিভিন্ন পীড়া থেকে মুক্ত রাখে।

রাসুল (সাঃ)-এর আলোচিত সুন্নত হলো খাৎনা করা। খাৎনা করলে পুরুষাঙ্গের ফাইমোসিল বা প্যারা ফাইমোসিল ব্যাধি থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। এজন্যে অনেক অমুসলিমও খাৎনা করে থাকে। ইসলামের ৫টি স্তম্ভের প্রতিটিতেই রয়েছে পরকালীন মুক্তির পাশাপাশি ইহকালীন সর্বোৎকৃষ্ট জীবনব্যবস্থা। যেমন ইমান মানুষকে তার প্রভুর সন্ধান মনে প্রশান্তি ও সুন্দর জীবন গঠনের পথ দেখায়। নামাজ মানুষকে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের পাশাপাশি দৈহিক সুস্থতা নিয়মানুবর্তিতা নেতার আনুগত্য ও ভাতৃত্ববোধের শিক্ষা দেয়। নামাজ এমন একটি ইবাদত যা শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রতঙ্গের ব্যায়াম হয়। তাছাড়া সিজদার মাধ্যমে ব্রেইনে সঠিকভাবে রক্ত সঞ্চালনের মাধ্যমে মনে প্রশান্তি আনে। ফলে টেনশন ব্রেইনস্ট্রোক ও হার্টঅ্যাটাকের মতো জটিল সমস্যা থেকে রক্ষা করে।

রোজা একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত। স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের মতে, আমরা প্রতিদিন যে সকল খাদ্য গ্রহণ করি তা প্রয়োজনের অতিরিক্ত অংশ ফেট বা চর্বিতে রূপান্তরিত হয়ে শরীরের অভ্যন্তরে জমে বিভিন্ন রোগের জন্ম দেয়। এ সকল ফেট বা চর্বি ভাঙ্গার একমাত্র মাধ্যম হলো পরিমিত খাদ্যভ্যাস কায়িক পরিশ্রম রোজা বা উপবাস। রমজানের রোজার পাশাপাশি সপ্তাহের সোমবার প্রতি চাঁদেও ১৩, ১৪ ও ১৫ শাওয়ালের ছয় রোজা ও মহরমের দিন রোজা রাখলে শরীরে চর্বি জমার সম্ভাবনা থাকে না। আর অনেক মরণব্যাধি রোগ থেকে রক্ষা পাওয়া যায় বলে অনেক অমুসলিমও রোজার অনুকরণে উপবাস থাকে।

হজ এমন একটি ইবাদত যার মাধ্যমে সারা বিশ্বেও মুসলমানের মিলনমেলায় ভ্রাতৃত্বের সৃষ্টি হয়। স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের মতে, প্রতিনিয়ত মানব ব্রেইনে ম্যাগনেট তৈরি হয়। যা পৃথিবীর কেন্দ্রস্থলের মাটিতে শীর অবনতের মাধ্যমে দ্রুত ম্যাগনেট দূর করা সম্ভব। এজন্যে পবিত্র কাবায় নামাজ আদায়ে এক লক্ষ গুণ ছওয়াব বেশি হয়।

জাকাত ইসলামমের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। জাকাত আদায়ে সম্পদ পবিত্র হয়। দরিদ্রতা দূর হয়ে সমাজে ধনি-গরিবের সামঞ্জস্যতা বজায় থাকে। বিস্ব মানবতার মুক্তির অগ্রদূত হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর প্রতিটি কথা-কাজ-আদেশ-নিষেধের মধ্যে রয়েছে ইহকালীন শান্তি ও পরকালীন মুক্তি। আধুনিক এ বিশ্বায়নের যুগেও রাসুল (সাঃ)-এর সুন্নত বাস্তবায়িত হলে অশান্ত এ পৃথিবীতে শান্তির পরিবেশ ফিরে আসবে। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে রাসুলের সুন্নাতগুলো পালনের তাওফিক দান করুন। আমীন।

লেখক : মাওঃ গোলাম মোস্তফা, কলামিষ্ট ও সহকারী অধ্যাপক, নরিল্যা কলেজ, ধনবাড়ী, টাঙ্গাইল।

তাং ১৫-১০-২০২১ মোবা: ০১৯২৫০৩২৪০৩

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়