প্রকাশ : ১১ অক্টোবর ২০২১, ১৯:২৪
দুর্গাপূজায় প্রাণহীন ফরিদগঞ্জের কুমার পাড়া
এক সময় মাটির তৈরি তৈজসপত্রের প্রচুর প্রচলন থাকলেও আধুনিকতা বাড়ার সাথে সাথে হারিয়ে যেতে বসেছে মৃত শিল্পের পণ্য সামগ্রি গুলো। নববর্ষ আর দুর্গাপূজা এলেই মাটির তৈরি রং-বেরঙের খেলনা বিক্রি করে পরিবারের মুখে হাসি ফোটাতো যে কুমার পরিবারগুলো তাদের অনেকেই এখন দিন কাটাচ্ছেন দৈণ্যতায়। শারদীয় দুর্গাৎসবে কর্মহীন কুমারদের ঘরে নেই পূজার আমেজ।
|আরো খবর
কাদা মাটি দিয়ে নিপুণ হাতের কারুকাজ আর মায়া-মমতায় জড়িয়ে মাটির তৈজসপত্রের তৈরি করার সেই অপরুপ দৃশ্য এখন আর খুব একটা দেখা মিলে না ফরিদগঞ্জে। অথচ এক সময় ফরিদগঞ্জের বিভিন্ন বাজারে কুমার পপাড়ায় ছিলো মাটির তৈজসপত্র কেনা বেচার হিড়িক।
উপজেলার ৭নং পাইকপাড়া ইউনিয়নের আইট পাড়া গ্রামে ৫টি কুমার বাড়িতে জাত ব্যাবসা হিসেবে বংশ পরমপরায় এই কাজ করে আসলেও আধুনিকায়ন ও বাজারে সিলভার, প্লাস্টিক, স্টিলের পন্যের অধিক প্রচলনের কারনে ব্যায় পরিশ্রমের তুলনায় পণ্যের মূল্য কম হওয়ায় এ পেশা ছেড়ে দিচ্ছে অনেকে। 'কুমার পাড়া' নামে পরিচিতি পাওয়া এই গ্রামটিতে হাতে গনা কয়েকজন গৃহীনী ছাড়া এখন আর কেউ এ কাজ করছেন না। মাটির জিনিসপত্র তৈরির এ কাজ ছেড়ে দিয়ে বেছে নিয়েছেন কৃষি কাজ সহ অন্যান্য পেশা।
প্রতিদিন নিত্য বব্যবহৃত মাটির হাড়ি-পাতিলসহ অন্যান্য সামগ্রী তৈরি করে বাজারের দোকানগুলোতে সরবারহ করার পাশাপাশি উপজেলার গ্রামগঞ্জে ঘুরে সকাল থেকে সন্ধা পর্যন্ত ফেরি করে ৫০/৬০ টি মাটির জিনিস বিক্রি করে আয়কৃত অর্থ দিয়েই চলতো এসব পরিবারগুলো।
বংশ পরম্পরায় জাত ব্যাবসায়ী হিসেবে তাদের জীবন-জীবিকার একমাত্র হাতিয়ার ছিলো মাটি। কিন্তু কালের বিবর্তনে কাঙ্খিত মমাটির অভাবে তাদের ভালোবাসার সেই জীবিকা ফিকে হতে বসেছে।
মৃৎ শিল্পীরা মাটি দিয়ে তৈরি করছেন পুতুল, ফুলের টব, কুয়ার পাত, হাঁড়ি পাতিলসহ বিভিন্ন নৃত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। পরে সেগুলোকে তারা উপজেলার বিভিন্ন বাজারের দোকান এবং বাড়ি-বাড়ি ঘুরে ফেরি করে বিক্রয় করে থাকতেন। কিন্তু বর্তমানে মৃৎ শিল্পের বিভিন্ন তৈজসপত্র ব্যবহার তেমন একটা চোখেই পড়ে না। অধিক মূল্যে মাটি ক্রয় করা, চাহিদা কম থাকা ও তৈজসপত্র সঠিক মূল্য না পাওয়ার কারনে এ শিল্প থেকে পিছিয়ে পড়ছে কুমার পরিবারগুলো।
কার্তিক থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত কুমার পল্লিগুলোতে পাতিলের ডাকনা, রুটি বানানোর তাবা, জল কান্দা, মাটির ব্যাংক পুতুল ও হিন্দু ধর্মালম্বিদের প্রতিমা তৈরির ধুম ছিলো। বিক্রিত মাটির হাড়ি পাতিল ৫ টাকা থেকে শুরু করে ৩০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করে যে সংসার গুলো চলতো, চাহিদা না থাকায় গ্রাম বাংলার চিরাচরিত সেই রূপ হারানোর পাশাপাশি সেসব কুমার পরিবারগুলো দৈণ্যতায় দিন কাটাতে হচ্ছে।
ফরিদগঞ্জের কুমার পাড়া খ্যাত পাইক পাড়া ইউনিয়নের রতন পাল (৪০) মাটির জিনিসপত্র তৈরির কাজ করেই ৩ ছেলে ১ মেয়ে সহ ৫ সদস্যের পরিবারের ভরণপোষণ মিটিয়েছেন এই শিল্পের উপর নির্ভর করে। কিন্তু বর্তমানে এর চাহিদা কমে যাওয়ায় অন্যের জমিতে চাষাবাদ করেই চলছেন তার জীবন। এই শিল্পের চাহিদা না থাকায় নিজের ছেলেদেরও এই পেশায় আসতে দেননি। দুই ছেলের এক জন মোবাইল মেকানিক্সের দোকানে ও অন্যজন কাপড়ের দোকানে কাজ করছেন।
পাশ্ববর্তি বাড়ির হরেন্দ্র পাল (৮০) ও জুতিশ চন্দ্র পাল (৬৫) এই দম্পতি ২৫ বছরের অধিক সময় মাটির জিনিস পত্র তৈরিরি কাজ করে তা থেকে আয়কৃত অর্থ দিয়ে পরিবারকে নিয়ে স্বচ্ছলতার পাশাপাশি ২ মেয়েকে বিয়েও দিয়েছেন। বর্তমান সময় যেন নুন আনতে পানতা ফুরানোর মত অবস্থা এই কুমার দম্পতির। একমাত্র ছোট ছেলেকে কাজ শেখাচ্ছেন পার্শ্ববর্তী বাজারের স্বর্ণের দোকানে। এভাবে কুমার পরিবারগুলো এই শিল্প থেকে ক্রমাগত পিছিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।
বিলুপ্তপ্রায় বাঙ্গালীর ঐতিহ্যগত এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকারি কোন উদ্যোগ আছে কি-না এবং অর্থনৈতিক ভাবে অস্বচ্ছল কুমারদের আর্থিক প্রনোদণা পাওয়ার বিষয়ে কোন পদক্ষেপ নিবেন কি-না জানতে চাইলে ফরিদগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার শিউলী হারি চাঁদপুর কণ্ঠকে জানান, এখন পর্যন্ত এমন কোন সরকারি প্রণোদনা আমি প্রদান করিনি। তবে চাঁদপুর কণ্ঠের মাধ্যমে এ বিষয়টি যেহেতু আমি অবগত হয়েছি, এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অবগত করবো।