শুক্রবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০২৫
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ১৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৮:৩২

ধর্মীয় উদাসীনতা ও নামাজ বিমুখ সমাজ কারণ, পরিণতি ও ইসলামী প্রতিকার

মুফতি মুহা. আবু বকর বিন ফারুক
ধর্মীয় উদাসীনতা ও নামাজ বিমুখ সমাজ কারণ, পরিণতি ও ইসলামী প্রতিকার

ইসলাম শুধু কিছু আনুষ্ঠানিক ইবাদতের নাম নয়; বরং এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। মানুষের ব্যক্তিগত চরিত্র, পারিবারিক শৃঙ্খলা, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং রাষ্ট্রীয় ভারসাম্য সবকিছুর সঙ্গে ইসলামের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। এই জীবনব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দু হলো সালাত বা নামাজ। ঈমানের পরই যে ইবাদতটির ওপর ইসলামের ভিত্তি দঁাড়িয়ে আছে, তা হলো নামাজ। অথচ আজকের মুসলিম সমাজের সবচেয়ে বেদনাদায়ক বাস্তবতা হলো ধর্মীয় পরিচয় থাকা সত্ত্বেও নামাজকে জীবনের মূল অংশ হিসেবে গ্রহণ না করা।

বর্তমান বাংলাদেশসহ মুসলিম বিশ্বের বহু সমাজে ধর্মীয় উদাসীনতা একটি নীরব সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। এই উদাসীনতার সবচেয়ে স্পষ্ট ও ভয়াবহ বহিঃপ্রকাশ হলো নামাজ বিমুখতা। মানুষ আল্লাহকে বিশ্বাস করে, রাসুল (সা.)-কে মানে, কিন্তু নিয়মিত নামাজ আদায় করে না এমন একটি দ্বিচারিতার সমাজ আজ গড়ে উঠেছে। এই প্রবন্ধে ধর্মীয় উদাসীনতা ও নামাজ বিমুখতার ধারণা, কারণ, সামাজিক পরিণতি এবং কুরআন–হাদিসের আলোকে এর বাস্তবসম্মত প্রতিকার বিশদভাবে আলোচনা করা হবে।

১. ধর্মীয় উদাসীনতা: অর্থ, স্বরূপ ও বর্তমান বাস্তবতা

ধর্মীয় উদাসীনতা বলতে বোঝায় ধর্মের মৌলিক আদেশ ও নিষেধের প্রতি আগ্রহহীনতা, গুরুত্বহীন দৃষ্টিভঙ্গি এবং বাস্তব জীবনে তা প্রয়োগে অনীহা। এটি সরাসরি ধর্ম অস্বীকার নয়; বরং ধর্মকে জীবনের কেন্দ্র থেকে সরিয়ে প্রান্তে ঠেলে দেওয়ার নামই ধর্মীয় উদাসীনতা।

বর্তমান সমাজে ধর্মীয় উদাসীনতার কিছু সাধারণ লক্ষণ হলো-

নামাজকে সময়ের অপচয় মনে করা।

ধর্মকে শুধু উৎসব বা সংকটকালের আশ্রয় হিসেবে দেখা।

আখিরাতের পরিবর্তে দুনিয়াকেই চূড়ান্ত লক্ষ্য ভাবা।

ইসলামকে ব্যক্তিগত বিষয় বলে সামাজিক জীবন থেকে আলাদা করা।

কুরআনে আল্লাহ তাআলা এমন মানুষের কথা উল্লেখ করেছেন, যারা দুনিয়ার জীবনে মগ্ন হয়ে আখিরাতকে ভুলে যায়। আল্লাহ বলেন যারা দুনিয়ার জীবনকেই অগ্রাধিকার দেয় এবং আখিরাতকে অবহেলা করে, তারা প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত (সূরা আল-আ’লা, আয়াত ১৬-১৭-এর মর্মার্থ)। এই মানসিকতাই ধীরে ধীরে মানুষকে নামাজ বিমুখ করে তোলে।

২. নামাজের মর্যাদা ও অপরিহার্যতা : কুরআনের আলোকে

নামাজ ইসলামের এমন একটি ইবাদত, যার নির্দেশ কুরআনে বারবার এসেছে। এটি কেবল একটি ফরজ আমল নয়; বরং ঈমানের বাস্তব প্রমাণ। কুরআনে মুমিনদের পরিচয় দিতে গিয়ে আল্লাহ প্রথমেই বলেন তারা নামাজ কায়েম করে (সূরা বাকারা, আয়াত ৩-এর মর্মার্থ)।

নামাজ মানুষের চরিত্র গঠনে কী ভূমিকা রাখে, সে সম্পর্কে কুরআন সুস্পষ্ট ঘোষণা দেয়। আল্লাহ বলেন—নিশ্চয়ই নামাজ মানুষকে অশ্লীলতা ও অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখে (সূরা আনকাবুত, আয়াত ৪৫-এর মর্মার্থ)। অর্থাৎ নামাজ শুধু আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে না; বরং সমাজকে নৈতিকভাবে সুরক্ষিত রাখে।

আরেক স্থানে বলা হয়েছে মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে দুর্বল ও অস্থির প্রকৃতির; কিন্তু যারা নামাজ আদায় করে, তারা এর ব্যতিক্রম (সূরা মাআরিজ, আয়াত ১৯-২২-এর মর্মার্থ)। এ আয়াত প্রমাণ করে নামাজ মানুষের আত্মিক ভারসাম্য ও মানসিক স্থিতিশীলতার প্রধান উৎস।

৩. হাদিসের আলোকে নামাজের অবস্থান

রাসুলুল্লাহ (সা.) তঁার পুরো দাওয়াতি জীবনে নামাজের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি নামাজকে ইসলামের স্তম্ভ বলে ঘোষণা করেছেন (বুখারি ও মুসলিম)। স্তম্ভ ভেঙে গেলে যেমন ঘর দঁাড়িয়ে থাকে না, তেমনি নামাজ ছাড়া ইসলামী জীবন কল্পনাও করা যায় না।

এক সহিহ হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, বান্দা ও কুফরের মধ্যে পার্থক্য হলো নামাজ (সহিহ মুসলিম)। অর্থাৎ নামাজ ত্যাগ করা ঈমানের জন্য চরম হুমকিস্বরূপ।

আরেক হাদিসে তিনি বলেন, কিয়ামতের দিন বান্দার সর্বপ্রথম হিসাব নেওয়া হবে নামাজ সম্পর্কে। নামাজ ঠিক থাকলে অন্যান্য আমলও কবুল হবে; আর নামাজ নষ্ট হলে সব আমল নষ্ট হবে (তিরমিজি)। এই হাদিস নামাজের কেন্দ্রীয় গুরুত্বকে অকাট্যভাবে প্রমাণ করে।

৪. নামাজ বিমুখতার মূল কারণসমূহ

ক. ঈমানি দুর্বলতা ও আখিরাত বিস্মৃতি

নামাজ বিমুখতার প্রধান কারণ হলো ঈমানের দুর্বলতা। যখন মানুষের অন্তর থেকে আল্লাহর ভয় ও আখিরাতের জবাবদিহির অনুভূতি কমে যায়, তখন নামাজের গুরুত্বও কমে যায়। কুরআনে বলা হয়েছে, তারা আল্লাহকে ভুলে গেছে, ফলে আল্লাহ তাদের নিজেদেরকেই ভুলিয়ে দিয়েছেন (সূরা হাশর, আয়াত ১৯-এর মর্মার্থ)।

খ. পারিবারিক পরিবেশের সংকট

পরিবার মানুষের প্রথম পাঠশালা। বাবা-মা যদি নিজেরাই নামাজে উদাসীন হন, তবে সন্তানের কাছ থেকে নামাজ প্রত্যাশা করা অবাস্তব। কুরআনে লুকমান (আ.) তঁার সন্তানকে উপদেশ দিতে গিয়ে নামাজের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন (সূরা লুকমান, আয়াত ১৭-এর মর্মার্থ)। বর্তমান পরিবারব্যবস্থায় এই দায়িত্ববোধ অনেকাংশে হারিয়ে গেছে।

গ. শিক্ষাব্যবস্থার ধর্মবিমুখতা

বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা দক্ষতা ও চাকরির প্রস্তুতিতে মনোযোগী হলেও চরিত্র ও ইবাদত গঠনে উদাসীন। স্কুল-কলেজে নামাজের জন্য পর্যাপ্ত সময় ও পরিবেশ না থাকায় শিক্ষার্থীরা নামাজকে জীবনের স্বাভাবিক অংশ হিসেবে গ্রহণ করতে পারে না।

ঘ. ভোগবাদী সংস্কৃতি ও প্রযুক্তির আগ্রাসন

ভোগবাদী জীবনদর্শন মানুষকে ভোগ ও বিনোদনের দাসে পরিণত করেছে। মোবাইল ফোন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ডিজিটাল বিনোদন মানুষের সময় ও মনোযোগ কেড়ে নিয়েছে। ফলে নামাজের সময়ও মানুষ পর্দায় ডুবে থাকে।

ঙ. নামাজ সম্পর্কে ভুল ধারণা ও অপব্যাখ্যা

অনেকে মনে করে, হৃদয় ভালো থাকলেই নামাজের দরকার নেই। আবার কেউ ভাবে বয়স হলে নামাজ শুরু করব। এসব ধারণার কোনো ভিত্তি কুরআন-হাদিসে নেই; বরং এগুলো শয়তানের ধেঁাকা।

৫. নামাজ ত্যাগের ভয়াবহ পরিণতি

ক. আখিরাতের ক্ষতি

নামাজ ত্যাগকারীদের জন্য কুরআনে কঠোর সতর্কতা এসেছে। আল্লাহ বলেন, তাদের পরে এমন প্রজন্ম এসেছে, যারা নামাজ নষ্ট করেছে ও প্রবৃত্তির অনুসরণ করেছে; তারা শাস্তির সম্মুখীন হবে (সূরা মারইয়াম, আয়াত ৫৯-এর মর্মার্থ)।

খ. নৈতিক অবক্ষয়

নামাজ মানুষকে অন্যায় থেকে বিরত রাখে। নামাজ না থাকলে মিথ্যা, দুর্নীতি, ব্যভিচার ও জুলুম সহজ হয়ে যায়। বর্তমান সমাজে নৈতিক অবক্ষয়ের মূল কারণগুলোর একটি হলো নামাজ বিমুখতা।

গ. সামাজিক অস্থিরতা ও অন্যায়

যে সমাজে আল্লাহর ভয় নেই, সেখানে আইন ও শাস্তিও মানুষকে সৎ রাখতে পারে না। নামাজ বিমুখ সমাজে ঘুষ, অবিচার ও ক্ষমতার অপব্যবহার বৃদ্ধি পায়।

৬. নামাজ বিমুখতা দূরীকরণে ইসলামী প্রতিকার

ক. ঈমানি শিক্ষা ও আখিরাত সচেতনতা

কুরআন তিলাওয়াত, অর্থ অনুধাবন ও আখিরাতের আলোচনা মানুষের অন্তরে ঈমান জাগ্রত করে। ঈমান মজবুত হলে নামাজ আপনাতেই জীবনের অংশ হয়ে ওঠে।

খ. পরিবারকেন্দ্রিক নামাজ চর্চা

বাবা-মাকে নিজেরা নামাজে যত্নবান হতে হবে এবং সন্তানদের ছোটবেলা থেকেই নামাজে অভ্যস্ত করতে হবে। কুরআনে পরিবারকে নামাজের আদেশ দিতে বলা হয়েছে (সূরা ত্বা-হা, আয়াত ১৩২-এর মর্মার্থ)।

গ. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মবান্ধব পরিবেশ

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নামাজের সময় ও স্থান নিশ্চিত করা, শিক্ষকদের মাধ্যমে নামাজের গুরুত্ব তুলে ধরা এগুলো দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হতে পারে।

ঘ. মসজিদভিত্তিক দাওয়াহ ও যুব কার্যক্রম

মসজিদকে সমাজ সংস্কারের কেন্দ্রে পরিণত করতে হবে। তরুণদের জন্য আকর্ষণীয় ও বাস্তবমুখী দাওয়াহ কার্যক্রম নামাজে ফিরে আসার পথ সুগম করবে।

ঙ. মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ইতিবাচক ব্যবহার

নামাজের ফজিলত, বাস্তব পরিবর্তনের গল্প ও ইসলামি সচেতনতা ছড়িয়ে দিতে মিডিয়াকে কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে হবে।

৭. নামাজে ফিরে আসা: ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্র পর্যন্ত দায়িত্ব

নামাজে ফিরে আসা শুধু ব্যক্তির দায়িত্ব নয়; এটি পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সম্মিলিত দায়িত্ব। নামাজ কায়েম হলে সমাজে ন্যায়, শৃঙ্খলা ও শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) নামাজকে তঁার চোখের শীতলতা বলে আখ্যায়িত করেছেন (নাসাঈ), যা প্রমাণ করে নামাজ কষ্ট নয়, বরং প্রশান্তির উৎস।

পরিশেষে কথা হলো, ধর্মীয় উদাসীনতা ও নামাজ বিমুখতা বর্তমান মুসলিম সমাজের সবচেয়ে গভীর সংকটগুলোর একটি। কুরআন ও হাদিস সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করে—নামাজ ছাড়া ঈমান, নৈতিকতা ও সমাজ টিকে থাকতে পারে না। সুতরাং ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজের প্রতিটি স্তরে নামাজকে জীবনের কেন্দ্রবিন্দুতে ফিরিয়ে আনাই সময়ের সবচেয়ে বড় দাবি। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে নামাজ কায়েমকারী বান্দা হিসেবে কবুল করুন,আমিন।

লেখক, ইমাম ও খতিব, বিষ্ণুপুর মনোহরখাদী মদিনা বাজার বাইতুল আমিন জামে মসজিদ, চঁাদপুর সদর, চঁাদপুর।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়