প্রকাশ : ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৯:২৪
মায়ের শরীর যত নাজুক তত অবহেলা

আমাদের সমাজে একটি নির্মম সত্য ধীরে ধীরে প্রকট হয়ে উঠেÑমায়ের বয়স যত বাড়ে, শরীর যত নাজুক হয়, তঁার প্রতি অবহেলা যেন ততটাই ঘন হয়। অথচ এই মা-ই একসময় আমাদের হাত ধরে হঁাটতে শিখিয়েছেন, রাতে জেগে রেখেছেন, নিজের ইচ্ছা-স্বপ্নগুলো ত্যাগ করে সন্তানদের মানুষ করেছেন। বয়সের ভারে যখন তঁার হঁাটা ধীর হয়ে যায়, স্মৃতি দুর্বল হয়, অসুখ-বিসুখ বাড়েÑতখনই সন্তানদের ধৈর্য কমে আসে, যত্নের জায়গায় বিরক্তি জন্ম নেয়, আর পরিবারের ভেতরে শুরু হয় সেবা ও খরচ নিয়ে বিবাদ।
|আরো খবর
অনেক ঘরেই দেখা যায়, প্রবীণ মায়ের চিকিৎসার দায়িত্ব নেবে কেÑএ নিয়ে ভাইবোনদের মধ্যে তর্ক তীব্র হয়। কেউ বলে মায়ের জন্যে সময় নেই, কেউ বলে টাকা নেই, আবার কেউ লুকিয়ে মনে করেÑ‘অন্যরা সামলাক’। ফলে মায়ের শরীর যত নাজুক হয়, ততই তঁার প্রয়োজনগুলো বেড়ে উঠলেও বাস্তবে তিনি হয়ে উঠেন ‘ঝামেলা’। খাবার তৈরি থেকে ওষুধ কেনা, ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়াÑসবকিছুই বোঝা মনে হয় কারো কারো কাছে। অথচ মা কখনো অভিযোগ করেন না, শুধু চুপচাপ তাকিয়ে থাকেন ভরসার মানুষগুলোর দিকে, যারা জন্মের পর প্রথম তঁার হাতটাই ধরেছিলো।
গ্রাম-শহর সব জায়গায়ই এমন দৃশ্য অস্বাভাবিক নয়Ñপ্রবীণ মা একা ঘরে বসে আছেন, নাতি-নাতনিরা পাশ দিয়ে দৌড়ে যায়, কিন্তু কেউ জিজ্ঞেসও করে না তঁার ওষুধ খাওয়া হলো কিনা। কখনো খাবার সময় ভুলে যান, আবার কখনো শরীর খারাপ হওয়ার কথা বলতে লজ্জা পানÑ‘ঝামেলা’ মনে হবে বলে। অদ্ভুত হলেও সত্যÑযে মা সারাজীবন ‘বোঝা’ না বানিয়ে সন্তানদের বড়ো করেছেন, সেই মাকেই সন্তানরা বয়স হলে ‘বোঝা’ বলে ভাবতে শুরু করে।
অসম্মানের দৃশ্যগুলোও কম নয়। কেউ কেউ মায়ের কথা বলাকে ‘বকবক’ বলে উড়িয়ে দেয়, কেউ প্রয়োজনের কথা বললে বিরক্তি দেখায়, আবার কেউ বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে নিশ্চিন্ত হয়। অথচ মায়ের শরীর নাজুক মানে তঁার দরকার বাড়তি যত্ন, বাড়তি সময়, বাড়তি ভালোবাসা। বয়সের ভঁাজ মানে তঁার ক্লান্তি, একাকিত্ব আর বিষণ্নতার ছাপÑযা শুধু সহমর্মিতাই দূর করতে পারে।
রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও প্রবীণ মায়েদের অধিকাংশ সময় উপেক্ষাই দেখতে পাওয়া যায়। সরকারি হাসপাতাল হোক বা সামাজিক নিরাপত্তাÑপ্রবীণ নারীদের জন্যে নির্দিষ্ট সহায়তা স্বল্পই। নারী জীবনের শেষ প্রান্তে এসে দঁাড়ান সবচেয়ে দুর্বল অবস্থানে, অথচ তিনি একই সঙ্গে সবচেয়ে বেশি সুরক্ষার দাবিদার। তঁার বয়সী শরীর শুধু ওষুধ-ব্যবস্থাপনায় নয়, প্রয়োজন মানসিক নিরাপত্তা, মর্যাদা ও ভালবাসার পরিবেশ।
তাই আজ প্রয়োজন বড়সড় একটি উপলব্ধিÑপ্রবীণ মায়ের নাজুক শরীর অবহেলার কারণ নয়, বরং সেটাই আমাদের মানবিকতার পরীক্ষার জায়গা। সন্তান হিসেবে দায়িত্ব ভাগাভাগি করা, ধৈর্য রাখা, মায়ের ছোট ছোট চাহিদাকে গুরুত্ব দেওয়াÑএ সবই আমাদের নৈতিক কর্তব্য। মা কথা বারবার ভুলে গেলে রাগ নয়, বরং ধীরে ধীরে বোঝানো দরকার। হঁাটতে কষ্ট হলে হাত বাড়ানো দরকার, আর মনের কষ্ট হলে পাশে নীরবে বসে থাকার মানুষ দরকার।
কারণ, দিনের শেষে প্রবীণ মা আমাদের অতীতের স্মৃতি নয়Ñতিনি এখনো আমাদের বর্তমানের আশীর্বাদ। তঁার নাজুক শরীর অবহেলার নয়, সর্বোচ্চ ভালোবাসার দাবিদার। মায়ের জীবন যত দীর্ঘ, তঁার মর্যাদা যেন তত উজ্জ্বল হয়Ñএই অঙ্গীকারই আমাদের মানবিক সমাজের ভিত্তি হতে পারে।








