প্রকাশ : ২৯ অক্টোবর ২০২৫, ০৯:২৫
বাঁশির সুরে তিন দশক ধরে মুগ্ধতা ছড়াচ্ছেন বেলাল শেখ

চাঁদপুরে কোনো এক বিকেলে মেঘনা নদীর পাড়ে, নির্জন কোনো স্থানে কিংবা গাছতলায় হঠাৎই ভেসে আসে এক মায়াময় সুর। বাঁশির সেই সুরে যেন থমকে যায় সময়। কখনও বিষণ্নতা, কখনও আনন্দ আবহ, আবার কখনও এক অপার আকুলতা ছড়িয়ে দেয় বাতাসে। সেই সুরের কারিগর মো. বিল্লাল হোসেন বেলাল শেখ। তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে চাঁদপুরের সংস্কৃতি অঙ্গনে তিনি বাঁশির সুরে মুগ্ধ করে চলেছেন চাঁদপুরের মানুষকে। ছোটবেলায় কারো কাছে শেখা নয়, শান্ত বিকেল আর একলা দুপুর ছিলো তার শিক্ষক। শখের বসে হাতে তুলে নেওয়া বাঁশিই হয়ে উঠে জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। নদীর পাড়ে বসে, কিংবা বাগানের নীরবতায় তিনি ঘন্টার পর ঘন্টা বাঁশিতে ফুঁ দিতেন। নিজেই সুর খুঁজতেন, নিজেই ভুল ঠিক করতেন। এভাবেই ধীরে ধীরে একদিন নিজের ভেতর খুঁজে পান একজন স্বশিক্ষিত বাঁশি-শিল্পীকে।
২০০৫ সালের কথা। চাঁদপুরের ঐতিহ্যবাহী মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলা মঞ্চে ‘নতুন কুঁড়ি ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক সংগঠন’-এর আয়োজনে প্রথমবার বাঁশির সুরে গান তোলেন ‘আমায় এতো রাতে কেন রে ডাক দিলি’। সেই রাতেই চাঁদপুরের সংস্কৃতি অঙ্গনে একজন বংশীবাদক হিসেবে তার আনুষ্ঠানিক অভিষেক ঘটে। দর্শক তখন মুগ্ধ, মঞ্চে নেমে আসে করতালির ঝড়।
এরপর থেকে আর থামেননি বেলাল শেখ। নিয়মিত বাঁশি বাজান স্বদেশ সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠন, অনন্যা নাট্যগোষ্ঠী, জাগরণী নাট্যগোষ্ঠী, শিশু থিয়েটারসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের অনুষ্ঠানে। অনেক নাটকের চরিত্রের আবেগকে তিনি নেপথ্যে বাঁশির সুরে জীবন্ত করে তুলেছেন। তার বাঁশি যেন কখনও সংলাপের মতো, কখনও নীরব ভালোবাসার মতো কথা বলে।
চাঁদপুরের সংস্কৃতি অঙ্গনের বিভিন্ন সংগঠনের আয়োজিত অনুষ্ঠানে তার বাঁশিতে প্রায়ই শোনা যায় চিরায়ত বাংলা ও লোকজ গানের সুরÑ’ও কি গাড়িয়াল ভাই, আমার গলার হার খুলে নে ওগো ললিতে, প্রাণ সখিরে ওই শুন কদমতলায় বাঁশি বাজায় কে, খায়রুন সুন্দরী, সব সখিরে পার করিতে’ সহ বিভিন্ন কালজয়ী জনপ্রিয় গান। আর সেই অনন্তপ্রিয় ‘আমায় এত রাতে কেন রে ডাক দিলি’। তার মায়াবী সুরে মুগ্ধ হয়ে চাঁদপুর জেলা প্রশাসন তাকে পুরস্কার প্রদান করেছিলো। আবার ‘নতুন কুঁড়ি সাংস্কৃতিক সংগঠন’ তার বাঁশি বাজানোর ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে সংবর্ধনা ও ক্রেস্ট প্রদান করে।
বিল্লাল হোসেন বেলাল শেখ নিজের সাফল্যের কথা বলতে গিয়ে বিনয়ভরে বলেন, সবার কাজেই কোনো না কোনো ওস্তাদ থাকে, কিন্তু আমি নিজেই ছিলাম নিজের শিক্ষক। ছোটবেলা থেকেই শখের বসে বাঁশি বাজাতে বাজাতে একসময় পুরোপুরি শিখে ফেলি। কয়েক বছর ধরে সারেগামার সুর নিয়েও অনুশীলন করেছি। আমার বাঁশির সুর শুনে যারা মুগ্ধ হন, তাদের ভালোবাসাই আমার প্রাপ্তি।
বাঁশি বাজানোকে ভালোবেসে তিনি বলেন, চাঁদপুরের বাইরে থেকেও যদি কেউ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্যে তাকে বাঁশির সুর উপস্থাপনের জন্যে ডাকে, তাহলে তিনি সানন্দে ছুটে যাবেন। কারণ, তার কাছে বাঁশি শুধু যন্ত্র নয়, এটি তার প্রাণের প্রকাশ, তার আত্মার ভাষা।
এভাবেই এক জীবনের ভালোবাসা, হাজারো শ্রোতার প্রশংসা, আর একনিষ্ঠ সাধনা নিয়ে আজও তিনি বাজিয়ে চলেছেন বাঁশি।
উল্লেখ্য, মো. বিল্লাল হোসেন শেখ (বেলাল শেখ)-এর মাতা রওশানারা বেগম। ১৯৬৮ সালের ৩০ জানুয়ারি চাঁদপুর শহরের পুরাণবাজার এলাকার পশ্চিম শ্রীরামদী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা আব্দুল হামিদ শেখ। শৈশব থেকেই সংগীতের প্রতি ছিলো গভীর অনুরাগ। গত ৩২ বছর ধরে তিনি বাঁশি বাজিয়ে আসছেন নিরলসভাবে।







